विवेचन सारांश
কুরুযুদ্ধের আনুপূর্বিক বিবরণ

ID: 1596
बंगाली - বাংলা
রবিবার, 09 অক্টোবর 2022
অধ্যায় 1: অর্জুনবিষাদয়োগ
2/4 (শ্লোক 1-10)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিশারদ ড: আশু গোয়েল মহাশয়


শ্রীগুরু বন্দনা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা এবং পরম্পরাগত দীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে আজকের বিবেচন সত্র শুরু হয়। এখন আমরা শুধুমাত্র গীতাজীর পঠন ও চিন্তনই করছি না, পাশাপাশি গীতাকে জীবনে প্রয়োগ করে আমাদের জীবনধারাকে পরিবর্তনে প্রয়াসী হয়েছি। এই সব সম্ভব হয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অসীম কৃপা, গুরুদেবের আশীর্বাদ এবং আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতির ফলস্বরূপ। 
"বিনু হরি কৃপা মিলহিং নহিং সংতা"
এখন আমাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া এই সব সম্ভব নয়। শুনতে শুনতে, অধ্যয়ন করতে করতে আসুন আমরা প্রথম অধ্যায়ে প্রবেশ করি। প্রথমে কুরুবংশের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করি। ভগবদ্গীতা হলো অষ্টাদশপর্বী মহাভারতের অন্তর্গত ভীষ্মপর্বের ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায়ের সংকলন। এটি মহাভারত থেকে নেওয়া একটি ছোট গ্রন্থ বিশেষ। আকারে ছোট হলেও এটি অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ এক অনন্য শক্তিশালী গ্রন্থ। জগৎ সংসারে এঁর থেকে অধিক কার্যকরী আর কোনো গ্রন্থ নেই।

অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষীত, পরীক্ষীতের পুত্র জনমেজয়। তিনি বেদব্যাসজীর শিষ্য বৈশম্পায়ন মুনির কাছে নিজেদের বংশের ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি জনমেজয়কে মহাভারতের কথা শোনান। তিনি বলেন, এই কাহিনি সূতজী শৌণক মুনিকে বলেছিলেন। এভাবে অনেক বক্তা, অনেক শ্রোতা মহাভারতের সাথে যুক্ত হন। এদের মধ্যে অন্যতম চারজন শ্রোতা হলেন -জনমেজয়, শৌণক, অর্জুন এবং ধৃতরাষ্ট্র। চারজন বক্তা - বৈশম্পায়ন, সূতজী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং মহামতি সঞ্জয়। গীতায় মোট ৭০০ শ্লোক , এর মধ্যে ১টি শ্লোক ধৃতরাষ্ট্র, ৪১টি শ্লোক সঞ্জয়, ৮৪ টি শ্লোক অর্জুন এবং ৫৭৪ টি শ্লোক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজমুখে বলেছেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,  " গীতা মে হৃদয়ং পার্থ ", হে পার্থ ! গীতা হলো আমার হৃদয়।
যুদ্ধের দশমদিন পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় পতিত হলে সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সেই সংবাদ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে নিয়ে যান। সঞ্জয় ছিলেন গাবল্যগণ নামক এক সূতের পুত্র, তিনি রথচালক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অধ্যয়নের দিকে সঞ্জয়ের বিশেষ আগ্রহ ছিলো। তিনি বেদব্যাসজীর কাছে গিয়ে তাঁর নিকট শাস্ত্রশিক্ষার জন্য প্রার্থনা করেন। ব্যাসজী প্রথমে সে সূতপুত্র বলে একটু ভাবছিলেন, পরমূহুর্তে শাস্ত্রশিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে তাঁকে শিষ্য করে নেন। তাঁকে সম্পূর্ণ শাস্ত্র শিক্ষা দান করেন, শিক্ষান্তে তাঁকে ব্রাহ্মণত্ব লাভের বরদান করেন। ভারতের বর্ণপ্রথা প্রকৃত অর্থে যে জাতিগত নয়, এই ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এরপর বেদব্যাসজী সঞ্জয়কে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে নিয়ে যান এবং বলেন, ইনি আমার যোগ্য শিষ্য, এঁনাকে  তোমারকাছে রাখো। তুমি আমার পুত্র, তোমার কল্যাণের জন্য আমি একাজ করছি। তখন থেকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের সারথী এবং মন্ত্রী হলেন। মহাভারতে সঞ্জয় ও বিদুর - দুই মহামতি ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলেও প্রবল পুত্রমোহের কারণে শুধুমাত্র দৃষ্টিশূন্যই ছিলেন না, বিবেকশূন্যও হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পুত্রের নানাবিধ অন্যায় কাজে নীরব সমর্থন দিয়ে তাকে সর্বনাশের শেষ সীমায় পৌঁছে দেন। 

দুর্যোধন ষড়যন্ত্র করে হস্তিনাপুর থেকে দুরে বারণাবত নামক স্থানে একটি সুন্দর ভবন তৈরি করান, যার দেওয়ালগুলি লাক্ষা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে আাগুনের ছোঁয়া লাগলে সহজেই ভবনটি ভস্মীভূত হতে পারে। বারণাবতে একটি বড়ো মেলার আয়োজন হতো, তাই দুর্যোধন পিতাকে বলেন যে তিনি যেন পাণ্ডবদের আদেশ দেন তারা যেন রাজপরিবারের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সেই ভবনেই অবস্থান করেন। বিদুর ব্যাপারটি বুঝে যুধিষ্ঠিরকে সেখানে না যাবার সংকেত পাঠান। কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির জেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অমান্য করতে না পেরে সপরিবারে সেখানে যান। পরে অবশ্য বিদুরের কৌশলে তাঁদের প্রাণরক্ষা হয়। ধৃতরাষ্ট্র অনেকবার লোকদেখানোর জন্য যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসানোর মিথ্যা চেষ্টা করেন। তিনিই যুধিষ্ঠিরকে কপট দ্যুতক্রীড়ায় অংশ নিতে বাধ্য করান। ঐখেলায় সর্বস্ব হারানোর পর প্রকাশ্য রাজসভায় চূড়ান্ত অপমানিত দ্রৌপদী ক্রোধান্বিত হয়ে উপস্থিত সকল মান্য ব্যক্তিদের প্রতি রোষ ব্যক্ত করেন। তখন ভীম প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে সব কিছু ধ্বংস করে দেবার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা শুনে ভয়ভীত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে সব কিছু ফিরিয়ে দেবার আদেশ  দেন। 

পাণ্ডবরা সেখান থেকে প্রস্থান করার পর দুর্যোধনের মামা শকুনি ও মহাবীর কর্ণকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যান এবং বলেন, আপনি এতো কষ্ট করে জেতা এই রাজপাট ও বিপুল ধনসম্পদ কেন পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দিলেন! আপনি এখনি দূত পাঠিয়ে তাদের এখানে ডেকে পুনরায়  দ্যূতক্রীড়ায় বসার আদেশ দিন। বার বার না বলার পরও শেষ পর্যন্ত পুত্রের অনুরোধ ফেলতে না পেরে যুধিষ্ঠিরকে পুনরায় দ্যূতক্রীড়ার আদেশ দেন। এবার ঠিক হলো মাত্র একবাজি খেলা হবে, যে পক্ষ হেরে যাবে তাদের বারো বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে যেতে হবে। এবারও যথারীতি পাণ্ডবরা হেরে যান এবং তারা বনবাসে যেতে বাধ্য হন। অজ্ঞাতবাস শেষে তারা ফিরে এলে কৌরবরা পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করে। তখন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের জন্য মাত্র পাঁচটি গ্রাম দাবী করেন। দূর্যোধন তাও অস্বীকার করে বলে ওঠে, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। যুধিষ্ঠির যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু মাতা কুন্তী তাঁর পুত্রদের, বিশেষতঃ কুলবধু দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি কি এই জন্য তাঁর বীর পুত্রদের জন্ম দিয়েছিলেন? ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়, বিদুর ও অন্যান্যদের পরামর্শ মতো প্রথমে যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও পরে পুত্রের মতে মত দেন। 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, গীতাপ্রেস থেকে প্রকাশিত " বিদুরনীতি" নামক একটি অত্যন্ত উপযোগী গ্রন্থ মহাভারতের কাহিনি অনুসারেই লিখিত।

1.1

ধৃতরাষ্ট্র উওয়াচ ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে, সমবেতা য়ুয়ুৎসবঃ
মামকা: (ফ্) পাণ্ডবাশ্চৈব, কিমকুর্বত সঞ্জয়॥1॥

ধৃতরাষ্ট্র বললেন- হে সঞ্জয়! ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের ইচ্ছায় সমবেত আমার এবং পাণ্ডুর পুত্রগণ কি করল?

বিবেচন - গীতায় ধৃতরাষ্ট্র মাত্র এই ১টি শ্লোকই বলেছিলেন। গীতার শুরু "ধ"  (ধর্মক্ষেত্রে) এবং শেষ হয় "ম" (নীতির্মতির্মম) অক্ষর দিয়ে। সম্পূর্ণ গীতা ধর্ম দ্বারা আবদ্ধ।
"জানে ক্যা জাদু হুআ ভগবান তুম্হারী গীতা মে "।।
কুরুক্ষেত্র মুনি ঋষিদের তপস্যাস্থল ছিল, সেই কারণে ধর্মযুদ্ধের জন্য এই স্থানটি নির্বাচন করা হয়। এখানে যে সকল বীরের মৃত্যু হবে তারা অচিরেই মোক্ষপ্রাপ্ত হবেন। এটি এমনই এক উত্তম স্থান। আমাদের শাস্ত্রে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ - এই চারটি পুরুষার্থের কথা আছে। গীতা ধর্মের কথা বলে। ধর্ম বলতে আমরা সাধারণভাবে হিন্দু, মুসলিম, শিখ এসবই বুঝি, কিন্তু এগুলি ধর্ম নয়, এগুলি একেকটি পন্থা। ধর্মের অর্থ কর্তব্য। যা ধারণ করার যোগ্য তাই ধর্ম। ধর্ম করতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় অধর্মের পথে চলে যায়, গীতা আমাদের ধর্মপথে চলার শিক্ষা দান করে। ধৃতরাষ্ট্রের কৌতুহলী জিজ্ঞাসা, হে সঞ্জয়! যুদ্ধের কারণে একত্রিত হয়ে আমার  এবং পাণ্ডুর পুত্রেরা কিরূপ প্রস্তুতি নিয়েছে ?  এখানে " মামকা "(আমার) শব্দটির প্রয়োগ ধৃতরাষ্ট্রের সংকীর্ণ ভেদ নীতির পরিচয় বহন করে।

1.2

সঞ্জয় উওয়াচ

দৃষ্ট্বা তু পান্ডাবানীকং(ৱ্ঁ), ব্য়ূঢং (ন্) দুর্য়োধনস্তদা।
আচার্য়মুপসঙ্গম্য, রাজা বচনমব্রবীৎ॥1.2॥

সঞ্জয় বললেন তখন বজ্রব্যূহের দণ্ডায়মান পাণ্ডব সৈন্যগণ কে দেখে রাজা দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকটে এই কথা বললেন

বিবেচন - সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তরে বলেন,  হে রাজন ! দুর্যোধন পাণ্ডবদের রচিত সেনাব্যুহ দেখে গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে যান এবং বলতে থাকেন -

1.3

পশ্যৈতাং (ম্) পাণ্ডুপুত্রাণাম্, আচার্য় মহতীং (ঞ্) চমূম্
ব্য়ূঢাং(ন্) দ্রুপদপুত্রেণ, তব শিষ্য়েণ ধীমতা॥3॥

হে আচার্যদেব আপনার ধীমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্তৃক রচিত ব্যুহে এই বিশাল সৈন্য সমূহকে লক্ষ্য করুন

বিবেচন - দুর্যোধন গুরু দ্রোণাচার্যকে বলেন, দ্রুপদপুত্র এবং আপনার প্রিয় মেধাবী শিষ্যের তৈরি সেনাব্যুহ এবং পাণ্ডব পক্ষের বিশাল সেনাবাহিনী ভালো করে দেখুন। এই কথায় গুরুর উপর খানিকটা ব্যঙ্গ করা হয়েছে বলে মনে হয়। আচার্য দ্রোণের এক অনন্য কাহিনী আছে। তিনি ভগবান পরশুরামের শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁর গুরুকে সন্তুষ্ট করে ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেছিলেন। তাঁর নীতি ছিল তিনি তাঁর শিক্ষা বিক্রি করবেন না। তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ছিলেন। তিনি কৃপাচার্যের বোন কৃপিকে বিবাহ করেন, তাঁদের পুত্রের নাম অশ্বত্থামা। পুত্রের জন্য সামান্য দুধ কেনার সামর্থ তাঁদের ছিল না। কৃপি ময়দা জলে গুলে দুধের মতো তাকে খাওয়াতেন। একদিন এই নিয়ে বন্ধুদের সাথে অশ্বত্থামার তর্ক হয়। একজন তাকে বলে, তুমি কিভাবে যুদ্ধ করবে, তুমি তো দুধ কি জিনিস তাও জানো না। সে তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আসল দুধের স্বাদ চেনায়। বাড়ি ফিরে আসল সত্য জানতে পেরে অশ্বত্থামা খুব কেঁদেছিলেন। স্বামী বাড়ি ফিরলে সেদিন কৃপি তাকে অনেক মন্দ কথা বলেন এবং তাকে তার বন্ধু দ্রুপদের সাথে দেখা করে কিছু সাহায্য চাইতে বলেন। দ্রুপদ আর দ্রোণ দুজনেই একসাথে পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন, সেই হিসাবে তাঁরা ভালো বন্ধু ছিলেন। স্ত্রীর কথায় দ্রোণ দ্রুপদ রাজার প্রাসাদে যান, দ্বাররক্ষীকে বলেন, রাজাকে সংবাদ দিয়ে বলো তাঁর বন্ধু দ্রোণ এসেছে। দ্রুপদের ব্যাপারটি ভালো লাগেনি, তবু তিনি দ্রোণকে ভিতরে আসতে অনুমতি দেন। বহুদিন পর বন্ধুকে দেখে দ্রোণ  তাকে আলিঙ্গন করেন । দ্রুপদ তা ছাড়িয়ে দিয়ে বলেন, তোমার আর আমার মধ্যে এখন অনেক পার্থক্য, যদি কিছু চাইতে হয় তো ব্রাহ্মণ হিসাবে চাইতে পারো, বন্ধু হিসাবে নয়। এতে দ্রোণ অপমানিত বোধ করেন এবং সেখান থেকে চলে আসেন, মনে মনে স্থির করেন যেদিন দ্রুপদের সমকক্ষ হতে পারবেন সেদিন এর যোগ্য জবাব দেবেন। দ্রোণ বাড়ি ফিরে না গিয়ে হাটতে হাটতে হস্তিনাপুর গিয়ে পৌঁছান। সেখানে ছেলেরা খেলা করছিলো, তাদের বলটি এক কূপের মধ্যে পড়ে যায়, তারা সেটি তুলতে পারছিল না। দ্রোণ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে যান। তিনি কতগুলি তৃণ নিয়ে ধনুবিদ্যার বিশেষ মন্ত্রবলে ধনুকের সাহায্যে একটি করে তৃণ বলের সাথে জুড়ে বলটিকে তুলে আনেন। এতে ছেলেরা খুব আশ্চর্য ও প্রসন্ন হয়। অর্জুন দৌড়ে গিয়ে পিতামহ ভীষ্মকে সবকিছু জানান। ভীষ্ম তৎক্ষনাৎ সেখানে আসেন এবং দ্রোণের সাথে আলোচনা করে তাঁকে কুরু ও পাণ্ডুপুত্রদের অস্ত্রগুরু হিসাবে নিযুক্ত করেন। অর্জুন তাঁকে দ্রোণাচার্য নাম দেন। দ্রোণাচার্য তাদের বলেন যে শিক্ষা শেষ হলে তিনি তাঁর শিষ্যদের কাছে গুরু দক্ষিণা নেবেন। এরপর তিনি তাদের মনোযোগ সহকারে অস্ত্রবিদ্যা শেখাতে থাকেন । শিক্ষা শেষ হলে তিনি গুরুদক্ষিণা হিসাবে রাজা দ্রুপদকে যুদ্ধে পরাস্ত করে সেখানে নিয়ে আসার আদেশ দেন। দুর্যোধন সৈন্য নিয়ে দ্রুপদের কাছে পরাস্ত হন। শেষে অর্জুন একাই যুদ্ধ করে দ্রুপদকে পরাস্ত ও বন্দী করে গুরুর সামনে হাজির করেন। এবার দ্রোণ বন্ধুকে বলেন, বন্ধু, এখন আমরা সমান সমান হ'লাম। দ্রুপদ উত্তরে বলেন, না, সমান সমান আর কি করে হলাম, তুমি এখন রাজা আর আমি তোমার বন্দী। দ্রোণাচার্য তৎক্ষনাৎ তাকে মুক্ত করে অর্ধেক রাজত্ব ফিরিয়ে দেন এবং বাকি অর্ধেক পুত্র অশ্বত্থামাকে দেন। দ্রুপদ এতে অপমানিত বোধ করেন, তিনি ফিরে গিয়ে তার গুরু যাজকে বলেন তিনি পুত্রকামনায় একটি যজ্ঞের আয়োজন করতে চান,এবং সে পুত্র যেন এমন শক্তিশালী হয় যাতে সে দ্রোণাচার্যকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করতে সমর্থ হয়। যাজ বলেন তাঁর ভাই উপযাজ এই যজ্ঞ করবেন। যথাসময়ে ঐ যজ্ঞ শুরু হয়, পুর্ণাহুতি দিতেই ঐ যজ্ঞাগ্নি থেকে উৎপন্ন হয় এক দিব্যকন্যা - দ্রৌপদী। দ্রুপদ বলেন আমি তো পুত্র চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত ঐ যজ্ঞ থেকেই জন্ম হল এক দিব্য পুত্র -ধৃষ্টদ্যুম্ন। ধৃষ্টদ্যুম্ন বড় হলে তার অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার জন্য উপযুক্ত গুরুর সন্ধান শুরু হয়, কিন্তু ঐ সময় দ্রোণাচার্যের সমকক্ষ আর কাউকে পাওয়া না যাওয়ায় দ্রুপদ তাঁর কাছেই ছেলেকে অস্ত্রশিক্ষার জন্য নিয়ে যান। গুরু দ্রোণাচার্য তাতে সম্মত হন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দান করেন। দুর্যোধন এই কাহিনী জানতেন। তাই তিনি এখানে গুরু দ্রোণাচার্যকে খোঁচা দিতে আপনার মেধাবী শিষ্য আপনার বিপক্ষের সেনাপ্রধান কথাটি বলেছেন। 

1.4

অত্র শূরা মহেষ্বাসা, ভীমার্জুনসমা য়ুধি য়ুয়ুধানো বিরাটশ্চ, দ্রুপদশ্চ মহারথ:॥4॥

এই স্থানে (পাণ্ডব সৈন্যদলে) বহু বড় বড় বীরযোদ্ধা আছেন, যাদের অনেক বিশাল ধনুক আছে এবং যারা ভীম ও অর্জুনের সমকক্ষ যোদ্ধাl এদের মধ্যে রয়েছেন যুযুধান(সাত্যকি),বিরাট রাজা এবং মহারথী দ্রুপদ।

 

1.5

ধ্রুষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ(খ্), কাশিরাজশ্চ বীর্য়বান্
পুরুজিত্কুন্তিভোজশ্চ, শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গব:॥5॥

রয়েছেন ধৃষ্টকেতু, চেকিতান এবং মহা পরাক্রমী কাশীরাজ। আরো আছেন পুরোজিৎ এবং কুন্তিভোজ দুই ভাই এবং নর শ্রেষ্ঠ শৈব্য।

 

1.6

য়ুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত, উত্তমৌজাশ্চ বীর্য়বান্
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ, সর্ব এব মহারথাঃ॥6॥

আছেন পরাক্রমী যুধামন্যু এবং উত্তমৌজা, আছেন সুভদ্রার পুত্র অভিমুন্য এবং দ্রোপদীর পঞ্চপুত্র- এরা সকলেই মহাপরাক্রমশালী মহারথী।

বিবেচন - দুর্যোধন বলছেন, গুরুদেব পাণ্ডবপক্ষে অনেক বড় বড় যোদ্ধা রয়েছেন, তাদের অনেকেই ভীম-অর্জুনের সমকক্ষ। অর্জুনের শিষ্য যুযুধান (সাত্যিক) নারায়ণী সেনার প্রধান হয়েও তাঁর গুরু অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেন। আর আপনার শিষ্যদের দেখুন আপনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। রাজা বিরাট, আপনার মিত্র দ্রুপদও ঐ পক্ষে। ধৃষ্টকেতু, চেকিতান,কাশীরাজ, পুরুজিত,কুন্তিভোজ, শৈব্যের মতো মহাপরাক্রমশালী বীর, সুধামন্যু, উত্তমৌজা, সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র - প্রত্যেকেই বীর ও মহারথী।
ধৃষ্টকেতু -মহাবীর শিশুপালের পুত্র।
চেকিতান - যাদবসেনা, আগে কৌরবপক্ষে ছিলেন।
কাশীরাজ - অত্যন্ত পরাক্রমী বীর।
পুরুজিত ও কুন্তিভোজ - কুন্তীর দুই ভাই।
শৈব্য - যুধিষ্ঠিরের শ্বশুর এবং বলশালী বীর।
যুধামন্যু ও বিক্রান্ত - পাঞ্চালদেশের বীর যোদ্ধা।
সৌভদ্র - সুভদ্রার পুত্র, অভিমন্যু।
দ্রৌপদেয় - দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র - প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক এবং শ্রুতসেন।
দুর্যোধন গুরু দ্রোণাচার্যকে এইসব বীর যোদ্ধাদের সম্বন্ধে সচেতন করে এঁদের উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতে বলেন।

1.7

অস্মাকং(ন্) তু বিশিষ্টা য়ে, তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম
নায়কা মম সৈন্যস্য, সঞ্জ্ঞার্থং(ন্) তান্ব্রবীমি তে॥7॥

হে দ্বিজোত্তম! আমাদের পক্ষের প্রধান যোদ্ধাদের সম্বন্ধে অবগত হন। আপনাকে স্মরণ করাতে তাদের কথা বলছি।

বিবেচন - দুর্যোধন বলছেন, আমাদের পক্ষেও অনেক বড় বড় বীর যোদ্ধা রয়েছেন। হে দ্বিজবর, ঐ পক্ষের সবাইকে আপনি জেনে নিন।

1.8

ভবান্ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ, কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ, সৌমদত্তিস্তথৈব চ॥8॥

আপনি (দ্রোণাচার্য ) এবং পিতামহ ভীষ্ম এবং কর্ণ ও সংগ্রাম বিজয়ী কৃপাচার্য, অশ্বথামা, বিকর্ণ ও সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা

বিবেচন - দুর্যোধন গুরু দ্রোণাচার্যকে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ সম্বোধন করে বলছেন, আমাদের পক্ষে আপনি, পিতামহ ভীষ্ম, মহাবীর কর্ণ আছেন। আর রয়েছেন চিরজীবী কৃপাচার্য, যদিও তিনি পাণ্ডব হিতৈষী। আমরা অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারি। আপনার পুত্র অশ্বত্থামাও অমর মহারথী আর তিনি তো আপনার কাছেই অস্ত্রবিদ্যা শিখেছেন। আমার ভাই বিকর্ণ এবং শান্তনুর বড় ভাইয়ের পৌত্র সৌমদত্তের পুত্র  ভূরিশ্রবাও ধর্মাত্মা এবং যথেষ্ট প্রতাপশালী বীর।

1.9

অন্যে চ বহবঃ(শ্), শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ
নানাশস্ত্রপ্রহরণা:(স্), সর্বে য়ুদ্ধবিশারদাঃ॥9॥

এরা ছাড়া আরও যোদ্ধা আছেন, যারা আমার জন্য প্রাণত্যাগে প্রস্তুত হয়েছেন এবং যারা নানাপ্রকার অস্ত্রবিদ্যা জানেন এবং সর্বপ্রকার যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী

বিবেচন -এইরকম আরও অনেক বীর আমাদের পক্ষে আছেন যারা আমার জন্য জীবনদান করতে সদা তৎপর। তারা বিভিন্ন প্রকার শস্ত্রচালনায় যথেষ্ট দক্ষ এবং যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ কুশলী।

1.10

অপর্য়াপ্তং(ন্) তদস্মাকং(ম্), বলং(ম্) ভীষ্মাভিরক্ষিতম্
পর্য়াপ্তং(ন্) ত্বিদমেতেষাং (ম্), বলং (ম্) ভীমাভিরক্ষিতম্॥10॥

আমাদের সৈন্যগণ পাণ্ডবদের জয় করার পক্ষে অপর্যাপ্ত ও অসমর্থ কারণ তাদের সংরক্ষক হিসাবে আছেন (উভয়েরই পক্ষপাতী) ভীষ্ম। কিন্তু পাণ্ডব সৈন্যগণ আমাদের জয় করার পক্ষে পর্যাপ্ত এবং সমর্থ; কারণ তাদের সংরক্ষক হিসেবে আছেন (নিজসেনাদলের পক্ষপাতী) ভীম।

বিবেচন  - দশম শ্লোকটির অর্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, দুর্যোধন বলছেন তাদের সেনাবাহিনী জয়লাভের জন্য পর্যাপ্ত, আবার একদলের মতে দূর্যোধন মনে করেন তার সেনাবাহিনী পাণ্ডবদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে সক্ষম। তবে দুর্যোধন পাণ্ডবদের থেকে একটি কারণেই  ভীত, সেটি হলো তার সেনাবাহিনীর প্রধান পিতামহ ভীষ্ম তার পক্ষে থাকলেও তাঁর মন কিন্তু রয়েছে প্রিয় পাণ্ডবদের দিকে। একদল বিদ্বানের এই মত যে দূর্যোধন মনে করেন,  আমাদের সেনাপতি পিতামহ ভীষ্ম আর পাণ্ডবদের সৈন্যদের সংরক্ষক ভীম, কাজেই আমাদের জয় নিশ্চিত। কুরুপক্ষে সৈন্য সংখ্যা পাণ্ডবদের তুলনায় অনেক বেশী হলেও তাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য  ছিল ধর্মের বিরূদ্ধাচরণ, কাজেই তার মনে জয়ের ব্যাপারে সর্বদাই একটি সংশয় কাজ করেছে। 

এখন বিবেচন সত্র সমাপনান্তে প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয় :

প্রশ্নকর্তা -- বজরঙ্গ জী
প্রশ্ন - এরকম শোনা যায় কি যে তেরো বৎসর সম্পূর্ণ হওয়া নিয়ে মতভেদ ছিলো, পাণ্ডবরা কি অজ্ঞাতবাস সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ফিরে এসেছিলো?
উত্তর - কৌরবরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরকম বলেছিলো, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর প্রমুখরা এর বিরোধিতা করায় এটি মানা হয়নি।

প্রশ্নকর্তা - বজরঙ্গ জী
প্রশ্ন -ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ মান্য করতে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বার বার বিপদে পড়তে হয়েছিল, তাহলে বড়দের আদেশ কি মান্য করা উচিত?
উত্তর - বড়দের আদেশ সর্বদাই মান্য করা উচিত, এমনকি নিজের অনিষ্ট হলেও তা মানা উচিত। এই কারণেই যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজ বলা হয়।

 আর কোনো প্রশ্ন না থাকায় হরি সংকীর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের বিবেচন শেষ হয়।