विवेचन सारांश
যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হৃদয় পরিবর্তন
সর্বপ্রথমে হনুমান চালীসা পাঠ ও গীতা পরিবারের ভজন, গান ও মঙ্গলাচরণ এবং এরপর দীপ প্রজ্বলন করা হয়। উপস্থিত সকল গীতা সাধকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে, আমাদের গুরু পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী গোবিন্দদেব গিরিজী মহারাজের আশীর্বাদে আজকের বিবেচন সত্র আরম্ভ হলো।
প্রথম অধ্যায়ে, অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার মনোভাবের কথা বলছেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি জানতে উৎসুক ছিলেন, তাই যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ প্রাপ্ত করার জন্য সঞ্জয়কে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। তিনি তাঁর গুরু মহর্ষি বেদব্যাসজীর কাছ থেকে দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত করেছিলেন এবং রাজপ্রাসাদে বসেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের সমগ্র পরিস্থিতি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করছিলেন। উভয় পক্ষের সৈন্যই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এবং শঙ্খনাদ ও রণবাদ্যের ধ্বনিতে সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী, উভয়ই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। শঙ্খনাদ এবং রণবাদ্যের আওয়াজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়েছে।
আগের সপ্তাহের বিবেচন সত্রে আমরা দেখেছি যে, অর্জুন শ্রীভগবানকে বলেছেন যে আমি সেই সমস্ত যোদ্ধাদের দেখতে চাই যারা এই যুদ্ধে দুরাচারী দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন এবং অন্যায়ের সমর্থন করছেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নির্দেশে রথটিকে দুই সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের পাঁচজন্য শঙ্খ বাজালেন এবং অর্জুনও তাঁর দেবদত্ত নামক শঙ্খ বাজালেন। ধর্মযুদ্ধের নিয়মানুসারে, যুদ্ধ শুধুমাত্র সমকক্ষদের সাথেই করা যায়। যেমন, একজন রথী (যোদ্ধা) শুধুমাত্র অন্য একজন রথীর সাথেই যুদ্ধ করে এবং একজন মহারথী(মহান যোদ্ধা) অন্য মহারথীর সাথেই যুদ্ধ করেন।
অর্জুন দেখতে চাইছেন যে কারা তার সাথে যুদ্ধ করার যোগ্য যোদ্ধা!
অর্জুন সেখানে গিয়ে কি দেখলেন?
প্রথম অধ্যায়ে, অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার মনোভাবের কথা বলছেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, কিন্তু তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি জানতে উৎসুক ছিলেন, তাই যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ প্রাপ্ত করার জন্য সঞ্জয়কে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। তিনি তাঁর গুরু মহর্ষি বেদব্যাসজীর কাছ থেকে দিব্যচক্ষু প্রাপ্ত করেছিলেন এবং রাজপ্রাসাদে বসেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের সমগ্র পরিস্থিতি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করছিলেন। উভয় পক্ষের সৈন্যই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে এবং শঙ্খনাদ ও রণবাদ্যের ধ্বনিতে সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী, উভয়ই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। শঙ্খনাদ এবং রণবাদ্যের আওয়াজ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়েছে।
আগের সপ্তাহের বিবেচন সত্রে আমরা দেখেছি যে, অর্জুন শ্রীভগবানকে বলেছেন যে আমি সেই সমস্ত যোদ্ধাদের দেখতে চাই যারা এই যুদ্ধে দুরাচারী দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন এবং অন্যায়ের সমর্থন করছেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের নির্দেশে রথটিকে দুই সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের পাঁচজন্য শঙ্খ বাজালেন এবং অর্জুনও তাঁর দেবদত্ত নামক শঙ্খ বাজালেন। ধর্মযুদ্ধের নিয়মানুসারে, যুদ্ধ শুধুমাত্র সমকক্ষদের সাথেই করা যায়। যেমন, একজন রথী (যোদ্ধা) শুধুমাত্র অন্য একজন রথীর সাথেই যুদ্ধ করে এবং একজন মহারথী(মহান যোদ্ধা) অন্য মহারথীর সাথেই যুদ্ধ করেন।
অর্জুন দেখতে চাইছেন যে কারা তার সাথে যুদ্ধ করার যোগ্য যোদ্ধা!
অর্জুন সেখানে গিয়ে কি দেখলেন?
1.25
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ(স্), সর্বেষাং(ঞ্) চ মহীক্ষিতাম্
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্, সমবেতান্কুরূনিতি॥25॥
শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্ম, দ্রোণ এবং অন্যান্য রাজন্যবর্গের সামনে উত্তম রথটি স্থাপন করে বললেন, হে পার্থ ! যুদ্ধে সমবেত কৌরবদের দেখ।
বিবেচন : যখন অর্জুন ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে তাঁর রথটিকে দুই বাহিনীর মধ্যে নিয়ে যেতে বললেন, তখন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ রথকে সেই স্থানে নিয়ে গেলেন যেখানে ভীষ্ম পিতামহ, আচার্য দ্রোণ, সমস্ত বিশিষ্ট রাজা এবং অন্যান্য মহান যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সঞ্জয় এখন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, "তুমি কি দেখতে চাও যে কার সাথে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে? তাহলে হে অর্জুন! যুদ্ধের জন্য এখানে একত্রিত হওয়া সমস্ত কৌরবদের মনোযোগ দিয়ে দেখ!"
সঞ্জয় এখন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, "তুমি কি দেখতে চাও যে কার সাথে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে? তাহলে হে অর্জুন! যুদ্ধের জন্য এখানে একত্রিত হওয়া সমস্ত কৌরবদের মনোযোগ দিয়ে দেখ!"
তত্রাপশ্যত্স্থিতান্পার্থঃ(ফ্), পিতৃনথ পিতামহান্
আচার্য়ান্মাতুলান্ভ্রাতৃন্, পুত্রান্পৌত্রান্সখীংস্তথা॥26॥
তখন পৃথাপুত্র অর্জুন উভয় সেনাবাহিনীতে অবস্থানকারী পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ এবং সুহৃদগণকে লক্ষ্য করলেন।
শ্বশুরান্সুহৃদশ্চৈব, সেনয়োরুভয়োরপি
তান্সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়:(স্), সর্বান্বন্ধূনবস্থিতান্॥27॥
তখন পৃথাপুত্র অর্জুন উভয় সেনাবাহিনীতে অবস্থানকারী পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ এবং সুহৃদগণকে লক্ষ্য করলেন।
বিবেচন : অর্জুন কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে কাকে কাকে দেখেছিলেন?
অর্জুন, তার পিতামহ, আত্মীয়-জ্ঞাতি অর্থাৎ পিতৃব্য, মাতুল, ভ্রাতা, সেই সমস্ত আচার্য যারা তাকে জ্ঞান প্রদান করেছেন, তাদের নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
অর্জুন দেখলেন, যারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা কেউ কারো পুত্র, পৌত্র, কেউ বা ভগিনীর পুত্র আর কেউ ভ্রাতুষ্পুত্র। কেউ তার শ্বশুর, কেউ বা জামাতা আবার কেউ তার নিকট মিত্র।
অর্জুন নিজের সামনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত উভয় পক্ষের সৈন্যদের উপস্থিত দেখলেন। উভয় সৈন্য বাহিনীতেই তার আত্মীয়-স্বজন এবং নিকট আত্মীয়রাই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
অর্জুন কি জানতেন না যে কার সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হবে!
অর্জুন যখন সকলকে প্রত্যক্ষ করলেন, তখন তিনি দেখলেন যে সেখানে সবাই একে অপরের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, গুরু-শিষ্য, সখা-মিত্র।
এসব দেখার পর কি হলো? অর্জুনের মনের কি অবস্থা হলো?
বিষণ্ণ হওয়া অর্থাৎ এমন গভীর দুঃখ যে মানুষ কিছুই স্থির করে উঠতে পারে না, ভালো-মন্দ বুঝতে পারে না, খাওয়া-দাওয়া, কর্তব্যপালন ইত্যাদি কিছুই ঠিকমতো করতে পারে না। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখে অর্জুনও মনে মনে এমনই গভীর দুঃখ অনুভব করলেন।
শোকাকুল অবস্থায় অর্জুন যা বললেন, সেটাই সাধক শ্রী জ্ঞানেশ্বর মহারাজ একটি সুন্দর উপমা দিয়ে বর্ণন করে বলেছেন,
একজন কুলীন ঘরের স্ত্রী যেমন তার স্বামীর অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক সহ্য করেন না এবং এটাকে অপমান মনে করে স্বামীকে ত্যাগ করেন, ঠিক তেমনি অর্জুন যখন তার মনে বিষাদ, করুণা ও দুঃখকে স্থান দিলেন, তখন অর্জুনের বীরোচিত শৌর্য রূপী স্ত্রী অপমানিত হয়ে তাকে ত্যাগ করে চলে যায়।
অর্থাৎ দুঃখের কারণে অর্জুনের মধ্যে যে শৌর্য আছে, তা চলে গেছে, বীরের প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
যেন অর্জুন যে মুহূর্তে তার হৃদয়ে করুণাকে স্থান দিলেন, তার পৌরুষ তাকে ত্যাগ করলো।
যখন করুণা ভাব অর্জুনের হৃদয়ে আধিপত্য করে নিলো, তখন তার শৌর্য রূপী স্ত্রী তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে পরিত্যাগ করেন চলে যান। অর্জুনের বীরত্বের প্রবৃত্তি চলে গেল। তার মনে যুদ্ধে প্রিয়জনদের হারানোর ভয় জেগে ওঠে।
অর্জুন, তার পিতামহ, আত্মীয়-জ্ঞাতি অর্থাৎ পিতৃব্য, মাতুল, ভ্রাতা, সেই সমস্ত আচার্য যারা তাকে জ্ঞান প্রদান করেছেন, তাদের নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
অর্জুন দেখলেন, যারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা কেউ কারো পুত্র, পৌত্র, কেউ বা ভগিনীর পুত্র আর কেউ ভ্রাতুষ্পুত্র। কেউ তার শ্বশুর, কেউ বা জামাতা আবার কেউ তার নিকট মিত্র।
অর্জুন নিজের সামনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত উভয় পক্ষের সৈন্যদের উপস্থিত দেখলেন। উভয় সৈন্য বাহিনীতেই তার আত্মীয়-স্বজন এবং নিকট আত্মীয়রাই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
অর্জুন কি জানতেন না যে কার সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হবে!
অর্জুন খুব ভালো করেই জানতেন যে যুদ্ধে কোন কোন যোদ্ধা দুর্যোধনের পক্ষে থাকবেন, কিন্তু কোনো জিনিস জানা আর সরাসরি দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। অর্জুন সবাইকে চাক্ষুস দেখতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দুই সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে রথ স্থাপন করতে বলেছিলেন।
এসব দেখার পর কি হলো? অর্জুনের মনের কি অবস্থা হলো?
সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদের একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখে অর্জুন অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন, তার মন গভীর দুঃখে ভরে গেল।
শোকাকুল অবস্থায় অর্জুন যা বললেন, সেটাই সাধক শ্রী জ্ঞানেশ্বর মহারাজ একটি সুন্দর উপমা দিয়ে বর্ণন করে বলেছেন,
तेथ मनीं गजबज जाहली आणि आपैसी कृपा आली ।
तेणें अपमानें निघाली वीरवृत्ति ॥ १८५ ॥
जिया उत्तम कुळींचिया होती आणि गुणलावण्य आथी ।
तिया आणिकींते न साहति सुतेजपणें ॥ १८६॥
नविये आवडीचेनि भरें कामुक निजवनिता विसरे ।
मग पाडेंविण अनुसरें भ्रमला जैसा ॥ १८७॥
একজন কুলীন ঘরের স্ত্রী যেমন তার স্বামীর অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক সহ্য করেন না এবং এটাকে অপমান মনে করে স্বামীকে ত্যাগ করেন, ঠিক তেমনি অর্জুন যখন তার মনে বিষাদ, করুণা ও দুঃখকে স্থান দিলেন, তখন অর্জুনের বীরোচিত শৌর্য রূপী স্ত্রী অপমানিত হয়ে তাকে ত্যাগ করে চলে যায়।
অর্থাৎ দুঃখের কারণে অর্জুনের মধ্যে যে শৌর্য আছে, তা চলে গেছে, বীরের প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
तैसें अर्जुना तेथ जाहले । असतें पुरुषत्व गेले ।
जें अंतःकरण दिधले । कारुण्यासी ॥ १८९॥
যেন অর্জুন যে মুহূর্তে তার হৃদয়ে করুণাকে স্থান দিলেন, তার পৌরুষ তাকে ত্যাগ করলো।
যখন করুণা ভাব অর্জুনের হৃদয়ে আধিপত্য করে নিলো, তখন তার শৌর্য রূপী স্ত্রী তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে পরিত্যাগ করেন চলে যান। অর্জুনের বীরত্বের প্রবৃত্তি চলে গেল। তার মনে যুদ্ধে প্রিয়জনদের হারানোর ভয় জেগে ওঠে।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো, বিষীদন্নিদমব্রবীত্
অর্জুন উওয়াচ
দৃষ্ট্বেমং স্বজনং(ঙ্) কৃষ্ণ, য়ুয়ুত্সুং (ম্) সমুপস্থিতম্ ॥28॥
অর্জুন খুবই করুণার্দ্র হয়ে বিষণ্ণ চিত্তে এই কথা বললেন। অর্জুন বললেন -আমার স্বজনদের এই রণাঙ্গনে উপস্থিত দেখে ৷
সীদন্তি মম গাত্রাণী, মুখং (ঞ্) চ পরিশুষ্যতি
বেপথুশ্চ শরীরে মে, রোমহর্ষশ্চ জায়তে ॥29॥
অর্জুন বললেন—হে কৃষ্ণ ! যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত এই যুদ্ধাভিলাষী স্বজনদের দেখে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি অবসন্ন হচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, শরীরে কম্পন ও রোমাঞ্চ হচ্ছে।
বিবেচন : এইভাবে অর্জুনের বীরত্বের প্রবৃত্তি, যখন অতি বিষাদ, অতি দুঃখ ও করুণার কারণে বিনষ্ট হয়ে গেলো, তখন অর্জুন কী বললেন?
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যে অর্জুনের মনে উৎপন্ন এই বিষাদের কারণে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন,
অর্জুন বলছেন: যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই আত্মীয়-পরিজনকে আমার সামনে উপস্থিত দেখে আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ছে, আমার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে এবং আমার শরীর কাঁপছে এবং শিহরিত হয়ে উঠছে।”
যখন কোনো ব্যক্তির জীবনে কঠিন পরিস্থিতি আসে, তখন তার গলা শুকিয়ে যায়, তার হাত, পা, সমস্ত অঙ্গ, সমস্ত শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের স্বজনদের নিজের সম্মুখে দেখে অর্জুনের অবস্থাও একই রকম হয়ে গেল।
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন যে অর্জুনের মনে উৎপন্ন এই বিষাদের কারণে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন,
দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্।
অর্জুন বলছেন: যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই আত্মীয়-পরিজনকে আমার সামনে উপস্থিত দেখে আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ছে, আমার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে এবং আমার শরীর কাঁপছে এবং শিহরিত হয়ে উঠছে।”
যখন কোনো ব্যক্তির জীবনে কঠিন পরিস্থিতি আসে, তখন তার গলা শুকিয়ে যায়, তার হাত, পা, সমস্ত অঙ্গ, সমস্ত শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের স্বজনদের নিজের সম্মুখে দেখে অর্জুনের অবস্থাও একই রকম হয়ে গেল।
গাণ্ডীবং(ম্) স্রংসতে হস্তাত্, ত্বক্চৈব পরিদহ্যতে
ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং(ম্), ভ্রমতীব চ মে মনঃ॥30॥
গাণ্ডীব ধনুক হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে, ত্বকে খুবই জ্বালাবোধ হচ্ছে, মন যেন ঘুরছে, তাই আমার দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ্যও থাকছে না।
বিবেচন : অর্জুনের মনের মধ্যে আর কি কি অনুভূতি উৎপন্ন হচ্ছে?
সঞ্জয় যুদ্ধের বর্ণন করে জানাচ্ছেন যে এখন অর্জুন বলছেন, "আমার গাণ্ডীব ধনুক আমার হাত থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে, আমার ত্বক জ্বলছে,, আমার মন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, আমি কিছুই অনুভব করছি না, বুঝতে পারছি না। " দেখুন, অন্যতম সেরা তীরন্দাজ, বিষাদগ্রস্থ হওয়ার কারণে, তার এই অবস্থা হয়েছে !
অর্জুন আরও বলেছেন, "আমি শক্তিহীন বোধ করছি এবং ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছি না।"
আমরা তখনই অর্জুনের এই অবস্থা বুঝতে পারবো যখন আমরা অর্জুনের জায়গায় নিজেকে রেখে সেই ধর্মক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজেদের লোকদের সাথে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করবো। অর্জুনের মতো একজন বীর ও সাহসী মানুষের এই অবস্থা হয়েছে। জীবনে এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি আর হতে পারে না।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আমরা এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতির কিভাবে সম্মুখীন হওয়া যায়, তার দিশা খুঁজে পাই।
আমাদের জীবনের প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত তার উত্তর আমরা ভগবদ্গীতায় পাই। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভগবদ্গীতায় আমরা জীবন বিষয়ক সমস্ত প্রশ্নের সমাধান পেতে পারি।
সঞ্জয় যুদ্ধের বর্ণন করে জানাচ্ছেন যে এখন অর্জুন বলছেন, "আমার গাণ্ডীব ধনুক আমার হাত থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে, আমার ত্বক জ্বলছে,, আমার মন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, আমি কিছুই অনুভব করছি না, বুঝতে পারছি না। " দেখুন, অন্যতম সেরা তীরন্দাজ, বিষাদগ্রস্থ হওয়ার কারণে, তার এই অবস্থা হয়েছে !
অর্জুন আরও বলেছেন, "আমি শক্তিহীন বোধ করছি এবং ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছি না।"
আমরা তখনই অর্জুনের এই অবস্থা বুঝতে পারবো যখন আমরা অর্জুনের জায়গায় নিজেকে রেখে সেই ধর্মক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজেদের লোকদের সাথে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করবো। অর্জুনের মতো একজন বীর ও সাহসী মানুষের এই অবস্থা হয়েছে। জীবনে এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি আর হতে পারে না।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আমরা এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতির কিভাবে সম্মুখীন হওয়া যায়, তার দিশা খুঁজে পাই।
আমাদের জীবনের প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত তার উত্তর আমরা ভগবদ্গীতায় পাই। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভগবদ্গীতায় আমরা জীবন বিষয়ক সমস্ত প্রশ্নের সমাধান পেতে পারি।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি, বিপরীতানি কেশব
ন চে শ্রেয়োsনুপশ্যামি, হত্বা স্বজনমাহবে ॥31॥
হে কেশব ! আমি অশুভ লক্ষণ সকল দেখছি এবং যুদ্ধে স্বজনদের হত্যা করে আমি কোনও মঙ্গল দেখছি না।
বিবেচন: মনের এই অবস্থায় অর্জুন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুনরায় চিন্তা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, যা কিছু ঘটছে বা যা কিছুই ঘটতে চলেছে, তা একেবারেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, "হে শ্রী কৃষ্ণ! এই স্থানে অমঙ্গলসূচক লক্ষণসমূহ দৃশ্যমান। আমার কাছে এই সমস্ত কিছুই অশুভ মনে হচ্ছে। এই যুদ্ধে আত্মীয়-পরিজনদের হত্যা করা যে কোনো ভাবেই কল্যাণকারী হতে পারে, তা আমার মনে হয় না।"
যতক্ষণ না আমরা অর্জুনের এই মনঃস্থিতি বুঝে নিতে পারছি, ততক্ষণ আমরা ভগবদ্গীতার জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারবো না। অতএব, অর্জুনের মানসিক অবস্থা বুঝে নেওয়া সমস্ত গীতা সাধকদের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক।
যতক্ষণ না আমরা অর্জুনের এই মনঃস্থিতি বুঝে নিতে পারছি, ততক্ষণ আমরা ভগবদ্গীতার জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারবো না। অতএব, অর্জুনের মানসিক অবস্থা বুঝে নেওয়া সমস্ত গীতা সাধকদের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং(ঙ্) কৃষ্ণ, ন চ রাজ্যং(ম্) সুখানি চ
কিং(ন্) নো রাজ্যেন গোবিন্দ, কিং(ম্) ভোগৈর্জীবিতেন বা॥32॥
হে কৃষ্ণ ! আমি জয় চাই না, রাজ্য ও সুখভোগও চাই না। হে গোবিন্দ ! আমাদের রাজ্যে কী প্রয়োজন আর সুখভোগে ও জীবনধারণেই বা কী প্রয়োজন?
বিবেচন : অর্জুনের মনে কি যুদ্ধের প্রতি ঔদাসীন্য জন্মেছে?
তিনি বলছেন, “এই যুদ্ধে আগামী দিনে নিশ্চিত আমার আত্মীয়দের মৃত্যু দেখবো, তাই আমার মনে হচ্ছে, আমি এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে চাই না, কারণ আমি নিজের স্বজনদের হত্যা করেই এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবো।
হে গোবিন্দ! এমন রাজ্যের কি বা প্রায়োজন আছে, যা স্বজনকে হত্যা করে প্রাপ্ত করতে হবে? এমন সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা কেনই বা করবো, যা শুধুমাত্র এই ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে উপলব্ধ হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে যে এমন জীবন ধারনেরই বা কী প্রয়োজন?"
অর্জুনের মনটা এতটাই বিষাদময়, চরম বিষাদে ভরে গেছে যে অর্জুনের জীবনের প্রতি অনীহার ভাব দেখা যাচ্ছে।
আমাদের বুঝতে হবে যে অর্জুন এখন যে অবস্থায় আছেন তাতে তিনি জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, আবার যখন শ্রী ভগবান অর্জুনকে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেন, তখন অর্জুন পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং নিজের ক্ষত্রিয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন।
অতএব, যখনই একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বিষাদগ্রস্থ হয়ে যায় বা এমন মনঃস্থিতি হয় যে সে জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে যায়, অবসাদগ্রস্থ(depression) হয়ে পড়ে, এমনকি আত্মহত্যা করার চিন্তাও করে (suicidal thoughts), তখন যদি সেই ব্যক্তি ভগবদ্গীতা পাঠ করে, তাহলে সে সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং অর্জুনের মতো জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে এবং কর্তব্যের পথে অগ্রসর হয়ে একটি নতুন জীবন আরম্ভ করতে পারে।
তিনি বলছেন, “এই যুদ্ধে আগামী দিনে নিশ্চিত আমার আত্মীয়দের মৃত্যু দেখবো, তাই আমার মনে হচ্ছে, আমি এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে চাই না, কারণ আমি নিজের স্বজনদের হত্যা করেই এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবো।
হে গোবিন্দ! এমন রাজ্যের কি বা প্রায়োজন আছে, যা স্বজনকে হত্যা করে প্রাপ্ত করতে হবে? এমন সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা কেনই বা করবো, যা শুধুমাত্র এই ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে উপলব্ধ হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে যে এমন জীবন ধারনেরই বা কী প্রয়োজন?"
অর্জুনের মনটা এতটাই বিষাদময়, চরম বিষাদে ভরে গেছে যে অর্জুনের জীবনের প্রতি অনীহার ভাব দেখা যাচ্ছে।
আমাদের বুঝতে হবে যে অর্জুন এখন যে অবস্থায় আছেন তাতে তিনি জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, আবার যখন শ্রী ভগবান অর্জুনকে ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রদান করেন, তখন অর্জুন পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং নিজের ক্ষত্রিয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন।
অতএব, যখনই একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বিষাদগ্রস্থ হয়ে যায় বা এমন মনঃস্থিতি হয় যে সে জীবনের প্রতি উদাসীন হয়ে যায়, অবসাদগ্রস্থ(depression) হয়ে পড়ে, এমনকি আত্মহত্যা করার চিন্তাও করে (suicidal thoughts), তখন যদি সেই ব্যক্তি ভগবদ্গীতা পাঠ করে, তাহলে সে সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং অর্জুনের মতো জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে এবং কর্তব্যের পথে অগ্রসর হয়ে একটি নতুন জীবন আরম্ভ করতে পারে।
য়েষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং(ন্) নো, রাজ্যং(ম্) ভোগাঃ(স্) সুখানি চ
ত ইমেsবস্থিতা য়ুদ্ধে, প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ ॥33॥
আমরা যাঁদের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখাদি কামনা করি তাঁরাই অর্থ এবং প্রাণের আশা ত্যাগ করে যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হয়েছে।
বিবেচন: অর্জুন বলেন, “আমি যে স্বজনদের জন্য রাজ্য ও ভোগসুখের কামনা করে রাজ্য প্রাপ্ত করতে চেয়েছিলাম, তারাই এই যুদ্ধে আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত।
এই সমস্ত প্রিয়জনেরা তাদের জীবন এবং অর্থের অপব্যয় করতে প্রস্তুত। তাহলে কিসের জন্য আমি এমন রাজ্য প্রাপ্ত করতে চাই?"
ভাবুন! প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে আমরা কি কখনো কোনো সুখ উপভোগ করতে পারি? এটাই অর্জুন এখানে বলতে চাইছেন।
এই সমস্ত প্রিয়জনেরা তাদের জীবন এবং অর্থের অপব্যয় করতে প্রস্তুত। তাহলে কিসের জন্য আমি এমন রাজ্য প্রাপ্ত করতে চাই?"
ভাবুন! প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে আমরা কি কখনো কোনো সুখ উপভোগ করতে পারি? এটাই অর্জুন এখানে বলতে চাইছেন।
আচার্য়া:(ফ্) পিতরঃ(ফ্) পুত্রাঃ(স্), তথৈব চ পিতামহাঃ
মাতুলা:(শ্) শ্বশুরাঃ(ফ্) পৌত্রা:(শ্), শ্যালাঃ (স্) সম্বন্ধিনস্তথা॥34॥
আচার্যগণ, পিতৃব্যগণ, পুত্রগণ, পিতামহগণ, মাতুলগণ, শ্বশুরগণ, পৌত্রগণ, শ্যালকগণ এবং অন্যান্য আত্মীয়গণও উপস্থিত রয়েছেন।
বিবেচন : কারা এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের প্রাণের আহুতি দিতে এসেছেন?
অর্জুন বলছেন, "আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও আত্মীয়স্বজন, সকলেই নিজের প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে এই যুদ্ধক্ষেত্রে একত্রিত হয়েছেন। এইভাবে, এই যুদ্ধে, আমার সমস্ত বন্ধু এবং আত্মীয়রা একে অপরকে হত্যা করবে এবং আমি তা চাই না।"
অর্জুনের মন এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে অনুকম্পায় ভরে ওঠে।
অর্জুন বলছেন, "আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও আত্মীয়স্বজন, সকলেই নিজের প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে এই যুদ্ধক্ষেত্রে একত্রিত হয়েছেন। এইভাবে, এই যুদ্ধে, আমার সমস্ত বন্ধু এবং আত্মীয়রা একে অপরকে হত্যা করবে এবং আমি তা চাই না।"
অর্জুনের মন এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে অনুকম্পায় ভরে ওঠে।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি, ঘ্নতোsপি মধুসূদন
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য, হেতোঃ(খ্) কিং(ন্) নু মহীকৃতে॥35॥
হে মধুসূদন ! আমাকে বধ করলে অথবা তিনলোকের রাজ্যের জন্যও আমি কোনো মতেই এঁদের বধ করতে চাই না, অতএব পৃথিবীর রাজত্বের তো কথাই নেই।
বিবেচন : অর্জুন বলেন, "হে মধুসূদন! তারা আমাকে আক্রমণ করলেও, আমাকে হত্যা করলেও, আমি তাদের হত্যা করতে চাই না। হস্তিনাপুরের মতো ছোট রাজ্যর বদলে যদি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমি সমগ্র ত্রিলোকের রাজ্য প্রাপ্ত করে নিতে পারতাম, তবুও আমি এই যুদ্ধ করতে চাইতাম না।"
অর্জুনের এই কথা বলার অর্থ হলো যে, এই যুদ্ধ করে হয়তো আমি অনেক কিছুই প্রাপ্ত করতে পারি, কিন্তু তবুও আমি এই যুদ্ধ করতে চাই না।
অর্জুন কি ভুল বলছেন?
না, তিনি তো সত্য কথাই বলেছেন। আমাদেরও বহুবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
এই প্রথম অধ্যায়ে অর্জুনের ভূমিকা আমাদের বুঝতে হবে!
এই অধ্যায়ে অর্জুনের মনের অবস্থা কী? এটা আমাদের বুঝতে হবে।
শঙ্খনাদ করে, হাতে ধনুক উঠিয়ে, কারা আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছেন, তাদের আমি দেখতে চাই! এই বলে অর্জুন যখন তার সম্মুখে নিজের আত্মীয়-পরিজনদের দেখলেন, তখন মুহূর্তের মধ্যে তার মন উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো এবং তার হৃদয় পরিবর্তন হয়ে গেলো, তার মন করুণায় ভরে উঠলো।
অর্জুনের এই কথা বলার অর্থ হলো যে, এই যুদ্ধ করে হয়তো আমি অনেক কিছুই প্রাপ্ত করতে পারি, কিন্তু তবুও আমি এই যুদ্ধ করতে চাই না।
অর্জুন কি ভুল বলছেন?
না, তিনি তো সত্য কথাই বলেছেন। আমাদেরও বহুবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
এই প্রথম অধ্যায়ে অর্জুনের ভূমিকা আমাদের বুঝতে হবে!
এই অধ্যায়ে অর্জুনের মনের অবস্থা কী? এটা আমাদের বুঝতে হবে।
শঙ্খনাদ করে, হাতে ধনুক উঠিয়ে, কারা আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছেন, তাদের আমি দেখতে চাই! এই বলে অর্জুন যখন তার সম্মুখে নিজের আত্মীয়-পরিজনদের দেখলেন, তখন মুহূর্তের মধ্যে তার মন উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো এবং তার হৃদয় পরিবর্তন হয়ে গেলো, তার মন করুণায় ভরে উঠলো।
নিহত্য ধার্তরাষ্ট্রান্ন:(খ্), কা প্রীতি:(স্) স্য়াজ্জনার্দন
পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্, হত্বৈতানাততায়িন: ॥36॥
হে জনার্দন ! ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে আমাদের কী সুখ হবে ? এইসকল আততায়ীদের বধ করলে তো আমাদের পাপই হবে।
বিবেচন : অর্জুন বলেন, "হে মধুসূদন! ধৃতরাষ্ট্রের আততায়ী(হিংস্র শত্রু) পুত্রদের হত্যা করে আমাদের কিই বা লাভ হবে? শুধুমাত্র হত্যার করার জন্য পাপের ভাগীই হবো।"
এই সময় অর্জুনের মন থেকে একটি শব্দ বের হচ্ছে: আততায়িনঃ,
আমাদের শাস্ত্র অনুসারে, একজন আততায়ী হলো সেই ব্যক্তি যার মধ্যে নিম্নলিখিত ছয়টি দোষের যে কোনো একটি রয়েছে:
- যে অন্যের সম্পদ লুট করে,
- যে অন্যের স্ত্রীকে অপহরণ করে,
- যে অন্যের জমি দখল করে,
- যে শস্ত্র চালিয়ে অন্যকে আক্রমণ করে,
- যে অন্যের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়, বা
- যে অন্যের ওপর বিষ প্রয়োগ করে।
দুর্যোধনের স্বভাবে ও আচরণে এই দোষগুলি উপস্থিত ছিল। সে পাণ্ডবদের লাক্ষাগৃহে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল এবং ভীমের ওপর বিষ প্রয়োগ করেছিল। শুধুমাত্র বাসস্থান নয়, পাণ্ডবদের সমগ্র রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল এবং তাদের সম্পদ লুট করেছিলেন।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে আততায়ী ব্যক্তিকে হত্যা করলে কোনো পাপ হয় না।
এখানে অর্জুনের মনের অবস্থা এমন যে, দুর্যোধন আততায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি দুর্যোধনকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলেন কারণ সে অর্জুনের ভ্রাতা। শাস্ত্র জানার পরও অর্জুন বলছেন যে এই আততায়ীদের হত্যা করলে আমিই দোষী হবো। আমি এমন পাপের ভাগী হতে চাই না। আমি ত্রিলোকের রাজ্যপাটও চাই না।
অর্জুনের মনে তার আত্মীয়-পরিজনদের জন্য মোহ জেগে উঠেছে । একইভাবে সাধারণ মানুষও স্বজনদের প্রতি মোহের আবেশে নিজের কর্তব্য ভুলে যায়।
অর্জুন এখন সেই একই অবস্থায় রয়েছেন।
অর্জুনের মনে কি কি চিন্তা-ভাবনার আনাগোনা চলছে এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কি কথা বলবেন, তা আমরা পরবর্তী বিবেচন সত্রে দেখবো।
অর্জুনকে দেখার ও বোঝার প্রচেষ্টাকে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের চরণকমলে অর্পিত করে সাধকদের প্রশ্নের সমাধানের মাধ্যমে আজকের বিবেচন সত্র শেষ হলো।
প্রশ্নকর্তা- মলয় ভাইয়া
প্রশ্ন – এই অধ্যায়টি হলো অর্জুনবিষাদ যোগ। কঠিন পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মার্গদর্শন করেছিলেন। আজ আমাদের কে মার্গদর্শন করবে? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে কিন্তু সর্বদা সেটা করা কঠিন হয়ে পড়ে, কিভাবে সারা জীবন তা অনুসরণ করা যায়? আমরা আমাদের বিকার বা বিকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, এর সমাধান কী?
উত্তর - অর্জুনের সারথি হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাকে ভগবদ্গীতার মাধ্যমে জ্ঞান প্রদান করেন এবং অর্জুনকে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের করে এনেছিলেন। ভগবদ্গীতা শুধু একটি গ্রন্থ নয়, এটি শ্রীকৃষ্ণের বাঙ্ময় রূপ । আমরা যে গীতা পড়ছি তা শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই এটা বলা যেতে পারে যে শ্রীকৃষ্ণই আমাদের সঠিক পথ দেখাচ্ছেন।
।।জয়তু জয়তু গীতা, বাঙ্ময়ী কৃষ্ণ রূপী।।
পরমাত্মা বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। এর জন্য আমাদের নিজের আত্মরূপকে চিনতে হবে।
আমাদের মন চঞ্চল, সেই জন্য বিকার-বিকৃতির নিয়ন্ত্রণ, অনুশীলনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন-
এই বিষয়ে শ্রী ভগবান তাঁকে অনুশীলনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন যে মন যে চঞ্চল তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ষোড়শ অধ্যায়ে যে যে দৈবী সম্পদের লক্ষণ বলা হয়েছে, তা কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তিতে রাতারাতি আসতে পারে না, তা কেবল অনুশীলনের মাধ্যমেই আসতে পারে। যেমন একটি লোহার টুকরোকে চুম্বক বানানোর জন্য বারবার অন্য চুম্বকের উপর ঘষতে হয়, তেমনি গীতাজীকে বারবার পাঠ করার অভ্যাস করা উচিত।
শরীর শুদ্ধ করার জন্য যেমন আমরা প্রতিদিন স্নান করি, ঠিক সেইভাবেই প্রতিদিন গীতা পাঠ করলে মন শুদ্ধ হয়ে যায়।
জ্ঞানেশ্বর মহারাজ ষোলো বছর বয়সে জ্ঞানেশ্বরী লিখে সাধারণ মানুষকে ভগবদ্গীতার গভীর অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং বাইশ বছরে তিনি সমাধি লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেন যে, এ হলো তার লক্ষ লক্ষ জন্মের তপস্যা যে তিঁনি ভগবদ্গীতার ওপর ভাষ্য লিখতে পেরেছেন।
যোগ অনুশীলন বা গীতা অনুশীলন কখনই বৃথা যায় না, পরবর্তী জন্মেও এই অনুশীলন চলতে থাকবে।
ভগবান বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে তিনি যে গাছের নীচে বসে ধ্যান করছিলেন, সেই গাছের যতগুলি পাতা আছে, আত্ম-উপলব্ধি পেতে তত বছর সময় লাগবে। দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে এটা সম্ভব হতে পারে।
প্রশ্নকর্তা- সচ্চিদানন্দ পান্ডা ভাইয়া
প্রশ্ন - মহাভারতের যুদ্ধে পিতামহ ভীষ্ম কৌরবদের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনি প্রথম শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা করেছিলেন। ধ্রুষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের সেনাপতি ছিলেন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে প্রথমে শঙ্খ বাজিয়েছিলেন, যদিও তিনি অর্জুনের সারথি ছিলেন। এটা কি একটা প্রচলিত নিয়মকে লঙ্ঘন করা হলো না?
উত্তর - যদিও শ্রী কৃষ্ণ সারথি হয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন এবং অস্ত্র না নেওয়ার শপথও নিয়েছিলেন, কিন্তু পাণ্ডবদের মনে তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা বিশ্বাস ছিলো এবং তাদের অন্তর থেকে তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই তাদের সেনাপতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, পাণ্ডবদের কাছে তিঁনিই তাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। .
সারথির ভূমিকায় যুদ্ধে যোগদান করে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন। তাঁর ভক্ত ভীষ্ম পিতামহের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন এবং শস্ত্র তুলে নিয়ে ভীষ্মের সাথে যুদ্ধ করেন। তাই পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খ বাজানো, যিনি মানুষকে নিজের কর্তব্য করতে অনুপ্রেরিত করেন, তাকে নিয়ম লঙ্ঘন করা বলা যায় না।
প্রশ্নকর্তা: টেক পাপনেজা ভাইয়া
প্রশ্ন- দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত করার জন্য আমাদের কী সাধনা করতে হবে?
উত্তর: সদগুরুর কাছ থেকেই দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত করা যায়।
সাধারণত চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা হলে আমরা চশমা পরি। আমরা স্পর্শের মাধ্যমে বায়ু অনুভব করি, কিন্তু বাতাসে স্থিত তত্ত্বগুলি জানতে বিজ্ঞান দৃষ্টি প্রয়োজন।
একইভাবে, আত্মতত্ত্বকে অনুভব করার জন্য জ্ঞান চক্ষু আবশ্যক, যা শুধুমাত্র একজন সদগুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত করা যায়।
আত্মদৃষ্টি প্রাপ্ত করে নিলে সর্বত্র এবং সমস্ত জীবের মধ্যে পরমাত্মাকে অনুভব করা যায়।
প্রশ্নকর্তা - প্রেমনাথ উপাধ্যায় ভাইয়া
প্রশ্ন - আমরা রামায়ণে পড়েছি যে শ্রী রামকে শত্রুহত্যা করার যে দোষ, সেই দোষ মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধে শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে হত্যা করলে পাপ হবে না। অর্জুন কেন হত্যার দোষ মুক্তির জন্য কোন ব্যবস্থা নেননি?
উত্তর- শ্রী কৃষ্ণ অষ্টাদশ অধ্যায়ে বলেছেন -
তাই হয়তো শ্রী রাম তার দেহের দোষ মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
উত্তর – মূল জ্ঞানেশ্বরী মারাঠি ভাষায় লেখা হয়েছে, এতে মন্ত্রময়ী ওভি রয়েছে । এটি পড়তে ও বুঝতে হলে মূল লেখাটি হিন্দি অনুবাদের সাথে পড়তে হবে। স্বামী গোবিন্দ দেব গিরি জী মহারাজের উপদেশ "মহাভারত কথা সন্দেশ" শুনলে যেমন মহাভারত সহজে বোঝা যায়, তেমনি গুরুজীর জ্ঞানেশ্বরীর ধর্মোপদেশ শুনে জ্ঞানেশ্বরী বোঝা যায়। এটি পুনের ধর্মশ্রী অফিস থেকে একটি পেনড্রাইভ আকারে প্রাপ্ত করতে পারেন।
প্রশ্নকর্তা - কানহাইয়া নগর ভাইয়া
প্রশ্ন - ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ে, অর্জুন যুদ্ধের ফলস্বরূপ বর্ণ সংকর দোষের কথা বলেছেন। বর্তমান সমাজে আমরা দেখছি যে বিজাতীয় বিবাহের প্রচলন শুরু হয়েছে। তারা কি সকলেই নরকে যাবেন?
উত্তর - ভগবদ্গীতায় বর্ণ সঙ্কর বলা হয়েছে, জাতি সঙ্কর নয়। চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রী ভগবান বলেছেন-
গুণ বংশানুগতিক হয়। ইহজন্মের কর্ম ও পূর্ব জন্মের কর্ম অনুসারে প্রকৃতি গঠিত হয়। তাই বর্ণ কেবল জন্ম দিয়ে নির্ণয় করা হয় না। বিজাতীয় বিবাহের কারণে দুই বর্ণের গুণ মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে শুদ্ধতা বিনষ্ট হচ্ছে।
।।শ্রী কৃষ্ণার্পণমস্তু।।
এই সময় অর্জুনের মন থেকে একটি শব্দ বের হচ্ছে: আততায়িনঃ,
আমাদের শাস্ত্র অনুসারে, একজন আততায়ী হলো সেই ব্যক্তি যার মধ্যে নিম্নলিখিত ছয়টি দোষের যে কোনো একটি রয়েছে:
- যে অন্যের সম্পদ লুট করে,
- যে অন্যের স্ত্রীকে অপহরণ করে,
- যে অন্যের জমি দখল করে,
- যে শস্ত্র চালিয়ে অন্যকে আক্রমণ করে,
- যে অন্যের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়, বা
- যে অন্যের ওপর বিষ প্রয়োগ করে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে আততায়ী ব্যক্তিকে হত্যা করলে কোনো পাপ হয় না।
এখানে অর্জুনের মনের অবস্থা এমন যে, দুর্যোধন আততায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি দুর্যোধনকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলেন কারণ সে অর্জুনের ভ্রাতা। শাস্ত্র জানার পরও অর্জুন বলছেন যে এই আততায়ীদের হত্যা করলে আমিই দোষী হবো। আমি এমন পাপের ভাগী হতে চাই না। আমি ত্রিলোকের রাজ্যপাটও চাই না।
অর্জুনের মনে তার আত্মীয়-পরিজনদের জন্য মোহ জেগে উঠেছে । একইভাবে সাধারণ মানুষও স্বজনদের প্রতি মোহের আবেশে নিজের কর্তব্য ভুলে যায়।
অর্জুন এখন সেই একই অবস্থায় রয়েছেন।
অর্জুনের মনে কি কি চিন্তা-ভাবনার আনাগোনা চলছে এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কি কথা বলবেন, তা আমরা পরবর্তী বিবেচন সত্রে দেখবো।
অর্জুনকে দেখার ও বোঝার প্রচেষ্টাকে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের চরণকমলে অর্পিত করে সাধকদের প্রশ্নের সমাধানের মাধ্যমে আজকের বিবেচন সত্র শেষ হলো।
:: প্রশ্নোত্তর পর্ব ::
প্রশ্নকর্তা- মলয় ভাইয়া
প্রশ্ন – এই অধ্যায়টি হলো অর্জুনবিষাদ যোগ। কঠিন পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মার্গদর্শন করেছিলেন। আজ আমাদের কে মার্গদর্শন করবে? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শিক্ষা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে কিন্তু সর্বদা সেটা করা কঠিন হয়ে পড়ে, কিভাবে সারা জীবন তা অনুসরণ করা যায়? আমরা আমাদের বিকার বা বিকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, এর সমাধান কী?
উত্তর - অর্জুনের সারথি হয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাকে ভগবদ্গীতার মাধ্যমে জ্ঞান প্রদান করেন এবং অর্জুনকে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের করে এনেছিলেন। ভগবদ্গীতা শুধু একটি গ্রন্থ নয়, এটি শ্রীকৃষ্ণের বাঙ্ময় রূপ । আমরা যে গীতা পড়ছি তা শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী, তাই এটা বলা যেতে পারে যে শ্রীকৃষ্ণই আমাদের সঠিক পথ দেখাচ্ছেন।
।।জয়তু জয়তু গীতা, বাঙ্ময়ী কৃষ্ণ রূপী।।
পরমাত্মা বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হন। এর জন্য আমাদের নিজের আত্মরূপকে চিনতে হবে।
আমাদের মন চঞ্চল, সেই জন্য বিকার-বিকৃতির নিয়ন্ত্রণ, অনুশীলনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন-
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৬.৩৪॥
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৬.৩৪॥
এই বিষয়ে শ্রী ভগবান তাঁকে অনুশীলনের গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন যে মন যে চঞ্চল তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৬.৩৫॥
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৬.৩৫॥
শরীর শুদ্ধ করার জন্য যেমন আমরা প্রতিদিন স্নান করি, ঠিক সেইভাবেই প্রতিদিন গীতা পাঠ করলে মন শুদ্ধ হয়ে যায়।
জ্ঞানেশ্বর মহারাজ ষোলো বছর বয়সে জ্ঞানেশ্বরী লিখে সাধারণ মানুষকে ভগবদ্গীতার গভীর অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং বাইশ বছরে তিনি সমাধি লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেন যে, এ হলো তার লক্ষ লক্ষ জন্মের তপস্যা যে তিঁনি ভগবদ্গীতার ওপর ভাষ্য লিখতে পেরেছেন।
যোগ অনুশীলন বা গীতা অনুশীলন কখনই বৃথা যায় না, পরবর্তী জন্মেও এই অনুশীলন চলতে থাকবে।
ভগবান বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে তিনি যে গাছের নীচে বসে ধ্যান করছিলেন, সেই গাছের যতগুলি পাতা আছে, আত্ম-উপলব্ধি পেতে তত বছর সময় লাগবে। দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে এটা সম্ভব হতে পারে।
প্রশ্ন - মহাভারতের যুদ্ধে পিতামহ ভীষ্ম কৌরবদের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনি প্রথম শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা করেছিলেন। ধ্রুষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের সেনাপতি ছিলেন কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে প্রথমে শঙ্খ বাজিয়েছিলেন, যদিও তিনি অর্জুনের সারথি ছিলেন। এটা কি একটা প্রচলিত নিয়মকে লঙ্ঘন করা হলো না?
উত্তর - যদিও শ্রী কৃষ্ণ সারথি হয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন এবং অস্ত্র না নেওয়ার শপথও নিয়েছিলেন, কিন্তু পাণ্ডবদের মনে তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা বিশ্বাস ছিলো এবং তাদের অন্তর থেকে তারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই তাদের সেনাপতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, পাণ্ডবদের কাছে তিঁনিই তাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। .
সারথির ভূমিকায় যুদ্ধে যোগদান করে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন। তাঁর ভক্ত ভীষ্ম পিতামহের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন এবং শস্ত্র তুলে নিয়ে ভীষ্মের সাথে যুদ্ধ করেন। তাই পাণ্ডবদের পক্ষ থেকে প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খ বাজানো, যিনি মানুষকে নিজের কর্তব্য করতে অনুপ্রেরিত করেন, তাকে নিয়ম লঙ্ঘন করা বলা যায় না।
প্রশ্নকর্তা: টেক পাপনেজা ভাইয়া
প্রশ্ন- দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত করার জন্য আমাদের কী সাধনা করতে হবে?
উত্তর: সদগুরুর কাছ থেকেই দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত করা যায়।
সাধারণত চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা হলে আমরা চশমা পরি। আমরা স্পর্শের মাধ্যমে বায়ু অনুভব করি, কিন্তু বাতাসে স্থিত তত্ত্বগুলি জানতে বিজ্ঞান দৃষ্টি প্রয়োজন।
একইভাবে, আত্মতত্ত্বকে অনুভব করার জন্য জ্ঞান চক্ষু আবশ্যক, যা শুধুমাত্র একজন সদগুরুর কাছ থেকে প্রাপ্ত করা যায়।
আত্মদৃষ্টি প্রাপ্ত করে নিলে সর্বত্র এবং সমস্ত জীবের মধ্যে পরমাত্মাকে অনুভব করা যায়।
প্রশ্নকর্তা - প্রেমনাথ উপাধ্যায় ভাইয়া
প্রশ্ন - আমরা রামায়ণে পড়েছি যে শ্রী রামকে শত্রুহত্যা করার যে দোষ, সেই দোষ মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধে শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে হত্যা করলে পাপ হবে না। অর্জুন কেন হত্যার দোষ মুক্তির জন্য কোন ব্যবস্থা নেননি?
উত্তর- শ্রী কৃষ্ণ অষ্টাদশ অধ্যায়ে বলেছেন -
স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।।১৮.৪৫।।
নিজের স্বাভাবিক কর্তব্য পালন করলে পাপ হয় না। অন্যায়কারীকে হত্যা করা একজন ক্ষত্রিয়র কর্তব্য এবং অর্জুনও একজন ক্ষত্রিয় ছিলেন, তাই তিনি দোষী নন। তাই হয়তো শ্রী রাম তার দেহের দোষ মুক্তির জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
প্রশ্নকর্তা- শ্রী প্রেমনাথ উপাধ্যায়
প্রশ্ন - জ্ঞানেশ্বরী মূল রূপে কোথায় পাওয়া যাবে??উত্তর – মূল জ্ঞানেশ্বরী মারাঠি ভাষায় লেখা হয়েছে, এতে মন্ত্রময়ী ওভি রয়েছে । এটি পড়তে ও বুঝতে হলে মূল লেখাটি হিন্দি অনুবাদের সাথে পড়তে হবে। স্বামী গোবিন্দ দেব গিরি জী মহারাজের উপদেশ "মহাভারত কথা সন্দেশ" শুনলে যেমন মহাভারত সহজে বোঝা যায়, তেমনি গুরুজীর জ্ঞানেশ্বরীর ধর্মোপদেশ শুনে জ্ঞানেশ্বরী বোঝা যায়। এটি পুনের ধর্মশ্রী অফিস থেকে একটি পেনড্রাইভ আকারে প্রাপ্ত করতে পারেন।
প্রশ্নকর্তা - কানহাইয়া নগর ভাইয়া
প্রশ্ন - ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ে, অর্জুন যুদ্ধের ফলস্বরূপ বর্ণ সংকর দোষের কথা বলেছেন। বর্তমান সমাজে আমরা দেখছি যে বিজাতীয় বিবাহের প্রচলন শুরু হয়েছে। তারা কি সকলেই নরকে যাবেন?
উত্তর - ভগবদ্গীতায় বর্ণ সঙ্কর বলা হয়েছে, জাতি সঙ্কর নয়। চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রী ভগবান বলেছেন-
চাতুর্বর্ণ্যম্
ময়া সৃষ্টম্, গুণ কর্ম বিভাগশঃ ।।৪.১৩।।
গুণ ও কর্মের বিভাজন অনুসারে ভগবান শ্রী চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছেন – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। গুণ এবং কর্ম প্রকৃতিপ্রদত্ত হয়, যেমন একজন ব্যবসায়ীর সন্তানকে ব্যবসার খুঁটিনাটি শেখাতে হয় না, এটি তার স্বভাবগত গুণ(জেনেটিক)।ময়া সৃষ্টম্, গুণ কর্ম বিভাগশঃ ।।৪.১৩।।
গুণ বংশানুগতিক হয়। ইহজন্মের কর্ম ও পূর্ব জন্মের কর্ম অনুসারে প্রকৃতি গঠিত হয়। তাই বর্ণ কেবল জন্ম দিয়ে নির্ণয় করা হয় না। বিজাতীয় বিবাহের কারণে দুই বর্ণের গুণ মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে শুদ্ধতা বিনষ্ট হচ্ছে।
।।শ্রী কৃষ্ণার্পণমস্তু।।