विवेचन सारांश
ভগবান সবাইকে জানেন, কিন্তু তাঁকে কেউ জানে না

ID: 3804
बंगाली - বাংলা
শনিবার, 07 অক্টোবর 2023
অধ্যায় 7: জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
3/3 (শ্লোক 22-30)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিশারদ মাননীয় শ্রীনিবাস বর্ণেকর মহাশয়


প্রার্থনা, দীপ প্রজ্জ্বলন, গুরু বন্দনা, দেশ বন্দনার সাথে আজকের সত্রের শুভারম্ভ হলো।
 
আমাতে আসক্ত হয়ে যে নিজের আচরণে যোগ নিয়ে আসে-- সে আমাকে সম্পূর্ণ রূপে জানতে পারে। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ব্যাপারে ভগবান সপ্তম অধ্যায়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন যে এই জ্ঞান প্রাপ্ত করে, তার আর কোন কিছুই জানার প্রয়োজন পড়ে না। এই জ্ঞান প্রাপ্ত করার মতো, বোঝার মতো এবং তা নিজের জীবনে নিয়ে আসার মতো বিরল ব্যক্তিত্ব হাজারের মধ্যে একটি মেলে।
  জলের যে রসত্ব -- জলই তো রস-- এবং এই জলের কারণ সেই পরমাত্মা-- যিনি আমাদের অতি কাছের অথচ আমরা তাঁকে দেখতে পাই না... এর কারণ, জগৎ ঈশ্বরের তিন গুণময় মায়া দ্বারা আবৃত। এই ঢেকে রাখার কারণে আমরা ঈশ্বর প্রাপ্ত হতে পারি না । ভগবান বলেছেন... এ মায়া তাঁর ই রচিত। তবে, চারপ্রকার মানুষ ভগবত ভক্তিতে লীন হয়ে থাকে ।
  কিছু মানুষ সংকটে পড়ে ভগবানের শরণে আসে... কিছু মানুষ ভৌতিক উপাদান প্রাপ্তির জন্য ভগবান কে স্মরণ করে।কিন্তু, ভগবানের আসল ভক্ত তারাই যারা ভগবান কে জানার পরেও নিরন্তর তাঁর ধ্যান করে।
    ভগবান বলেছেন -- মানুষ আলাদা আলাদা কামনা পূরণের জন্য আলাদা আলাদা দেবতার পূজা করে। তবে, পরমপিতা পরমেশ্বর তো একজনই। তাঁরই অনেক রূপ। মানুষ বিভিন্ন দেবতাকে শ্রদ্ধাপূর্বক যে ভক্তি করে, সেই শ্রদ্ধা ও ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত।

7.22

স তয়া শ্রদ্ধয়া য়ুক্ত:(স্), তস্যয়ারাধনমীহতে ,
লভতে চ ততঃ(খ্)কামান্, ময়ৈব বিহিতান্হি তান্॥22॥

ওই (আমা দ্বারা দৃঢ়ীকৃত) শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে ওই ব্যক্তি (সকামভাবে) ওই দেবতার উপাসনা করে এবং তার কামনার পূরণও হয়। কিন্তু সেই কামনা-পূর্তি আমা কর্তৃকই বিহিত হয়ে থাকে।

ভগবান বলেছেন --যে ভক্ত শ্রদ্ধা সহকারে দেবতার আরাধনা করে, পূজা করে -- তা সে যেকোনো দেবতার আরাধনা করুক না কেন --- গণেশ, লক্ষ্মী বা নবদুর্গা -- তার মনে শ্রদ্ধা জাগ্রত করার জন্য কেবল পরমপিতা ই আছেন ।
    যে কোনো দেবতার আরাধনায় যে ফল প্রাপ্তি হয়, সেই ফল দাতা ও পরমপিতা পরমেশ্বর। উদাহরণ -- মা দুর্গার উপাসনা করে আমরা শক্তি প্রাপ্ত হই, বিঘ্ন বিনাশক গনেশ জী'র উপাসনায় বিঘ্ন দূর হয়। আমাদের মনে যে কামনা রেখে আমরা দেবতাদের পূজা- অর্চনা করি -- তা পূরণ করেন ভগবানই। অর্থাৎ দেবতাদের মাধ্যমে আমাদের মনোস্কামনা পূর্ণ করার ভগবান একজনই। সমস্ত দেবদেবী ভগবানের ই আলাদা আলাদা রূপ। ভৌতিক সুখের জন্য আমরা ভগবানের আরাধনা করি-- কিন্তু তা ক্ষনিকের। সেই সুখ আমরা পাই হয়তো তবে তা স্থায়ী নয়।

7.23

অন্তবত্তু ফলং(ন্)তেষাং(ন্), তদ্ভবত্যল্পমেধসাম্,
দেবান্ দেবয়জো য়ান্তি ,মদ্ভক্তা য়ান্তি মামপি॥23॥

কিন্তু সেই অল্পবুদ্ধি মানুষদের ওইসকল দেবতাদের আরাধনার ফল বিনাশশীল হয়ে থাকে। দেবতাদের পূজা করেন যাঁরা, তাঁরা দেবতাদের লাভ করেন আর আমার ভক্তগণ আমাকেই লাভ করেন।

    ভগবান বলেছেন -- এমন কোন ভৌতিক সুখ নেই যার আরম্ভ হয়েছে অথচ শেষ হয়নি। ভৌতিক সুখের স্থায়িত্ব ক্ষনিকের। আলাদা আলাদা দেবতার আরাধনা করে ভৌতিক সুখ প্রাপ্ত করে যারা, তারা স্বল্পবুদ্ধি। এভাবে তাদের কামনা পূরণ হলেও তারা ভগবানের কাছে পৌঁছাতে পারে না, তাদের পরমানন্দ প্রাপ্তি হয় না ।
    সুখের বিপরীত ভাব হলো দুঃখ। কিন্তু, পরমানন্দের বিপরীতে কিছু নেই। পরমানন্দ মানে পরমপিতা পরমেশ্বর কে পাওয়ার আনন্দ। তাঁকে পাওয়া যায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে তাঁর আরাধনা করে। যারা এভাবে ভগবানের অর্চনা করে, তারা অবশ্যই পরমাত্মা কে প্রাপ্ত করে এবং পরমানন্দের অনুভূতি লাভ করে।    
  ভক্তিভাবে ভগবানের অর্চনা করতে হয়। একবার ভগবান কে পেয়ে গেলে আর কোন বস্তুর কামনা থাকে না।
    এই সংসারে আমরা মোহবন্ধ হয়ে রয়েছি -- তাই পরমাত্মা কে জানতে পারি না, জানার চেষ্টাও করি না। ছোট ছোট চাওয়া -পাওয়া নিয়েই পড়ে আছি। ভগবান বলেছেন... যে আমাকে জানে না, সে নিজের আশা, আকাঙ্খা , কামনার বাইরে আসতে পারে না।একটা বস্তু পেয়ে আবার অন্য বস্তু পাওয়ার আকাঙ্খা জাগ্রত হয়।
  আশা মানুষ কে ছাড়ে না -- যে এতে বদ্ধ হয়ে যায় -- সে কেবল আশার পিছনে দৌড়াতে থাকে। নিজের অবস্থানে আটকে থাকে। যদি তার আশা ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলেও সে পঙ্গুর মতো হয়ে যায়। ভগবান প্রাপ্তির ইচ্ছা যে প্রেম ও শ্রদ্ধার সাথে করে ও সাংসারিক মোহে ছোট ছোট বস্তুর কামনা করে না -- ভগবান বলেছেন... সে ই আমাকে প্রাপ্ত করতে পারে।

7.24

অব্যক্তং(ম্) ব্যক্তিমাপন্নং(ম্), মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ,
পরং(ম্) ভাবমজানন্তো, মমাব্যয়মনুত্তমম্॥24॥

অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার সর্বোৎকৃষ্ট পরমভাব না জেনে অব্যক্ত (মন-ইন্দ্রিয়াদির অতীত) আমাকে, সচ্চিদানন্দময় পরমাত্মাকে, মানুষের ন্যায় শরীর ধারণকারী বলে মনে করে থাকে।

    এই শ্লোকে ভগবান পুনরায় নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেন... আমি মানুষ রূপে অবতীর্ণ হয়েছি-- তাই অজ্ঞানী মানুষ আমাকে তাদের মতো ই মানুষ ভাবে।
    ভগবান কখনো মাঠে গোরু চরিয়েছেন, কখনো অর্জুনের রথের চালক হয়েছেন আবার কখনো সুদর্শন চক্র ধারণ করেছেন। কিন্তু তাঁকে সামান্য মানুষ যারা ভাবে তারা অল্প বুদ্ধি ধরে ।
    ভগবান বলেছেন -- এইসব মানুষ আমার পরম ভাব কখনো জানতে পারবে না। ব্যক্তিভাব নিয়ে ভগবান প্রকট হয়েছেন, কিন্তু তাঁর পরম রূপ ও আছে। ভগবান তো অব্যয় -- যিনি অবিনাশী, অব্যক্ত।
    ভগবান মানুষ রূপে এসেছেন কিন্তু, মানুষের সীমায় তিনি বন্ধ নন। তাঁর এই অসীম রূপ জানার চেষ্টা করতে হয়।
    মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র মর্যাদার সাথে কিভাবে মানুষ জীবন বাহিত করতে হয়, কিভাবে ধর্ম পালন করতে হয়... তা শিখিয়েছেন। আর একজন সাধারণ মানুষের জীবন কেমন হয় তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ করে দেখিয়েছেন। বড়ো বড়ো সন্ত,জ্ঞানী মহাপুরুষদের অতি সাধারণ দেখতে লাগে -- কিন্তু, তাঁদের অসামান্য ব্যক্তিত্ব সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে।

  জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন...
    কেউ অমৃত সাগরে ডুব দিয়েও ঘড়ার জলের কথা ভাবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরমাত্মা -- এটা জেনেও আমরা অন্য কথা ভাবি। ভগবান বলেছেন... আমার কোন পরিমাপ নেই -- আমি অমাপ্য। তবুও লোকে আমাকে মাপার চেষ্টা করে। আমার আসল রূপ অব্যক্ত -- তবুও মানুষ আমার ব্যক্ত রূপকেই মান্য করে।ভগবানের মূর্তি পূজা করার সময় তাঁর অনন্ত রূপের পূজাও করা উচিৎ। যদি আমরা শুধু মূর্তির পূজা করি, তাহলে পরমাত্মার কাছে কিভাবে পৌঁছাবো? মূর্তিরূপ পরমপিতা পরমাত্মা কে জানার, বোঝার এক অবলম্বন মাত্র।

ভগবান বলেছেন -- আমি সবাই কে জানি, আমাকে কেউ জানে না।

7.25

নাহং(ম্)প্রকাশঃ(স্) সর্বস্য, যোগমায়াসমাবৃতঃ,
মূঢ়োsয়ং(ন্) নাভিজানাতি, লোকো মামজমব্যয়ম্॥25॥

নিজ যোগমায়ার দ্বারা আবৃত বলে আমি সকলের নিকট প্রকাশিত হই না, তাই এই সব মূঢ় ব্যক্তিগণ জন্মরাহিত অবিনাশী পরমেশ্বর আমাকে জানতে পারে না, অর্থাৎ আমাকে জন্ম-মরণশীল বলে মনে করে।

    শ্রী ভগবান বলেছেন.. আমি সকলের প্রত্যক্ষ হই না, আমার পরমভাব সকলে দেখতে পায় না। ভগবান অর্জুন কে নিজের বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছেন। তাঁর সেই রূপ সবাই দেখতে পায় না। শ্রী ভগবান নিজের যোগমায়া দ্বারা নিজেকে ঢেকে রেখেছেন।
    বাল্যাবস্থায় ভগবান একবার মাটি খেয়েছিলেন -- তাতে যশোদা মা রাগ করে কানহা কে মুখ খুলে দেখাতে বলেছিলেন। বালক কৃষ্ণ মুখ খুললে মা তাঁর মুখের ভিতর সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড দেখতে পেলেন। কিন্তু ভগবান তখনই মায়া দ্বারা মা যশোদা কে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন -- কারণ, ভগবান চাননি মা তাঁর পূজা করুন।
    এই যোগমায়া দিয়ে ঢেকে রাখার জন্য সব মানুষ মূঢ় এবং অজ্ঞান হয়ে আছে। এই কারণে সম্পূর্ণ প্রাণী সমুদয় সেই অজাত, অবিনাশী, পরমাত্ম তত্ত্বের স্বরূপ জানে না। আমরা ভগবান কে জানি না, কিন্তু ভগবান আমাদের ভালো ভাবে জানেন।

7.26

বেদাহং(ম্) সমতীতানি , বর্তামানানি চার্জুন,
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি , মাং(ম্) তু বেদ ন কশ্চন॥26॥

হে অর্জুন! যারা অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে, সেই সকল প্রাণীকে আমি জানি। কিন্তু আমাকে (ভক্ত ব্যতীত) কেউই জানে না।

   শ্রী ভগবান বলেছেন -- হে অর্জুন! যা অতীত কালে হয়ে গেছে, যা বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যত কালে যা হবে সেইসব প্রাণীদের সবকিছু আমি জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না।
  Reflected glass আসলে mercury glass -- চশমায় এই glass ব্যবহার করা হয়। এই চশমা পরলে বাইরের কেউ তার চোখ দেখতে পায় না, কিন্তু সে বাইরের সবকিছু দেখে। এরূপে ভগবান ও সবকিছু দেখেন, আমরা ভগবান কে দেখি না।
    এখানে আরেকটা উপযুক্ত উদাহরণ দেওয়া যায় দুই বন্ধু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করতে এসেছে কিন্তু, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না -- কারণ, মাঝখানে একটা দেওয়াল আছে একজন দেওয়ালের ওপারে অপরজন এপারে। একই জায়গায় দুজনে থাকা সত্ত্বেও কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আমাদের অবস্থাও এইরকম। ভগবান আমাদের কাছে, একেবারে অন্তরে রয়েছেন.. কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাই না -- কারণ, আমাদের সামনে অজ্ঞানতার দেওয়াল রয়েছে।
    যা কিছু ঘটে গেছে, যা কিছু ঘটে চলেছে এবং ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে তা ও ভগবানের জানা -- এ কি করে সম্ভব?
    মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের দেওয়া একটা উদাহরণ দিয়ে এটা বোঝানো যায়। আইনস্টাইন বলেছিলেন -- কল্পনা করা যাক.. একটা বিশাল লম্বা ট্রেন... সেটা এতটাই লম্বা যে গার্ড ড্রাইভার কে সবুজ সিগন্যাল দিতে চায়.. সেই সিগন্যাল ড্রাইভারের কাছে পৌঁছাতে একমাস লেগে যাবে। আলোর গতিবেগ আমরা জানি প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। মেনে নিন ভগবান মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছেন সেখান থেকে দু'দিকেই দেখা যায়। যখনই গার্ড সবুজ লাইট জ্বালালো, ভগবান বুঝে গেলেন যে ড্রাইভার একমাস পরে সেই লাইট দেখতে পারে। আলোর চেয়েও বেশি গতিসম্পন্ন হলো কাল। ভগবান ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান কে জানেন। কারণ, ভগবান কালের ও রূপ -- একথা ভগবান নিজেই দশম অধ্যায়ে বলেছেন। ভগবান সবকিছু জানেন -- আমরা কিছু জানি না। কারণ, আমরা মায়ার আবরণে ঢাকা।
    এই না জানার আরেকটা কারণ হলো প্রাকৃতিক গুণ, দোষ। প্রকৃতি থেকে আমরা সত্ত্ব,রজো ও তমোগুণ প্রাপ্ত করি। এই তিন গুণের প্রভাবে মানুষের আলাদা আলাদা ভাব উৎপন্ন হয়। এই কারণে ও আমরা ঈশ্বর কে জানতে পারি না।

7.27

ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন , দ্বন্দ্বমোহেন ভারত,
সর্বভূতানি সম্মোহং (ম্), সর্গে য়ান্তি পরন্তপ॥27॥

হে ভরতবংশোদ্ভব পরন্তপ ! ইচ্ছা (আকাঙ্ক্ষা) এবং দ্বেষ হতে উৎপন্ন দ্বন্দ্ব-মোহ দ্বারা মোহিত সমস্ত প্রাণী অনাদিকাল থেকে জগতে হতজ্ঞান অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

  ভগবান বলেছেন ইচ্ছা এবং দ্বেষ এই দুই ভাবনা সর্বদা মনে জাগতে থাকে। কোন বস্তু লাভ করার ইচ্ছা মনে জাগ্রত হয় এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ ভাব ও মনেই জন্ম নেয়। এই দুই ভাব আমাদের সাথে নিত্য চলে। এর কারণে মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়, শীত- উষ্ণ ইত্যাদি সব দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলে আমাদের ভিতরে মোহ তৈরি হয়। এই অজ্ঞান রূপ মোহ আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।
  যদি কোনো ব্যক্তি সম্মোহিত হয়ে থাকে -- সে নিজে বুঝতে পারে না সে কি করছে, কেন করছে। তাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়, সে তাই করে।এই মোহ আর দ্বন্দ্বের কারণে আমরা এভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। এজন্য, ভগবানের অতি নিকটে থেকেও আমরা ভগবান কে দেখতে পাই না। সংসারে ডুবে থেকে পরমাত্মা কে জানতে পারি না। পরমাত্মা তো আমাদের ভিতরে ই রয়েছেন -- তবুও তাঁকে চিনি না। কিন্তু কিছু ভাগ্যবান পরমাত্মা কে জানেন ।

7.28

য়েষাং(ম্) ত্বন্তগতং(ম্) পাপং(ঞ্), জনানাং(ম্) পুণ্যকর্মণাম্,
তে দ্বন্দ্বমোহনির্মুক্তা, ভজন্তে মাং(ম্) দৃঢ়ব্রতাঃ॥28॥

কিন্তু যে পুণ্যকর্মা ব্যক্তিদের পাপ বিনষ্ট হয়েছে, সেই দ্বন্দ্ব- মোহরহিত দৃঢ় ব্রত ব্যক্তিগণ আমার ভজনা করেন।

   ভগবান বলেছেন আমার কিছু ভক্ত অত্যন্ত দৃঢ়নিশ্চয়।তারা অটল সংকল্প। অন্য কোন আকর্ষণে তারা বিচলিত হয় না। তারা কেবল পরমাত্মা কে ই চায়।আমরা জীবনে কি চাই -- আমাদের লক্ষ্য কি, তা যদি সুনিশ্চিত করে নেওয়া যায় এবং নিজের লক্ষ্য প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে চলা যায় অন্য কোন আকর্ষণ উপেক্ষা করে .. সেটা হলো দৃঢ় নিশ্চয়। এরূপ দৃঢ়নিশ্চয় ব্যক্তি সকল দ্বন্দ্ব, মোহ এবং আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। নিষ্কাম ভাবে ভালো কর্ম করে যে, তার দ্বারাই এটা সম্ভব হয়।
    নিষ্কাম কর্ম... নিজের জন্য কোন আকাঙ্খা না করে... যেমন ভারত মা কে বিশ্বের গুরুর পদে দেখতে চাওয়া এবং তার জন্য চেষ্টা করা। এতে যদি কিছু পাপ কাজ করতে হয়... তাহলেও তা করতে হয় । ভগবান বলেছেন -- এরূপ নিষ্কাম ভাবে যে আমার পূজা করে, সে আমাকে প্রাপ্ত করে।

7.29

জরামরণমোক্ষায় , মামাশ্রিত্য য়তন্তি য়ে ,
তে ব্রহ্ম তদ্বিদুঃ(খ্) কৃৎস্নং(ম্), অধ্যাত্ম(ঙ্) কর্ম চাখিলম্॥29॥

বৃদ্ধাবস্থা এবং মরণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য যাঁরা আমার শরণাগত হয়ে প্রযত্ন করেন, তাঁরা সেই সনাতন ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যায় বিষয় এবং সম্পূর্ণ কর্মতত্ত্ব অবগত হন।

  শ্রী ভগবান বলেছেন... এরূপ খাঁটি ভক্ত পরমতত্ত্ব জানেন। এরকম ভক্তের পরিপূর্ণ আত্মজ্ঞান প্রাপ্তি হয়। আত্মজ্ঞানই সর্বোচ্চ জ্ঞান। যে নিরন্তর আত্মজ্ঞানে থাকে... সে ই প্রকৃত জ্ঞানী -- আর কিছু জানার আবশ্যকতা নেই তার।
  আমাকে আশ্রয় করে, আমাতে আসক্ত হয়ে যে যোগাচারণ করে, সে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। মোক্ষ অর্থ হলো নিজেকে জানা। যার আত্মজ্ঞান প্রাপ্তি হয়েছে, তার আর জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। সে জানে যে সে শুদ্ধ আত্ম- তত্ত্ব। সে জন্ম- মরণের বন্ধন মুক্ত -- মানে, সে শরীরে থেকেও শরীরের ভাব মুক্ত হয়ে যায় ।

7.30

সাধিভূতাধিদৈবং(ম্) মাং(ম্), সাধিয়জ্ঞং(ঞ্) চ য়ে বিদুঃ,
প্রয়াণকালেsপি চ মাং(ন্), তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ॥30॥

যেসব মানুষ অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞসহ আমাকে জানেন, তাঁরা যুক্তচিত্ত হওয়ায় মৃত্যুকালেও আমাকে জানতে পারেন অর্থাৎ আমাকেই প্রাপ্ত হন।

  শ্রী ভগবান বলেছেন এরূপ ভক্ত অভিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞ কি তা জানে। অধ্যাত্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত।ব্রহ্ম কে ও সে জানে। এরূপ ভক্তের সামনে যখন মৃত্যু আসে-- তখন সে সবকিছুই জেনে গেছে। ভগবান বলেছেন -- এরূপ ভক্ত সবকিছু জানার সাথে সাথে আমাকেও জানে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে জানা মানে পরমাত্মা কে জানা। শ্রীকৃষ্ণ ই পরমাত্মা। শ্রীমদভগবদগীতা হলো শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত শাস্ত্র।

  ভগবান শব্দের অর্থ :-
  ধর্ম, অর্থ, যশ, শ্রী, জ্ঞান এবং বৈরাগ্য -- এই ছয়টি বিষয় যাঁর মধ্যে বর্তমান.. তিনি ভগবান... আবার এই ছয় গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি এতে আবদ্ধ নন।
  সামান্য জ্ঞান প্রাপ্ত করে মূঢ় মানুষ নিজেকে অত্যন্ত জ্ঞানী ভাবে, কিছু ধন উপার্জন করে মানুষ নিজেকে ধনী ভাবে। কিন্তু এ সমস্ত থেকেও যিনি বিমুক্ত থাকেন, তিনি ভগবান।

  এই অধ্যায়ের নাম জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ।
  সমগ্র জ্ঞানের অনুভূতি হলো জ্ঞান। বিজ্ঞানের দুটি অর্থ -- প্রথম টি হলো... সংসারের জ্ঞান, প্রপঞ্চ জ্ঞান। এবং দ্বিতীয় টি হলো --আত্মজ্ঞান। এই অধ্যায়ে ভগবান জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিষয়ে বলেছেন।
  ভগবান ভক্তির তীব্রতা দেখেন। শ্রদ্ধাপূর্বক, প্রেমপূর্বক ভগবানের ধ্যান করে যে ভক্ত সে অবশ্যই তাঁকে প্রাপ্ত করে।

::প্রশ্নোত্তর পর্ব::
প্রশ্নকর্তা: হরি কিশোর ভাইয়া
প্রশ্ন :- ভগবান রামচন্দ্র ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই অবতার। কিন্তু রামচন্দ্র কখনো বলেন নি আমাকে ভজনা কর - যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -- আমার পূজা কর... এটা কেন?
উত্তর :- শ্রী রামচন্দ্র এবং শ্রী কৃষ্ণ দুজনেই অবতার। অবতারের অর্থ হলো মর্ত্যে প্রকট হওয়া। ভগবান রামচন্দ্র নিজেকে মর্যাদা পুরুষোত্তম রূপে দেখিয়েছেন -- কিভাবে মানুষ ধর্ম পালন করবে। এটা দেখানোর জন্য প্রভু রাম নিজে মানুষের মর্যাদায় জীবন কাটিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত লীলা প্রকাশ করেছেন.. এজন্য ওঁনাকে পূর্ণ অবতার বলা হয়। ভগবান রাম ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আলাদা নন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -- যদি তোমরা আমাকে দেবতা রূপে পূজা কর... তাহলে আর এগোতে পারবে না । আমাকে পেতে হলে ধ্যানের মধ্যে আমাকে আনতে হবে। আসলে সমস্ত দেবদেবী ভগবানের ই স্বরূপ।

প্রশ্নকর্তা :- অপর্ণা দিদি
প্রশ্ন : মোক্ষের অর্থ হলো জন্ম -মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু, আজ আপনি অন্য কিছু বললেন। দুঃখের কারণ তো এই শরীর ই?
উত্তর :- মোক্ষ মানে জন্ম -মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি। বন্ধনের কারণ ও শরীর। আমিই শরীর -- এই ভাব আমাদের বন্ধন দেয়। এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলে আমরা মুক্ত হয়ে যাই। শরীর তৈরি হয়, কিন্তু আত্মা থেকে যায়। দেহাত্ম বুদ্ধি -- অর্থাৎ, আমিই দেহ -- এই ভাব আত্মা মেনে নেয়। এজন্যই আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভব হয়।

প্রশ্নকর্তা : মাধব ভাইয়া
প্রশ্ন : আগের জন্মের জ্ঞান জমা থাকে। আমরা বর্তমান জন্মে জ্ঞান প্রাপ্ত করতে থাকি। তাহলে আগের জন্মের জ্ঞান কোথায় জমা থাকে?
উত্তর :- এই জ্ঞান কোথাও জমা থাকে না। ভগবান যেমন আমাদের স্মরণ শক্তি দিয়েছেন -- তেমন বিস্মরণ শক্তি ও দিয়েছেন। তার ফলে আমরা আগের জন্মের কথা ভুলে যাই।

প্রশ্নকর্তা : গায়ত্রী দিদি 
প্রশ্ন : - শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব পুরোপুরি ভগবানে আত্মলীন হয়ে গিয়েছিলেন। উনি যখন শরীর ত্যাগ করেছেন -- তাহলে কি উনি পুনর্জন্ম নিয়েছেন? যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে কি উনি আগের জন্মের কথা বিস্মৃত হয়ে যাবেন?
উত্তর :- ইতিহাস অনুসারে রামচন্দ্র আগে জন্ম নিয়েছেন, পরে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিয়েছেন। দুজনেই তো একই ছিলেন -- তো এতে কি কিছু আলাদা হয়েছে?
  স্মরণ ও বিস্মরণ সাধারণ মানুষের জন্য হয়। ঈশ্বরের জন্য নয়।ভগবান নিজেই বলেছেন... কোন সময়ে, বিশেষ কোন কাজের জন্য ওঁনাকে সংসারে অবতীর্ণ হতে হয়। জন্ম ও মৃত্যু আমাদের হাতে নেই -- তা পরমাত্মার হাতে ।

প্রার্থনা ও হনুমান চালিসা পাঠের পরে বিবেচন সত্র সমাপন হলো।