विवेचन सारांश
অমর যোগবিদ্যার গোপন জ্ঞান
সুমধুর প্রার্থনা, দীপ প্রজ্জ্বলন এবং গুরু বন্দনার সাথে আজকের বিবেচন সত্র আরম্ভ হলো। যে মা লক্ষ্মী সারাজীবন শ্রীবিষ্ণুর চরণ-সেবা করেছেন, সেই ভগবতী লক্ষ্মী দেবীর ও শ্রীমদভগবদগীতার গুহ্য জ্ঞান প্রাপ্ত হয়নি। শ্রীমদভগবদগীতার গুহ্য জ্ঞান প্রাপ্ত করেছিলেন অর্জুন। সনকাদি ঋষি গণ তপস্যা দ্বারা যা প্রাপ্ত করতে পারেননি... সেই জ্ঞান প্রাপ্ত করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন অর্জুন। এবং অর্জুনের মাধ্যমে আমরাও সেই গুহ্য জ্ঞানের ভাগ পাচ্ছি। এই ধরনের সৌভাগ্যের কাছে সমস্ত শুভ কাজ, উৎসব এবং শুভ মূহুর্তরা নিষ্প্রভ হয়ে যায়.... এই ঐশ্বরিক জ্ঞান গ্রহণ করা এবং জীবনে তা নিয়ে আসার এটাই সবচেয়ে বড়ো সুযোগ।
যখন শ্রীভগবান অর্জুন কে এই দিব্য জ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন, তখনই বলে দিলেন যে তিনি এটা নতুন কিছু বলছেন না... বরং এই জ্ঞান অনন্তকাল ধরে চলছে।
এই পূণ্য প্রবাহ ; এই যোগের জ্ঞান কত প্রাচীন তা এই অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই ভগবান বলে দিয়েছেন।
যখন শ্রীভগবান অর্জুন কে এই দিব্য জ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন, তখনই বলে দিলেন যে তিনি এটা নতুন কিছু বলছেন না... বরং এই জ্ঞান অনন্তকাল ধরে চলছে।
এই পূণ্য প্রবাহ ; এই যোগের জ্ঞান কত প্রাচীন তা এই অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই ভগবান বলে দিয়েছেন।
4.1
শ্রীভগবানুবাচ
ইমং(ব্ঁ) বিবস্বতে য়োগং(ম), প্রোক্তবানহমব্যয়ম্ ।
বিবস্বান্মনবে প্রাহ , মনুরিক্ষ্বাকবেऽব্রবীৎ॥4.1॥
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন—এই অবিনাশী যোগ আমি সূর্যকে বলেছিলাম ; সূর্য তাঁর পুত্র বৈবস্বত মনুকে, মনু তাঁর পুত্র রাজা ইক্ষ্বাকুকে এটি বলেছিলেন।
শ্রীভগবান বলেছেন... এই দিব্যজ্ঞান আমি সর্বপ্রথম বিবস্বান্ অর্থাৎ, সূর্যদেব কে ---(যিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের আদি, যিনি নবগ্রহকে প্রকাশ করেন ; শক্তি প্রদান করেন) দিয়েছি। বিবস্বান নিজের পুত্র বৈবস্বৎ মনু কে এই জ্ঞান প্রদান করেছিলেন।
এবং(ম্) পরম্পরাপ্রাপ্তম্ , ইমং(ম্) রাজর্ষয়ো বিদুঃ।
স কালেনেহ মহতা, যোগো নষ্টঃ ( ফ্) পরন্তপ ꠱2꠱
হে পরন্তপ অর্জুন ! এইভাবে পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ জেনেছিলেন। কিন্তু তার পরে এই যোগ দীর্ঘকালের ব্যবধানে পৃথিবী লোক হতে প্রায় বিনষ্ট হয়েছে।
শ্রীভগবান এখানে অর্জুন কে পরন্তপ নামে সম্বোধন করেছেন। 'পরন্তপ' অর্থ হলো -- যিনি পরম তপস্বী। তপস্বীর অর্থ হলো কোন বিশেষ কারণে নিজেকে উত্তপ্ত করেন যিনি। ধনুর্বিদ্যা প্রাপ্ত করার জন্য অর্জুন যেভাবে কঠিন তপস্যা করেছেন.... তাই তিনি পরন্তপ।
তপস্যা মানে শুধু বনে গিয়ে কোন গাছের তলায় বসে বা দাঁড়িয়ে ভগবানের নাম জপ করা নয় ; উপবাস অথবা জল পান করা বন্ধ করে দেওয়া নয়। এরকম তপস্যা ছাড়াও কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে নিজেকে তপ্ত করাও তপস্যা। অর্জুন সেরকমই একজন পরম তপস্বী। শ্রী ভগবান অর্জুন কে বললেন --- পরম্পরায় প্রাপ্ত এই কর্মযোগ রাজির্ষগণ জানতেন এবং সেই জ্ঞান বিদু নামক রাজা অবধি পৌঁছেছিল। কিন্তু, কালের প্রবাহে কিছু সময় পরে তা হারিয়ে গেছে। যতদিন রাজর্ষিরা ছিলেন, ততদিন এই জ্ঞান অক্ষুণ্ণ ছিল ; কিন্তু যখন থেকে ভোগে লিপ্ত হওয়া শুরু হয়েছে.... তাদের জীবন থেকে যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। যোগ সম্পূর্ণভাবে কখনো নষ্ট হয় না ; কিন্তু সেই রাজাদের সময় থেকে এই যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে এই পরম্পরা খণ্ডিত হয়েছে ; এই জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে।
এই কথার মধ্যে এক সুন্দর সংকেত দিয়েছেন শ্রীভগবান। তিনি সর্বপ্রথম সূর্যদেব কে এই জ্ঞান প্রদান করেছেন -- এটা কেন বলেছেন ? যোগের জ্ঞান অতটাই পুরাতন, যত পুরাতন আমাদের সূর্যদেব। যখন পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টি হয়নি -- তখন থেকে এই যোগ পরম্পরা চলছে... কিন্তু, সময়ের সাথে এই যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এই যোগ লুপ্ত হওয়ার অন্য কারণ ও হতে পারে। যেমন - নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার একসময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক মাস ধরে সেই আগুন জ্বলেছিল। সেখানে হাতে লেখা কয়েক কোটি অমূল্য গ্রন্থ ছিল। আমাদের অনেক জ্ঞান এভাবেও নষ্ট হয়ে গেছে।
আমাদের যোগশাস্ত্রে কতরকম যোগাসনের কথা বলা হয়েছে? ভগবান মহাদেব কে আদিযোগী বলা হয়। তিনি মাতা পার্বতী কে এই যোগের উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছেন --- এই সংসারে যত সংখ্যক যোনি আছে, জীব আছে ; আমাদের পরম্পরায় যোগাসন সংখ্যাও তত। আমাদের পরম্পরাতে চুরাশি লক্ষ যোনি আছে. …. অর্থাৎ, চুরাশি লক্ষ যোগাসন! কিন্তু আমাদের দুটি গ্রন্থ কেবল উদ্ধার করা গেছে -- "*ঘেরণ্ডসংহিতা*" এবং *"হঠযোগ প্রদীপিকা* " এগুলো নাথ পরম্পরা থেকে প্রাপ্ত গ্রন্থ। এই দুই গ্রন্থ থেকে মাত্র বত্রিশটি যোগাসন পাওয়া গেছে। পূর্ব শতাব্দীতে আদরণীয় বি. কে. এস আয়েঙ্গার জি অনেক পুরানো গ্রন্থ খুঁজে খুঁজে এবং নিজের প্রতিভা দ্বারা মোটামুটি দুইশো যোগাসনের কথা বলে গেছেন। বর্তমানে আমাদের কাছে দুশো পঞ্চাশ রকম যোগাসন আছে। জ্ঞানের একটি পরম্পরা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে ।
বর্তমানে আমাদের দেশে যোগাসন কে স্পোর্টস এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং বিগত পাঁচ বছরে এটা নিয়ে অনেক কাজ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের গীতা জয়ন্তী মহোৎসব অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় যোগর্ষি রামদেব মহারাজ সংগমনের এ এসেছিলেন ; তাঁর সঙ্গে সরসঙ্ঘ চালক শ্রীমোহন ভাগবত জী ও ছিলেন। ওই দুজনের সমক্ষে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল যে যোগাসন কে স্পোর্টস এর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। নাহলে অন্যান্য দেশ যারা যোগাসন করা শুরু করেছে এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারাই এটাকে বিদেশের স্পোর্টস এ প্রতিষ্ঠা করে দেবে এবং বহু নিয়ম তৈরি করবে । আমাদের যোগাসন করার জন্য ওদের তৈরি নিয়ম মানতে হবে। এর চেয়ে ভালো আমরা যোগাসন এর কাজ করবো।
সমস্যা দেখা দেয় যে যোগে কোন প্রতিযোগিতা হতে পারে কি না। বাস্তবিক এটাই যে যম বা নিয়মে কি কোন কম্পিটিশন হতে পারে ? প্রাণায়ামে কিভাবে প্রতিযোগিতা হবে? প্রত্যাহার, ধারণা বা ধ্যান কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়, কিন্তু যোগাসনে প্রতিযোগিতা হতে পারে। এই ব্যাপারে সবাই সহমত পোষণ করেন এবং এর পরে খুব তাড়াতাড়ি যোগাসন কে খেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর আগে দিল্লিতে "যোগাসন ভারত" নামে একটি সংস্থা স্থাপন করা হয়েছিল। যখন যোগাসনের কঠিনতম স্তর নির্ধারণ করা শুরু হলো, তখন দেখা গেল যে আড়াইশো আসন পূর্ণ করা সম্ভব নয়। কারণ এর মধ্যে অনেক আসন আছে, যেগুলোর প্রতিযোগিতা করা যায় না । যেমন - পদ্মাসন বা শবাসন। বহু স্কুলের যোগাসন করা ছাত্রদের থেকে আরও নতুন নতুন যোগাসনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে থেকে পঁচাশি টি যোগাসন স্বামী রামদেব মহারাজ এবং বেঙ্গালুরু এস. বি. সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ড. এইচ. আর. নাগেন্দ্র জি আগের যোগাসনের সাথে যুক্ত করেছেন। প্রথমে এই যোগ রাষ্ট্রীয় স্তরে খেলা হয়েছে, তারপর "খেলো ইন্ডিয়া" তে খেলা হয়েছে, ন্যাশনাল গেমসে খেলা হয়েছে এবং এই মাসে অলিম্পিক অ্যাশোশিয়েসন অফ ইন্ডিয়ার অধ্যক্ষ পি. টি. উষা জি অলিম্পিক কাউন্সিল অফ এশিয়া কে চিঠি লিখেছেন যেন এই খেলা কে এশিয়ান গেমসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে এশিয়ান অলিম্পিক কাউন্সিলের অধ্যক্ষ রাজা রণধীর সিং তখনই সেটার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। অনেক সদগুরু এই লুপ্তপ্রায় যোগাসন কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন কিন্তু মধ্যে মধ্যে এ-র অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে।
সূর্যদেব কে সবচেয়ে আগে এই জ্ঞান প্রদান করেছেন শ্রীভগবান, কারণ সূর্যদেব হলেন আলোর প্রতীক। যেখানে আলোর প্রকাশ, সেখান থেকে ভগবত তত্ত্বের দর্শন শুরু। আলোর এই প্রকাশ কে শ্রীভগবানের এক রূপ বলা হয়েছে। সব ধর্মেই আলো কে ঈশ্বরের প্রতীক মানা হয়। এভাবেই এই পরম্পরা স্বয়ং ভগবান দ্বারা শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজা বিদুর পরে যে রাজাদের কাছে পৌঁছে ছিল, তাঁদের দেহান্তর প্রাপ্তি হয়ে গেছে।
রাজর্ষি মানে এই নয় যে রাজা ছিলেন, ঋষি হয়ে গেছেন। মিথিলার রাজা ছিলেন জনক... কিন্তু তিনি ঋষির মতো জীবন যাপন করতেন ; তাই তিনি রাজর্ষি ছিলেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, যিনি আসল ঋষি তিনি রাজাও বটে। কারণ, যিনি রাজা তাঁর আর আলাদা কোন ইচ্ছা থাকে না, বরং তিনি যোগমার্গ অনুযায়ী চলেন, নিজেকে সর্বদা প্রসন্ন তথা সন্তুষ্ট রাখেন। সেই রাজা থেকে কি লাভ যে নিজে ভিখারি এবং প্রজার কাছে ভিক্ষা চায়...?? এজন্যই আমাদের দেশে সন্ন্যাসীদের মহারাজ বলা হয়। তাঁদের লক্ষ্য কেবলমাত্র মানুষের কল্যাণ কার্য।
যখন সম্রাট আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ অভিযানে এসেছিলেন... তাঁর দেশের প্রথা অনুযায়ী তাঁর সৈনিকরা গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতো যে তাদের কোন রাজা আছেন কি না.... একটি গ্রামের গ্রামবাসীরা জানালো যে অবশ্যই তাদের রাজা আছেন এবং তিনি নদীর ধারে বসে আছেন। সম্রাটের সেনারা সেখানে গিয়ে দেখে একজন দিগম্বর সন্ন্যাসী বসে আছেন --তাঁর না আছে রাজকীয় আভূষণ, না আছে সৈন্য সামন্ত। সম্রাটের সেনারা আশ্চর্য হয়ে গ্রামবাসীদের বলল... এখানে তো রাজা নেই !! গ্রামবাসীরা শ্রদ্ধার সাথে উত্তর দিলে --- উনি রাজা নন, উনি মহারাজ। অগত্যা সম্রাটের সেনারা সেই মহারাজ কে বলল... আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে ; আমাদের সম্রাটের হুকুম... তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান। মহারাজ শান্ত ভাবে বললেন ; আমার তো প্রয়োজন নেই -- যার প্রয়োজন সে এখানে আসবে। মহারাজ কে সাথে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়ে সেনারা ফিরে গিয়ে সম্রাট কে ঘটনা জানালো। সম্রাট আলেকজান্ডার নিজে এলেন সেই ঘাটে, সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে।
সম্রাট জিজ্ঞাসা করলেন -- আপনি কিছু করেন না কেন ?
সন্ন্যাসী বললেন -- আমি কিছু করলে কি হবে ?
সম্রাট - আপনার ধন সম্পদ হবে ।
সন্ন্যাসী - তা দিয়ে কি হবে ?
সম্রাট - আপনার একটা ছাত হবে , যার ছায়ায় আপনি শান্তিতে থাকবেন ।
সন্ন্যাসী - বৃক্ষের ছায়াতেই তো বসে আছি । এজন্য অর্থের প্রয়োজন হয় না।
আলেকজান্ডার বললেন -- ধন বৃদ্ধি হলে আপনার আনন্দ বৃদ্ধি হবে ।
সন্ন্যাসী বললেন -- এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোথায় পাওয়া যায় ?
আলেকজান্ডার লজ্জিত হয়ে ফিরে গেলেন ।
একজন মানুষের মনে যখন বৈরাগ্য আসে, তখন সে সর্বস্ব ত্যাগ করে কেবলমাত্র কৌপীন পরে বেরিয়ে যায় ।
এমনই একজন সন্ন্যাসী বনে গিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন । শিষ্যরা দেখলো গুরুজির কেবলমাত্র দুটো কৌপীন আছে। একটা ধুয়ে দেন এবং অন্যটা পরেন। একটা ইঁদুর এসে একটা কৌপীন টুকরো করে দিয়ে গেল । গুরু তার শিষ্য কে বললেন সে কথা। শিষ্য গুরু কে পাঁচ - ছয়টা কৌপীন দিয়ে গেল। কিন্তু ইঁদুরের সংখ্যা ও বেড়ে গেল এবং মহানন্দে তারা সেগুলো দাঁত দিয়ে কাটতে লাগলো৷ শিষ্যরা পরামর্শ দিল বিড়াল পুষতে। গুরু বিড়াল পুষলেন। বিড়াল দুধ খাবে, তার জন্য একজন শিষ্য গরু দিয়ে গেল। এবার গরুর পিছনে কাজ বেড়ে গেল। গুরুজীর চার ঘন্টা সময় কেটে যায় গরুর পিছনে। কেউ পরামর্শ দিল... গরু দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলা রাখা উচিৎ। তাতে গুরুজী ধ্যান করার সময় পাবেন৷ সময়ের সাথে সেই মহিলার সাথে গুরুজীর বিবাহ হলো, বাচ্চা ও হলো। একটা কৌপীনের কারণে এতো রকম সমস্যা হয়ে শেষে ধ্যানই নষ্ট হয়ে গেল।
যোগ এভাবেই প্লাবিত হয়।
যে ভোগে লিপ্ত হয়; তার থেকে যোগ দূরে চলে যায়। ভোগের ধারা বাইরে বইতে থাকে। কিন্তু যখন যোগের ধারা বাইরের থেকে ভিতরে প্রবাহিত হয় এবং তা রাধা হয়ে যায়। যে অন্তর্যামী কে খোঁজা বন্ধ করে দেয়, তার জীবন থেকে যোগ নষ্ট হয়ে যায়। যারা কানে শুনতে পায় না, তাদের সভায় যদি গান গাওয়া হয়, তাহলে কি লাভ? তেমনই ভোগীদের সভায় যোগের কথা হতে পারে না। এভাবে যোগ নষ্ট হয়ে গেছে।
তপস্যা মানে শুধু বনে গিয়ে কোন গাছের তলায় বসে বা দাঁড়িয়ে ভগবানের নাম জপ করা নয় ; উপবাস অথবা জল পান করা বন্ধ করে দেওয়া নয়। এরকম তপস্যা ছাড়াও কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে নিজেকে তপ্ত করাও তপস্যা। অর্জুন সেরকমই একজন পরম তপস্বী। শ্রী ভগবান অর্জুন কে বললেন --- পরম্পরায় প্রাপ্ত এই কর্মযোগ রাজির্ষগণ জানতেন এবং সেই জ্ঞান বিদু নামক রাজা অবধি পৌঁছেছিল। কিন্তু, কালের প্রবাহে কিছু সময় পরে তা হারিয়ে গেছে। যতদিন রাজর্ষিরা ছিলেন, ততদিন এই জ্ঞান অক্ষুণ্ণ ছিল ; কিন্তু যখন থেকে ভোগে লিপ্ত হওয়া শুরু হয়েছে.... তাদের জীবন থেকে যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। যোগ সম্পূর্ণভাবে কখনো নষ্ট হয় না ; কিন্তু সেই রাজাদের সময় থেকে এই যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে এই পরম্পরা খণ্ডিত হয়েছে ; এই জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে।
এই কথার মধ্যে এক সুন্দর সংকেত দিয়েছেন শ্রীভগবান। তিনি সর্বপ্রথম সূর্যদেব কে এই জ্ঞান প্রদান করেছেন -- এটা কেন বলেছেন ? যোগের জ্ঞান অতটাই পুরাতন, যত পুরাতন আমাদের সূর্যদেব। যখন পৃথিবীতে মানুষের সৃষ্টি হয়নি -- তখন থেকে এই যোগ পরম্পরা চলছে... কিন্তু, সময়ের সাথে এই যোগ নষ্ট হয়ে গেছে। এই যোগ লুপ্ত হওয়ার অন্য কারণ ও হতে পারে। যেমন - নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার একসময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক মাস ধরে সেই আগুন জ্বলেছিল। সেখানে হাতে লেখা কয়েক কোটি অমূল্য গ্রন্থ ছিল। আমাদের অনেক জ্ঞান এভাবেও নষ্ট হয়ে গেছে।
আমাদের যোগশাস্ত্রে কতরকম যোগাসনের কথা বলা হয়েছে? ভগবান মহাদেব কে আদিযোগী বলা হয়। তিনি মাতা পার্বতী কে এই যোগের উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছেন --- এই সংসারে যত সংখ্যক যোনি আছে, জীব আছে ; আমাদের পরম্পরায় যোগাসন সংখ্যাও তত। আমাদের পরম্পরাতে চুরাশি লক্ষ যোনি আছে. …. অর্থাৎ, চুরাশি লক্ষ যোগাসন! কিন্তু আমাদের দুটি গ্রন্থ কেবল উদ্ধার করা গেছে -- "*ঘেরণ্ডসংহিতা*" এবং *"হঠযোগ প্রদীপিকা* " এগুলো নাথ পরম্পরা থেকে প্রাপ্ত গ্রন্থ। এই দুই গ্রন্থ থেকে মাত্র বত্রিশটি যোগাসন পাওয়া গেছে। পূর্ব শতাব্দীতে আদরণীয় বি. কে. এস আয়েঙ্গার জি অনেক পুরানো গ্রন্থ খুঁজে খুঁজে এবং নিজের প্রতিভা দ্বারা মোটামুটি দুইশো যোগাসনের কথা বলে গেছেন। বর্তমানে আমাদের কাছে দুশো পঞ্চাশ রকম যোগাসন আছে। জ্ঞানের একটি পরম্পরা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে ।
বর্তমানে আমাদের দেশে যোগাসন কে স্পোর্টস এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং বিগত পাঁচ বছরে এটা নিয়ে অনেক কাজ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের গীতা জয়ন্তী মহোৎসব অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় যোগর্ষি রামদেব মহারাজ সংগমনের এ এসেছিলেন ; তাঁর সঙ্গে সরসঙ্ঘ চালক শ্রীমোহন ভাগবত জী ও ছিলেন। ওই দুজনের সমক্ষে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল যে যোগাসন কে স্পোর্টস এর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। নাহলে অন্যান্য দেশ যারা যোগাসন করা শুরু করেছে এবং এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারাই এটাকে বিদেশের স্পোর্টস এ প্রতিষ্ঠা করে দেবে এবং বহু নিয়ম তৈরি করবে । আমাদের যোগাসন করার জন্য ওদের তৈরি নিয়ম মানতে হবে। এর চেয়ে ভালো আমরা যোগাসন এর কাজ করবো।
সমস্যা দেখা দেয় যে যোগে কোন প্রতিযোগিতা হতে পারে কি না। বাস্তবিক এটাই যে যম বা নিয়মে কি কোন কম্পিটিশন হতে পারে ? প্রাণায়ামে কিভাবে প্রতিযোগিতা হবে? প্রত্যাহার, ধারণা বা ধ্যান কোন প্রতিযোগিতার বিষয় নয়, কিন্তু যোগাসনে প্রতিযোগিতা হতে পারে। এই ব্যাপারে সবাই সহমত পোষণ করেন এবং এর পরে খুব তাড়াতাড়ি যোগাসন কে খেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর আগে দিল্লিতে "যোগাসন ভারত" নামে একটি সংস্থা স্থাপন করা হয়েছিল। যখন যোগাসনের কঠিনতম স্তর নির্ধারণ করা শুরু হলো, তখন দেখা গেল যে আড়াইশো আসন পূর্ণ করা সম্ভব নয়। কারণ এর মধ্যে অনেক আসন আছে, যেগুলোর প্রতিযোগিতা করা যায় না । যেমন - পদ্মাসন বা শবাসন। বহু স্কুলের যোগাসন করা ছাত্রদের থেকে আরও নতুন নতুন যোগাসনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে থেকে পঁচাশি টি যোগাসন স্বামী রামদেব মহারাজ এবং বেঙ্গালুরু এস. বি. সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ড. এইচ. আর. নাগেন্দ্র জি আগের যোগাসনের সাথে যুক্ত করেছেন। প্রথমে এই যোগ রাষ্ট্রীয় স্তরে খেলা হয়েছে, তারপর "খেলো ইন্ডিয়া" তে খেলা হয়েছে, ন্যাশনাল গেমসে খেলা হয়েছে এবং এই মাসে অলিম্পিক অ্যাশোশিয়েসন অফ ইন্ডিয়ার অধ্যক্ষ পি. টি. উষা জি অলিম্পিক কাউন্সিল অফ এশিয়া কে চিঠি লিখেছেন যেন এই খেলা কে এশিয়ান গেমসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমাদের সৌভাগ্য যে এশিয়ান অলিম্পিক কাউন্সিলের অধ্যক্ষ রাজা রণধীর সিং তখনই সেটার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। অনেক সদগুরু এই লুপ্তপ্রায় যোগাসন কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন কিন্তু মধ্যে মধ্যে এ-র অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে।
সূর্যদেব কে সবচেয়ে আগে এই জ্ঞান প্রদান করেছেন শ্রীভগবান, কারণ সূর্যদেব হলেন আলোর প্রতীক। যেখানে আলোর প্রকাশ, সেখান থেকে ভগবত তত্ত্বের দর্শন শুরু। আলোর এই প্রকাশ কে শ্রীভগবানের এক রূপ বলা হয়েছে। সব ধর্মেই আলো কে ঈশ্বরের প্রতীক মানা হয়। এভাবেই এই পরম্পরা স্বয়ং ভগবান দ্বারা শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজা বিদুর পরে যে রাজাদের কাছে পৌঁছে ছিল, তাঁদের দেহান্তর প্রাপ্তি হয়ে গেছে।
রাজর্ষি মানে এই নয় যে রাজা ছিলেন, ঋষি হয়ে গেছেন। মিথিলার রাজা ছিলেন জনক... কিন্তু তিনি ঋষির মতো জীবন যাপন করতেন ; তাই তিনি রাজর্ষি ছিলেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, যিনি আসল ঋষি তিনি রাজাও বটে। কারণ, যিনি রাজা তাঁর আর আলাদা কোন ইচ্ছা থাকে না, বরং তিনি যোগমার্গ অনুযায়ী চলেন, নিজেকে সর্বদা প্রসন্ন তথা সন্তুষ্ট রাখেন। সেই রাজা থেকে কি লাভ যে নিজে ভিখারি এবং প্রজার কাছে ভিক্ষা চায়...?? এজন্যই আমাদের দেশে সন্ন্যাসীদের মহারাজ বলা হয়। তাঁদের লক্ষ্য কেবলমাত্র মানুষের কল্যাণ কার্য।
যখন সম্রাট আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ অভিযানে এসেছিলেন... তাঁর দেশের প্রথা অনুযায়ী তাঁর সৈনিকরা গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতো যে তাদের কোন রাজা আছেন কি না.... একটি গ্রামের গ্রামবাসীরা জানালো যে অবশ্যই তাদের রাজা আছেন এবং তিনি নদীর ধারে বসে আছেন। সম্রাটের সেনারা সেখানে গিয়ে দেখে একজন দিগম্বর সন্ন্যাসী বসে আছেন --তাঁর না আছে রাজকীয় আভূষণ, না আছে সৈন্য সামন্ত। সম্রাটের সেনারা আশ্চর্য হয়ে গ্রামবাসীদের বলল... এখানে তো রাজা নেই !! গ্রামবাসীরা শ্রদ্ধার সাথে উত্তর দিলে --- উনি রাজা নন, উনি মহারাজ। অগত্যা সম্রাটের সেনারা সেই মহারাজ কে বলল... আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে ; আমাদের সম্রাটের হুকুম... তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান। মহারাজ শান্ত ভাবে বললেন ; আমার তো প্রয়োজন নেই -- যার প্রয়োজন সে এখানে আসবে। মহারাজ কে সাথে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়ে সেনারা ফিরে গিয়ে সম্রাট কে ঘটনা জানালো। সম্রাট আলেকজান্ডার নিজে এলেন সেই ঘাটে, সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে।
সম্রাট জিজ্ঞাসা করলেন -- আপনি কিছু করেন না কেন ?
সন্ন্যাসী বললেন -- আমি কিছু করলে কি হবে ?
সম্রাট - আপনার ধন সম্পদ হবে ।
সন্ন্যাসী - তা দিয়ে কি হবে ?
সম্রাট - আপনার একটা ছাত হবে , যার ছায়ায় আপনি শান্তিতে থাকবেন ।
সন্ন্যাসী - বৃক্ষের ছায়াতেই তো বসে আছি । এজন্য অর্থের প্রয়োজন হয় না।
আলেকজান্ডার বললেন -- ধন বৃদ্ধি হলে আপনার আনন্দ বৃদ্ধি হবে ।
সন্ন্যাসী বললেন -- এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোথায় পাওয়া যায় ?
আলেকজান্ডার লজ্জিত হয়ে ফিরে গেলেন ।
একজন মানুষের মনে যখন বৈরাগ্য আসে, তখন সে সর্বস্ব ত্যাগ করে কেবলমাত্র কৌপীন পরে বেরিয়ে যায় ।
এমনই একজন সন্ন্যাসী বনে গিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন । শিষ্যরা দেখলো গুরুজির কেবলমাত্র দুটো কৌপীন আছে। একটা ধুয়ে দেন এবং অন্যটা পরেন। একটা ইঁদুর এসে একটা কৌপীন টুকরো করে দিয়ে গেল । গুরু তার শিষ্য কে বললেন সে কথা। শিষ্য গুরু কে পাঁচ - ছয়টা কৌপীন দিয়ে গেল। কিন্তু ইঁদুরের সংখ্যা ও বেড়ে গেল এবং মহানন্দে তারা সেগুলো দাঁত দিয়ে কাটতে লাগলো৷ শিষ্যরা পরামর্শ দিল বিড়াল পুষতে। গুরু বিড়াল পুষলেন। বিড়াল দুধ খাবে, তার জন্য একজন শিষ্য গরু দিয়ে গেল। এবার গরুর পিছনে কাজ বেড়ে গেল। গুরুজীর চার ঘন্টা সময় কেটে যায় গরুর পিছনে। কেউ পরামর্শ দিল... গরু দেখাশোনা করার জন্য একজন মহিলা রাখা উচিৎ। তাতে গুরুজী ধ্যান করার সময় পাবেন৷ সময়ের সাথে সেই মহিলার সাথে গুরুজীর বিবাহ হলো, বাচ্চা ও হলো। একটা কৌপীনের কারণে এতো রকম সমস্যা হয়ে শেষে ধ্যানই নষ্ট হয়ে গেল।
যোগ এভাবেই প্লাবিত হয়।
স কালেনেহ মহতা য়োগো নষ্টঃ পরন্তপ ꠱4.2꠱
যে ভোগে লিপ্ত হয়; তার থেকে যোগ দূরে চলে যায়। ভোগের ধারা বাইরে বইতে থাকে। কিন্তু যখন যোগের ধারা বাইরের থেকে ভিতরে প্রবাহিত হয় এবং তা রাধা হয়ে যায়। যে অন্তর্যামী কে খোঁজা বন্ধ করে দেয়, তার জীবন থেকে যোগ নষ্ট হয়ে যায়। যারা কানে শুনতে পায় না, তাদের সভায় যদি গান গাওয়া হয়, তাহলে কি লাভ? তেমনই ভোগীদের সভায় যোগের কথা হতে পারে না। এভাবে যোগ নষ্ট হয়ে গেছে।
স এবায়ং(ম্) ময়া তেऽদ্য , যোগঃ(ফ্) প্রোক্তঃ(ফ্) পুরাতনঃ।
ভক্তোsসি মে সখা চেতি , রহস্যং (ম্) হ্যেতদুত্তমম্ ꠱3꠱
তুমি আমার ভক্ত ও প্রিয় সখা, সেইজন্য এই পুরাতন যোগ আজ আমি তোমাকে বললাম ; কারণ এটি অতি উত্তম রহস্য অর্থাৎ গোপনীয় বিষয়।
শ্রীভগবান অর্জুন কে বললেন -- হে অর্জুন! তুমি আমার ভক্ত এবং সখাও ; এজন্য আমি এই উচ্চতর রহস্য তোমাকে বলছি .... শুধু ভক্ত হলেই হবে না, সখা হওয়া ও আবশ্যক। আমরা তো ছোটবেলায় নিজের মনের কথা উজাড় করে বন্ধুকে বলে দিতাম এবং বন্ধুর বলা কোন কিছু সত্যি - মিথ্যা যাচাই না করে নিঃসংকোচে মেনেও নিতাম। বন্ধুর সঙ্গে থাকা মানে শত্রুর থেকে দূরে থাকা। আর এই বন্ধুত্ব যদি স্বয়ং ভগবানের সাথে হয়, তাহলে অন্তরের ব্যথা তাঁর কাছে বলতে কোন সংকোচও হবে না। আমাদের সাথে কিছু খারাপ হলেই আমরা ভগবানের সামনে গিয়ে কেঁদে ফেলি। একজন কখনও তার বন্ধুকে বলবে না... তুমি আমার সাথে এরকম কেন করলে ? বন্ধু যা ই করুক, তা স্বীকার করে নেওয়া যায়। ঈশ্বরের সখা হওয়ার অর্থ হলো তাঁর প্রতিটি আদেশ পালন করা। তাঁর প্রতি কথা হৃদয় থেকে মানতে হবে।
আমাদের জীবনে যতই প্রতিকূলতা আসুক, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস যেন কখনো কমে না যায়। হতে পারে ঈশ্বরের ইচ্ছা কিছু অন্যরকম, তাই তিনি আমাকে কিছুটা পিছনে ঠেলে দিলেন। অর্জুনের এই সখ্য ভাব ছিল, এবং শ্রী ভগবান ও বারবার তাঁকে সখা বলে ডেকেছেন। সখা হওয়া মানে সবচেয়ে কাছের তথা সবচেয়ে প্রিয় হওয়া।
অর্জুন যদি শুধু ভক্ত হতেন, তাহলে সবকিছু শুধু মেনে নিতেন। কিন্তু অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের সখাও ; তাই প্রশ্ন করার অধিকার ও অর্জুনের আছে। এরপর অর্জুন ভগবান কে প্রশ্ন করেছেন ---
আমাদের জীবনে যতই প্রতিকূলতা আসুক, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস যেন কখনো কমে না যায়। হতে পারে ঈশ্বরের ইচ্ছা কিছু অন্যরকম, তাই তিনি আমাকে কিছুটা পিছনে ঠেলে দিলেন। অর্জুনের এই সখ্য ভাব ছিল, এবং শ্রী ভগবান ও বারবার তাঁকে সখা বলে ডেকেছেন। সখা হওয়া মানে সবচেয়ে কাছের তথা সবচেয়ে প্রিয় হওয়া।
অর্জুন যদি শুধু ভক্ত হতেন, তাহলে সবকিছু শুধু মেনে নিতেন। কিন্তু অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের সখাও ; তাই প্রশ্ন করার অধিকার ও অর্জুনের আছে। এরপর অর্জুন ভগবান কে প্রশ্ন করেছেন ---
অর্জুন উবাচ
অপরং(ম্) ভবতো জন্ম , পরং(ঞ্) জন্ম বিবস্বতঃ।
কথমেতদ্বিজানীয়াং(ন্), ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি ꠱4꠱
অর্জুন বললেন-আপনার জন্ম তো এখন অর্থাৎ এই যুগে হয়েছে আর সূর্যের জন্ম তো বহু পূর্বে অর্থাৎ কল্পের আদিতে হয়েছে। তবে আমি কী করে বুঝব যে আপনিই কল্পের আদিতে এই যোগের কথা সূর্যকে বলেছিলেন ?
অর্জুন শ্রী ভগবান কে একটি প্রশ্ন করেছেন এবং এরকম প্রশ্ন তাঁকেই করা যায় যিনি আমাদের হৃদয়ের অতি কাছে রয়েছেন। অর্জুন বলেছেন --- আপনার জন্ম তো এখন হয়েছে আর সূর্য তো অতি পুরাতন কালের। সৃষ্টির আদিতে আপনি কিভাবে সূর্যদেব কে যোগ শেখালেন, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমাদের এই কথা বুঝতে হবে যে শ্রীভগবান যা কিছু বলছেন -- তা কৃষ্ণ বলছেন না। কৃষ্ণ সেখানে মাধ্যম হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে শ্রীমদ্ভাগবতগীতার মাধ্যম দ্বারা পরমপিতার পরম স্বর নির্গত হচ্ছে। সনাতন সত্য শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে। এটাই তো জীবনের অন্তিম উদ্দেশ্য যে আমরা যেন সনাতন সত্যের খোঁজ করি। এই সত্য অপরিবর্তিত।
একই সত্য ঘটনা কে আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ করে বিভিন্ন ব্যক্তি। এভাবেই আদালতে মোকদ্দমা চলে এবং বিচারক কে ঠায় বসে থাকতে হয় সত্য উন্মোচন করার জন্য। ধরুন, একজন মানুষ, যে কখনও সূর্যোদয় দেখেনি তাকে বোঝাতে হবে সূর্যোদয় কেমন ভাবে হয়.. কেউ বলবে ঠিক যেন লাল রঙের একটা বল উপরের দিকে উঠে এলো। সেই ব্যক্তি কিন্তু লাল রঙের বলের কথা ভেবে সূর্যের উদয় কেমন তা বুঝতে পারবে না... তার যে ছড়িয়ে পড়া রঙের ছটা .... চারপাশে অপরূপ উদ্ভাস... সেই সময়ের তাপমাত্রা... চারদিকের গাছপালার আলোকসজ্জা বা সকালে ফুটে ওঠা ফুলের সুগন্ধ ... তা কি শুধু শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব ? এটা সম্পূর্ণ নিজের অনুভবের বিষয়। একইভাবে অনুভব ই হলো জ্ঞান -- যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজে নিজে প্রাপ্ত করতে হয়। অন্য কেউ শব্দ দিয়ে তা হয়তো বুঝিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তার গভীরে নিয়ে যেতে পারে না। এজন্য শ্রী ভগবান বলেছেন যে তিনি সর্বপ্রথমে বিবস্বান কে এটা বলেছেন। এটাই সনাতন সত্য। কালকে যা সত্য ছিল, আজকেও তাই সত্য এবং আগামী তে ও সেটাই সত্য। চিরকালীন সত্য। সত্যের খোঁজ যোগমার্গ দ্বারাই সম্ভব ।
একই সত্য ঘটনা কে আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ করে বিভিন্ন ব্যক্তি। এভাবেই আদালতে মোকদ্দমা চলে এবং বিচারক কে ঠায় বসে থাকতে হয় সত্য উন্মোচন করার জন্য। ধরুন, একজন মানুষ, যে কখনও সূর্যোদয় দেখেনি তাকে বোঝাতে হবে সূর্যোদয় কেমন ভাবে হয়.. কেউ বলবে ঠিক যেন লাল রঙের একটা বল উপরের দিকে উঠে এলো। সেই ব্যক্তি কিন্তু লাল রঙের বলের কথা ভেবে সূর্যের উদয় কেমন তা বুঝতে পারবে না... তার যে ছড়িয়ে পড়া রঙের ছটা .... চারপাশে অপরূপ উদ্ভাস... সেই সময়ের তাপমাত্রা... চারদিকের গাছপালার আলোকসজ্জা বা সকালে ফুটে ওঠা ফুলের সুগন্ধ ... তা কি শুধু শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব ? এটা সম্পূর্ণ নিজের অনুভবের বিষয়। একইভাবে অনুভব ই হলো জ্ঞান -- যা প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজে নিজে প্রাপ্ত করতে হয়। অন্য কেউ শব্দ দিয়ে তা হয়তো বুঝিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তার গভীরে নিয়ে যেতে পারে না। এজন্য শ্রী ভগবান বলেছেন যে তিনি সর্বপ্রথমে বিবস্বান কে এটা বলেছেন। এটাই সনাতন সত্য। কালকে যা সত্য ছিল, আজকেও তাই সত্য এবং আগামী তে ও সেটাই সত্য। চিরকালীন সত্য। সত্যের খোঁজ যোগমার্গ দ্বারাই সম্ভব ।
শ্রীভগবানুবাচ
বহূনি মে ব্যতীতানি , জন্মানি তব চার্জুন।
তান্যহং(ম্) বেদ সর্বাণি, ন ত্বং(ম্) বেত্থ পরন্তপ ꠱5꠱
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন –হে পরন্তপ অর্জুন ! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে; সে সব তুমি জানো না, কিন্তু আমি জানি।
শ্রী ভগবান অর্জুন কে বললেন -- হে পরন্তপ অর্জুন! তোমার আর আমার বহু বার জন্ম হয়েছে ।
শ্রীভগবান বলেছেন যে আমার পূর্ব সমস্ত জন্মের বিষয় জানি ; কিন্তু তুমি তা জানো না ... কারণ, এর জন্য আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ।আমাদের সাধারণ চক্ষু দ্বারা ওই সমস্ত জন্ম দেখা সম্ভব নয় ; এর জন্য বিশেষ প্রকার সাধন করতে হয়। ঈশ্বর তো ত্রিকালদর্শী -- তিনি ভূত ও জানেন, ভবিষ্যৎ ও জানেন।
একজন বন্ধু গাছে উঠেছে, আরেকজন বন্ধু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। গাছের উপর থেকে প্রথম জন দেখতে পাচ্ছে দূরে অন্য আরেকজন বন্ধু আসছে । সে নীচের বন্ধু কে সেকথা জানালো ; কিন্তু নীচের জন কি করে দেখতে পাবে যে কে আসছে? কারণ, যে যত উঁচুতে উঠে যাবে সে অনেক দূর অবধি দেখতে পাবে। একজনের জন্য যেটা ভবিষ্যৎ, অন্যজনের জন্য সেটাই বর্তমান হয়ে গেছে। এভাবেই একজনের জন্য যা অতীত হয়ে গেছে ; অন্যজনের ( যে উঁচু তে রয়েছে) জন্য সেটা তখনও বর্তমান।
এটা বুঝতে হবে যে শ্রী ভগবান কতটা উচ্চতায় রয়েছেন। সেই উচ্চতা থেকে ভগবান অতীত ও দেখতে পাচ্ছেন আবার ভবিষ্যতে কি হবে তা ও দেখছেন। অনেক এমন মহাত্মা তপস্বীরা আছেন যাঁরা সাধনা করে এক বিশিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছেন।
আমাদের মৃত্যুর সময় আমরা মন কে বিকারমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে পারি .... মন কে সম্পূর্ণ কামনা মুক্ত না করতে পারলে.... সামান্য কামনা ও যদি থাকে, তাহলেই আত্মা নতুন জন্ম নিয়ে সেই কামনার জালে জড়িয়ে পড়ে এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকে।
একটা প্রশ্ন মনে আসতে পারে --- তাহলে কি ঈশ্বরের মনে ও কোন বিকার রয়ে গেছিল? ঈশ্বরকে কেন বারবার জন্ম নিতে হয়েছে? না। মনের বিকারের কারণে ঈশ্বর বারবার জন্ম নেন নি। কোন অভিপ্রায়ে ঈশ্বর বারবার জন্ম নিয়েছেন তা তিনি পরবর্তী শ্লোক গুলো তে বলেছেন --
শ্রীভগবান বলেছেন যে আমার পূর্ব সমস্ত জন্মের বিষয় জানি ; কিন্তু তুমি তা জানো না ... কারণ, এর জন্য আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ।আমাদের সাধারণ চক্ষু দ্বারা ওই সমস্ত জন্ম দেখা সম্ভব নয় ; এর জন্য বিশেষ প্রকার সাধন করতে হয়। ঈশ্বর তো ত্রিকালদর্শী -- তিনি ভূত ও জানেন, ভবিষ্যৎ ও জানেন।
একজন বন্ধু গাছে উঠেছে, আরেকজন বন্ধু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। গাছের উপর থেকে প্রথম জন দেখতে পাচ্ছে দূরে অন্য আরেকজন বন্ধু আসছে । সে নীচের বন্ধু কে সেকথা জানালো ; কিন্তু নীচের জন কি করে দেখতে পাবে যে কে আসছে? কারণ, যে যত উঁচুতে উঠে যাবে সে অনেক দূর অবধি দেখতে পাবে। একজনের জন্য যেটা ভবিষ্যৎ, অন্যজনের জন্য সেটাই বর্তমান হয়ে গেছে। এভাবেই একজনের জন্য যা অতীত হয়ে গেছে ; অন্যজনের ( যে উঁচু তে রয়েছে) জন্য সেটা তখনও বর্তমান।
এটা বুঝতে হবে যে শ্রী ভগবান কতটা উচ্চতায় রয়েছেন। সেই উচ্চতা থেকে ভগবান অতীত ও দেখতে পাচ্ছেন আবার ভবিষ্যতে কি হবে তা ও দেখছেন। অনেক এমন মহাত্মা তপস্বীরা আছেন যাঁরা সাধনা করে এক বিশিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছেন।
আমাদের মৃত্যুর সময় আমরা মন কে বিকারমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে পারি .... মন কে সম্পূর্ণ কামনা মুক্ত না করতে পারলে.... সামান্য কামনা ও যদি থাকে, তাহলেই আত্মা নতুন জন্ম নিয়ে সেই কামনার জালে জড়িয়ে পড়ে এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হতে থাকে।
একটা প্রশ্ন মনে আসতে পারে --- তাহলে কি ঈশ্বরের মনে ও কোন বিকার রয়ে গেছিল? ঈশ্বরকে কেন বারবার জন্ম নিতে হয়েছে? না। মনের বিকারের কারণে ঈশ্বর বারবার জন্ম নেন নি। কোন অভিপ্রায়ে ঈশ্বর বারবার জন্ম নিয়েছেন তা তিনি পরবর্তী শ্লোক গুলো তে বলেছেন --
অজোsপি সন্নব্যয়াত্মা , ভূতানামীশ্বরোs পি সন্।
প্রকৃতিং(ম্) স্বামধিষ্ঠায় ,সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ꠱6꠱
আমি জন্মরহিত, অবিনাশীস্বরূপ এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও নিজ প্রকৃতিকে অধীন করে স্বীয় যোগমায়া দ্বারা প্রকটিত হই।
শ্রীভগবান বলেছেন -- আমি অজাত ; আমি অবিনাশী এবং সমস্ত ভৌতিক বস্তুর ঈশ্বর আমিই । তা সত্ত্বেও আমি প্রকৃতির অধীনে থাকি। এই প্রকৃতিও আমারই সৃষ্টি। তবুও আমি প্রকৃতির অধীনে থেকে যোগমায়া দ্বারা প্রকাশিত হই। শ্রী ভগবানের আত্মা তাঁর মনের নির্দেশে চলে না। ভগবান নিজের ইচ্ছায় প্রকাশিত হন ; যোগমায়া দ্বারা প্রকাশিত হন।
যেমন আয়নার সামনে যে দাঁড়ায় তারই প্রতিবিম্ব দেখা যায় .... আসলে তো একজনই , কিন্তু দুইজন হয়ে যায় --- তেমনই ভগবতস্বরূপ পুরুষোত্তম নিজের স্থানে থেকেও পৃথিবীতে প্রকাশিত হন । আসলে তিনি অমূর্ত ; তথাপি জগতের কল্যাণের জন্য মূর্ত স্বরূপ প্রতিবিম্বিত হয়ে দর্শন দেন। শ্রী ভগবান বলেছেন যে তাঁকে কেন জন্ম - মৃত্যুর চক্রে আসতে হয় ? তাঁর কামনা পূরণের জন্য কি বারবার পৃথিবীতে আসতে হয়? না, তা নয় । পরের শ্লোকে তিনি বলেছেন ---
যেমন আয়নার সামনে যে দাঁড়ায় তারই প্রতিবিম্ব দেখা যায় .... আসলে তো একজনই , কিন্তু দুইজন হয়ে যায় --- তেমনই ভগবতস্বরূপ পুরুষোত্তম নিজের স্থানে থেকেও পৃথিবীতে প্রকাশিত হন । আসলে তিনি অমূর্ত ; তথাপি জগতের কল্যাণের জন্য মূর্ত স্বরূপ প্রতিবিম্বিত হয়ে দর্শন দেন। শ্রী ভগবান বলেছেন যে তাঁকে কেন জন্ম - মৃত্যুর চক্রে আসতে হয় ? তাঁর কামনা পূরণের জন্য কি বারবার পৃথিবীতে আসতে হয়? না, তা নয় । পরের শ্লোকে তিনি বলেছেন ---
যদা যদা হি ধর্মস্য , গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য , তদাত্মানং(ম্) সৃজাম্য়হম্ ꠱7꠱
হে ভারত ! যখনই ধর্মের হানি এবং অধর্মের বৃদ্ধি হয়, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি অর্থাৎ সাকাররূপে জনসমক্ষে প্রকট হই।
পরিত্রাণায় সাধূনাং(ম্) , বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় , সম্ভবামি যুগে যুগে ꠱8꠱
সাধুদের রক্ষার জন্য, পাপীদের বিনাশের জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
শ্রীভগবান বলেছেন প্রতি যুগে আমি আসি। বারবার আসি। সত্যযুগে এসেছি ; ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র রূপে এসেছি ; দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ রূপে এসেছি -- এভাবে যুগে যুগে নতুন নতুন রূপে অবতীর্ণ হবো।
চারটি যুগের মধ্যে বহু বছরের অন্তর --
এক সত্যযুগ -- সতেরো লক্ষ আঠাশ হাজার বছর।
এক ত্রেতাযুগ -- বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বছর
এক দ্বাপরযুগ - আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর
এবং,
এক কলিযুগ -- চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর
প্রত্যেক যুগে শ্রী ভগবানের অবতরণ কেন হয়?
হে ভারত! হে ভরতবংশীয় অর্জুন! যখনই ধর্মের হানি হয় আর অধর্ম বৃদ্ধি পায় -- তখনই আমি সাকার রূপে নিজেকে পৃথিবীতে প্রকাশ করি। কখনও মৎস্য রূপে, কখনও কচ্ছপ রূপে আসি ; কখনও নৃসিংহ রূপে, কখনও বামন রূপে, কখনও রাম অথবা পরশুরাম এবং কৃষ্ণ রূপ ধারণ করে আসি।
কখনও তিনি পূর্ণাবতার ; কখনও বা অর্ধাবতার রূপে... যেমন - মোহিনী, ধন্বন্তরি, হয়গ্রীব, শ্রীহরি -- যিনি গজেন্দ্র'র মোক্ষ দিয়েছিলেন । বেদব্যাস, সনক, সনন্দন, সনাতন, সনতকুমার ইত্যাদি । নারদ, কপিলমুনি, দত্তাত্রেয়, ঋষভদেব, পৃথু ইত্যাদি অনেক অর্ধাবতারে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন ।
এর কারণ হলো "পরিত্রাণায় সাধুনাং" সাধুজন - অর্থাৎ, ভালো মানুষজন তথা ভক্তজন --- তাদের রক্ষা করার জন্য এবং পাপীদের বিনাশ করার জন্য তথা ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে শ্রী ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে চলেছেন। ভক্তের দুঃখ দূর করার জন্য শ্রী ভগবান আসেন ধরাধামে --- সবসময় পূর্ণ রূপে হয়তো আসেন না ; কখনো অর্ধ রূপে, কখনো বা সূক্ষ্ম রূপে তিনি আসেন।
আমরা তো অনুভব করেছি , সম্ভবত আপনারাও করেছেন যে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে শ্রী ভগবান কে স্মরণ করলে কোন না কোন রূপে তিনি আমাদের দুঃখ দূর করে দেন। এর জন্য আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। আমরা মন থেকে বিশ্বাস করতে পারি না যে... আমরা যার সহায়তা পেয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে এলাম... তিনিই ঈশ্বর। তিনিই তো শ্রীভগবান যিনি কোন মাধ্যম রূপে আমাদের কার্য সম্পন্ন করিয়ে দিলেন।
শ্রী ভগবান অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে আসেন, অধর্ম রোধ করতে আসেন, দুঃখ, দোষ দূর করার জন্যও আসেন, বিবেক জাগ্রত করতে আসেন। শুধু যুগে যুগে নয়, প্রতি ক্ষণে তিনি আসেন.... কিন্তু বিড়ম্বনা এটাই যে আমরা তাঁর স্বরূপ চিনতে পারি না। আসলে তিনি ধরা দেন না।
শ্রীভগবান অর্জুন কে বলেছেন --- তুমি জানো না ; কিন্তু আমি জানি। তোমার পূর্ব জন্মের কথা তুমি জানো না, আমি জানি। আমি তো তোমার ভবিষ্যতের জন্মের কথাও জানি না। তুমি জানো না কবে এবং কে তোমার সহায়ক ছিল ..... অর্জুনের মতো আমাদেরও কেউ সহায়ক হয়ে ওঠে ; আমরাও জানতে পারি না... ভেবে নিই যে আমার প্রভাব ছিল বলেই সে সহায়তা করেছে। এটাই হলো আমাদের অহংকার। কখনো পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়- বিশাল ট্রাক কে ও বিন্দুর মতো মনে হয়। তেমনই অহংকারের ফলে নিজেকে বিরাট কিছু মনে হয় ... মনে হয় আমার কারণে এসব ঘটে চলেছে।
অর্জুনেরও এমনই মনে হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কারণে এতো অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটবে... তিনি জানতেন না যে তাদের মেরে ফেলার জন্য অন্য কেউ আছেন ... তিনি তো নিমিত্তমাত্র। এবং সম্পূর্ণ ভাগবদগীতা এজন্যই বোঝানো হয়েছে।
চারটি যুগের মধ্যে বহু বছরের অন্তর --
এক সত্যযুগ -- সতেরো লক্ষ আঠাশ হাজার বছর।
এক ত্রেতাযুগ -- বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বছর
এক দ্বাপরযুগ - আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর
এবং,
এক কলিযুগ -- চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর
প্রত্যেক যুগে শ্রী ভগবানের অবতরণ কেন হয়?
হে ভারত! হে ভরতবংশীয় অর্জুন! যখনই ধর্মের হানি হয় আর অধর্ম বৃদ্ধি পায় -- তখনই আমি সাকার রূপে নিজেকে পৃথিবীতে প্রকাশ করি। কখনও মৎস্য রূপে, কখনও কচ্ছপ রূপে আসি ; কখনও নৃসিংহ রূপে, কখনও বামন রূপে, কখনও রাম অথবা পরশুরাম এবং কৃষ্ণ রূপ ধারণ করে আসি।
কখনও তিনি পূর্ণাবতার ; কখনও বা অর্ধাবতার রূপে... যেমন - মোহিনী, ধন্বন্তরি, হয়গ্রীব, শ্রীহরি -- যিনি গজেন্দ্র'র মোক্ষ দিয়েছিলেন । বেদব্যাস, সনক, সনন্দন, সনাতন, সনতকুমার ইত্যাদি । নারদ, কপিলমুনি, দত্তাত্রেয়, ঋষভদেব, পৃথু ইত্যাদি অনেক অর্ধাবতারে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন ।
এর কারণ হলো "পরিত্রাণায় সাধুনাং" সাধুজন - অর্থাৎ, ভালো মানুষজন তথা ভক্তজন --- তাদের রক্ষা করার জন্য এবং পাপীদের বিনাশ করার জন্য তথা ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে শ্রী ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে চলেছেন। ভক্তের দুঃখ দূর করার জন্য শ্রী ভগবান আসেন ধরাধামে --- সবসময় পূর্ণ রূপে হয়তো আসেন না ; কখনো অর্ধ রূপে, কখনো বা সূক্ষ্ম রূপে তিনি আসেন।
আমরা তো অনুভব করেছি , সম্ভবত আপনারাও করেছেন যে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে শ্রী ভগবান কে স্মরণ করলে কোন না কোন রূপে তিনি আমাদের দুঃখ দূর করে দেন। এর জন্য আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। আমরা মন থেকে বিশ্বাস করতে পারি না যে... আমরা যার সহায়তা পেয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে এলাম... তিনিই ঈশ্বর। তিনিই তো শ্রীভগবান যিনি কোন মাধ্যম রূপে আমাদের কার্য সম্পন্ন করিয়ে দিলেন।
শ্রী ভগবান অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে আসেন, অধর্ম রোধ করতে আসেন, দুঃখ, দোষ দূর করার জন্যও আসেন, বিবেক জাগ্রত করতে আসেন। শুধু যুগে যুগে নয়, প্রতি ক্ষণে তিনি আসেন.... কিন্তু বিড়ম্বনা এটাই যে আমরা তাঁর স্বরূপ চিনতে পারি না। আসলে তিনি ধরা দেন না।
শ্রীভগবান অর্জুন কে বলেছেন --- তুমি জানো না ; কিন্তু আমি জানি। তোমার পূর্ব জন্মের কথা তুমি জানো না, আমি জানি। আমি তো তোমার ভবিষ্যতের জন্মের কথাও জানি না। তুমি জানো না কবে এবং কে তোমার সহায়ক ছিল ..... অর্জুনের মতো আমাদেরও কেউ সহায়ক হয়ে ওঠে ; আমরাও জানতে পারি না... ভেবে নিই যে আমার প্রভাব ছিল বলেই সে সহায়তা করেছে। এটাই হলো আমাদের অহংকার। কখনো পাহাড়ের উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়- বিশাল ট্রাক কে ও বিন্দুর মতো মনে হয়। তেমনই অহংকারের ফলে নিজেকে বিরাট কিছু মনে হয় ... মনে হয় আমার কারণে এসব ঘটে চলেছে।
অর্জুনেরও এমনই মনে হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কারণে এতো অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটবে... তিনি জানতেন না যে তাদের মেরে ফেলার জন্য অন্য কেউ আছেন ... তিনি তো নিমিত্তমাত্র। এবং সম্পূর্ণ ভাগবদগীতা এজন্যই বোঝানো হয়েছে।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্ , এবং(ম্) য়ো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং(ম্) পুনর্জন্ম , নৈতি মামেতি সোsর্জুন ꠱9꠱
হে অর্জুন! আমার জন্ম ও কর্ম দিব্য অর্থাৎ নির্মল ও অলৌকিক—এইভাবে যে ব্যক্তি আমাকে তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না অর্থাৎ তিনি আমাকেই লাভ করেন।
শ্রীভগবান বলেছেন -- হে অর্জুন! আমার জন্ম এবং কর্ম দিব্য। এই জন্ম সাধারণ মানব জন্মের মতো নয়, এ হলো ঐশ্বরিক জন্ম। এর সাথে সাথে আমার কৃত সকল কর্মও ঐশ্বরিক। যে মানুষ আমার এই জন্ম ও কর্মের তত্ব জানতে পারে এবং মান্য করে --- সেই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন ছিন্ন করে ; আর জন্ম নেয় না। শ্রী ভগবানের জন্ম এবং কর্মের রহস্য যে বুঝতে পারে, তার জীবনের রহস্য ও জানা হয়ে যায় ।
শ্রীভগবানের কিছু কর্ম করার আবশ্যিকতা তো নেই ; তবুও ভগবান অবতরণ করেন এবং কর্ম করেন। অকর্তা হয়েও তিনি কর্মরত থাকেন। আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের মনে হয় কিচ্ছুটি করার প্রয়োজন নেই ; সবকিছু হয়ে যাবে , সব কিছু হয়ে গেছে -- যা কিছু অর্জন করার ছিল, করা হয়ে গেছে, এবার শুধু আরাম করবো। কিন্তু, স্বয়ং ভগবান ও আরাম করেন না... যিনি ত্রিলোকের পালন করেন, আর্তের ত্রাণ করেন... তিনি কি করে আরাম করবেন? তিনি কর্মযোগে রয়েছেন । কেমন কর্মযোগ ... অকর্মে নিয়োজিত। তিনি কেবল কর্মই করেন না, অকর্ম ও করেন ।
এই তত্ত্ব যখন জানা হয়ে যায়... যে অকর্তা হয়েও স্বয়ং শ্রী ভগবান কর্ম করে যাচ্ছেন... তাহলে আমরা আর কে? আমাদের ও নিত্যকার জীবনে, আশ - পাশে,আমাদের সমাজের সেবক হয়ে থাকা উচিত ... স্বার্থহীন হয়ে কাজ করতে হবে। যে এই তত্ত্ব জানবে , সে ও অকর্তা হয়ে যাবে এবং সে জীবন রহস্য ও বুঝতে পারবে --- তার মুক্তি নিশ্চিত ।
এই অধ্যায়ে শ্রী ভগবান মুক্তির পথ আরও একটু প্রশস্ত করে দিয়েছেন। অর্জুনের কারণে, অর্জুনের মাধ্যমে এই দিব্যজ্ঞান আমরাও পাচ্ছি। এর জন্য আমাদের উচিত অর্জুন কে হৃদয় থেকে ধন্যবাদ জানানো। এই বিষয়ে আরও অনেক জ্ঞান প্রাপ্ত করার জন্য পরের বিবেচন সত্র শুনতে হবে। শুধু শোনা নয়... জীবনে তার প্রয়োগ ও করতে হবে। এই মার্গে চলা শ্রেয়।
শ্রীভগবান আমাদের সুবুদ্ধি প্রদান করুন, সদ্গতি করুন... এই প্রার্থনা সহ আজকের সত্র সমাপন হলো এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো ।
প্রশ্নকর্তা : সোনী ওমপ্রকাশ দিদি
প্রশ্ন (১) - যদি যোগ কে পাঠ্যক্রমের সাথে যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে খুবই ভালো হবে.... আপনি কি বলেন ?
প্রশ্ন (২) ধর্মের পথে থেকেও ভীষ্ম কেন পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেননি ?
উত্তর (১) - ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি অনুযায়ী যোগ প্রশিক্ষণ সমস্ত বিদ্যালয়ে অনিবার্য করা হয়েছে ; কিন্তু তা ফলপ্রসূ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারণ এই বিষয়ের শিক্ষক সংখ্যা নগন্য এবং শুধুমাত্র যোগের শিক্ষকের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করাও একটা বিষয় ।
উত্তর (২)- অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ও কখনো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার কারণে অভিমানের বশে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যার ফলে সবাই তাঁকে ভুল বিচার করে। পিতামহ ভীষ্মের আপন প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী হস্তিনাপুর সিংহাসনের প্রতি নিজের কর্তব্য পালন হেতু দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন -- যা বাস্তবিকই ভুল মনে হয়।
প্রশ্নকর্তা : দীপক দাদা
প্রশ্ন : গীতার শুরুতে অর্জুন খুব ভালো ভাবে যুদ্ধের পরিণামে কি হতে পারে তা বলেছিলেন। যুদ্ধের পরে তেমনই কি হয়েছিল ?
উত্তর : যুদ্ধের ফলে হস্তিনাপুরে ধর্মের স্থাপনা হয়েছিল এবং পাণ্ডবরা পর্যাপ্ত সময় অবধি রাজ্য পালন করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে অসংখ্য নরসংহার হয়েছিল। কিন্তু সব যুদ্ধের দুটো পরিণাম দেখা যায়। একটা ছোট পরিণাম এবং একটা বড়ো পরিণাম। যেমন - হিরোশিমা নাগাসাকির ঘটনার পরে জাপান সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু, তারপর জাপানীদের দেশভক্তি এতো প্রবল হয়ে উঠলো যে তারা পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে গেছে। সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এক অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হয় --- ধর্মের শক্তি -- যা মহাভারতের সময় ও হয়েছিল। যুদ্ধের ছোট পরিণাম অবশ্যই ভয়ানক, কিন্তু যদি তার বড়ো পরিণামের কথা ভাবা হয় -- তখন তা ঠিক বলে মনে হয়। অর্জুনের কথা তর্কের খাতিরে ঠিক ছিল, কিন্তু মানব কল্যাণের জন্য যা দরকার ছিল তা লাভ করার জন্য যুদ্ধ ছাড়া কিছু করার ছিল না।
প্রশ্নকর্তা : কুন্দন কুমারী দিদি
প্রশ্ন : পড়া এবং পরীক্ষার কারণে প্রায়ই মাথার যন্ত্রণা হয় । এ থেকে কি করে বাঁচবো?
উত্তর : এর উত্তর তো শ্রীমদ্ভাগবতগীতা তেই আছে । আপন কর্ম করতে হবে এবং পরিণামের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। কোন যোগ বিশেষজ্ঞের কাছে জলনীতি ক্রিয়া শিখে এবং প্রয়োগ করে সাইনাস ঠিক করে নিতে পারেন। জলনীতি, অর্থাৎ জল দিয়ে নাকের ভিতর পরিষ্কার করা । এটা করলে সাইনাস ঠিক হয়ে যায়।
নাসিকার মধ্যে চলাচলকারী ভিতর ও বাইরের শ্বাসের প্রবাহ সমান করতে করতে ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি কে সংযত করে কামনা ও ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে যে, সে সর্বদাই মুক্ত। যোগ করার সময় শরীর কে কিভাবে সোজা রাখতে হয় তা ও গীতায় বলা হয়েছে
যোগ করার সময় শরীর কে সোজা এবং স্থির রাখা উচিৎ। আর, যখন চিন্তা রূপী শত্রু আপনার দিকে আসতে থাকবে তখন কি করতে হবে তা ও গীতায় বলা আছে --
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন -- মানুষের উচিত সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয় কে বশে রেখে দৃঢ়তার সাথে স্থির হওয়া। কারণ, যে পুরুষ ইন্দ্রিয় কে বশে রাখতে পারে, তার বুদ্ধি ও স্থির হয়। স্থির বুদ্ধির ফলে কোন রকম চিন্তা তাকে বিব্রত করতে পারে না এবং মাথার যন্ত্রণা ও মিলিয়ে যায়।
প্রশ্নকর্তা : গায়ত্রী দিদি
প্রশ্ন (১) : এমন বন্ধু কোথায় পাওয়া যাবে যার কাছে সব বলা যায় এবং সে ও আমাকে সব বলবে?
প্রশ্ন (২) : দিব্য কর্ম কি?
উত্তর (১): শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে ভালো সখা আর কে হতে পারেন? এজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেই নিজের সখা করে নিন এবং নিজের মনের কথা তাঁর কাছে বলুন -- যাকে নবধা ভক্তিতে আত্মনিবেদন বলা হয়। ভগবান স্বয়ং আপনাকে পথ দেখাবেন।
উত্তর (২) ভগবান যখন কোন রূপে অবতীর্ণ হন এই ধরায়.... তখন তাঁর দ্বারা কৃত কর্ম ই হলো দিব্য কর্ম। যেমন - কূর্ম অবতারে তিনি পৃথিবীকে পিঠে ধারণ করেছেন ; শ্রীকৃষ্ণ অবতারে পুতনার মতো রাক্ষসী বাল্যকালে বধ করেছেন --- ইত্যাদি।
শ্রীভগবানের কিছু কর্ম করার আবশ্যিকতা তো নেই ; তবুও ভগবান অবতরণ করেন এবং কর্ম করেন। অকর্তা হয়েও তিনি কর্মরত থাকেন। আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের মনে হয় কিচ্ছুটি করার প্রয়োজন নেই ; সবকিছু হয়ে যাবে , সব কিছু হয়ে গেছে -- যা কিছু অর্জন করার ছিল, করা হয়ে গেছে, এবার শুধু আরাম করবো। কিন্তু, স্বয়ং ভগবান ও আরাম করেন না... যিনি ত্রিলোকের পালন করেন, আর্তের ত্রাণ করেন... তিনি কি করে আরাম করবেন? তিনি কর্মযোগে রয়েছেন । কেমন কর্মযোগ ... অকর্মে নিয়োজিত। তিনি কেবল কর্মই করেন না, অকর্ম ও করেন ।
এই তত্ত্ব যখন জানা হয়ে যায়... যে অকর্তা হয়েও স্বয়ং শ্রী ভগবান কর্ম করে যাচ্ছেন... তাহলে আমরা আর কে? আমাদের ও নিত্যকার জীবনে, আশ - পাশে,আমাদের সমাজের সেবক হয়ে থাকা উচিত ... স্বার্থহীন হয়ে কাজ করতে হবে। যে এই তত্ত্ব জানবে , সে ও অকর্তা হয়ে যাবে এবং সে জীবন রহস্য ও বুঝতে পারবে --- তার মুক্তি নিশ্চিত ।
এই অধ্যায়ে শ্রী ভগবান মুক্তির পথ আরও একটু প্রশস্ত করে দিয়েছেন। অর্জুনের কারণে, অর্জুনের মাধ্যমে এই দিব্যজ্ঞান আমরাও পাচ্ছি। এর জন্য আমাদের উচিত অর্জুন কে হৃদয় থেকে ধন্যবাদ জানানো। এই বিষয়ে আরও অনেক জ্ঞান প্রাপ্ত করার জন্য পরের বিবেচন সত্র শুনতে হবে। শুধু শোনা নয়... জীবনে তার প্রয়োগ ও করতে হবে। এই মার্গে চলা শ্রেয়।
শ্রীভগবান আমাদের সুবুদ্ধি প্রদান করুন, সদ্গতি করুন... এই প্রার্থনা সহ আজকের সত্র সমাপন হলো এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো ।
:: প্রশ্নোত্তর ::
প্রশ্নকর্তা : সোনী ওমপ্রকাশ দিদি
প্রশ্ন (১) - যদি যোগ কে পাঠ্যক্রমের সাথে যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে খুবই ভালো হবে.... আপনি কি বলেন ?
প্রশ্ন (২) ধর্মের পথে থেকেও ভীষ্ম কেন পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেননি ?
উত্তর (১) - ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি অনুযায়ী যোগ প্রশিক্ষণ সমস্ত বিদ্যালয়ে অনিবার্য করা হয়েছে ; কিন্তু তা ফলপ্রসূ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারণ এই বিষয়ের শিক্ষক সংখ্যা নগন্য এবং শুধুমাত্র যোগের শিক্ষকের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করাও একটা বিষয় ।
উত্তর (২)- অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ও কখনো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার কারণে অভিমানের বশে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যার ফলে সবাই তাঁকে ভুল বিচার করে। পিতামহ ভীষ্মের আপন প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী হস্তিনাপুর সিংহাসনের প্রতি নিজের কর্তব্য পালন হেতু দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন -- যা বাস্তবিকই ভুল মনে হয়।
প্রশ্নকর্তা : দীপক দাদা
প্রশ্ন : গীতার শুরুতে অর্জুন খুব ভালো ভাবে যুদ্ধের পরিণামে কি হতে পারে তা বলেছিলেন। যুদ্ধের পরে তেমনই কি হয়েছিল ?
উত্তর : যুদ্ধের ফলে হস্তিনাপুরে ধর্মের স্থাপনা হয়েছিল এবং পাণ্ডবরা পর্যাপ্ত সময় অবধি রাজ্য পালন করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে অসংখ্য নরসংহার হয়েছিল। কিন্তু সব যুদ্ধের দুটো পরিণাম দেখা যায়। একটা ছোট পরিণাম এবং একটা বড়ো পরিণাম। যেমন - হিরোশিমা নাগাসাকির ঘটনার পরে জাপান সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু, তারপর জাপানীদের দেশভক্তি এতো প্রবল হয়ে উঠলো যে তারা পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষ স্থানে পৌঁছে গেছে। সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এক অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হয় --- ধর্মের শক্তি -- যা মহাভারতের সময় ও হয়েছিল। যুদ্ধের ছোট পরিণাম অবশ্যই ভয়ানক, কিন্তু যদি তার বড়ো পরিণামের কথা ভাবা হয় -- তখন তা ঠিক বলে মনে হয়। অর্জুনের কথা তর্কের খাতিরে ঠিক ছিল, কিন্তু মানব কল্যাণের জন্য যা দরকার ছিল তা লাভ করার জন্য যুদ্ধ ছাড়া কিছু করার ছিল না।
প্রশ্নকর্তা : কুন্দন কুমারী দিদি
প্রশ্ন : পড়া এবং পরীক্ষার কারণে প্রায়ই মাথার যন্ত্রণা হয় । এ থেকে কি করে বাঁচবো?
উত্তর : এর উত্তর তো শ্রীমদ্ভাগবতগীতা তেই আছে । আপন কর্ম করতে হবে এবং পরিণামের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। কোন যোগ বিশেষজ্ঞের কাছে জলনীতি ক্রিয়া শিখে এবং প্রয়োগ করে সাইনাস ঠিক করে নিতে পারেন। জলনীতি, অর্থাৎ জল দিয়ে নাকের ভিতর পরিষ্কার করা । এটা করলে সাইনাস ঠিক হয়ে যায়।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ ॥5.27॥
নাসিকার মধ্যে চলাচলকারী ভিতর ও বাইরের শ্বাসের প্রবাহ সমান করতে করতে ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি কে সংযত করে কামনা ও ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে যে, সে সর্বদাই মুক্ত। যোগ করার সময় শরীর কে কিভাবে সোজা রাখতে হয় তা ও গীতায় বলা হয়েছে
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ।
সম্প্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্॥6.13॥
সম্প্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্॥6.13॥
যোগ করার সময় শরীর কে সোজা এবং স্থির রাখা উচিৎ। আর, যখন চিন্তা রূপী শত্রু আপনার দিকে আসতে থাকবে তখন কি করতে হবে তা ও গীতায় বলা আছে --
তানি সর্বাণি সংয়ম্য য়ুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি য়স্যেন্দ্রিয়াণি, তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥2.61॥
বশে হি য়স্যেন্দ্রিয়াণি, তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥2.61॥
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন -- মানুষের উচিত সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয় কে বশে রেখে দৃঢ়তার সাথে স্থির হওয়া। কারণ, যে পুরুষ ইন্দ্রিয় কে বশে রাখতে পারে, তার বুদ্ধি ও স্থির হয়। স্থির বুদ্ধির ফলে কোন রকম চিন্তা তাকে বিব্রত করতে পারে না এবং মাথার যন্ত্রণা ও মিলিয়ে যায়।
প্রশ্নকর্তা : গায়ত্রী দিদি
প্রশ্ন (১) : এমন বন্ধু কোথায় পাওয়া যাবে যার কাছে সব বলা যায় এবং সে ও আমাকে সব বলবে?
প্রশ্ন (২) : দিব্য কর্ম কি?
উত্তর (১): শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে ভালো সখা আর কে হতে পারেন? এজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেই নিজের সখা করে নিন এবং নিজের মনের কথা তাঁর কাছে বলুন -- যাকে নবধা ভক্তিতে আত্মনিবেদন বলা হয়। ভগবান স্বয়ং আপনাকে পথ দেখাবেন।
উত্তর (২) ভগবান যখন কোন রূপে অবতীর্ণ হন এই ধরায়.... তখন তাঁর দ্বারা কৃত কর্ম ই হলো দিব্য কর্ম। যেমন - কূর্ম অবতারে তিনি পৃথিবীকে পিঠে ধারণ করেছেন ; শ্রীকৃষ্ণ অবতারে পুতনার মতো রাক্ষসী বাল্যকালে বধ করেছেন --- ইত্যাদি।