विवेचन सारांश
কর্মের প্রেরণা এবং কর্ম ও জ্ঞানের প্রকার
পরম্পরাগত ভাবে দীপ প্রজ্জ্বলন এবং গুরু বন্দনার মাধ্যমে অষ্টাদশ অধ্যায়ের বিবেচন শুরু হয়। নবরাত্রির শুভ উৎসবে ভগবদ্গীতার চিন্তা করার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। জ্ঞানেশ্বর মৌলি বলেছেন গীতা মহিষাসুরমর্দিনী। গীতা মোহ রূপী মহিষাসুরকে নাশ করে। এটিও সাতশত শ্লোকের এবং তাই এটিও সপ্তশতী। গীতা রূপী মন্দিরের কলসাধ্যায় রূপে এই অষ্টাদশ অধ্যায়ের মনন করা হচ্ছে। যেমন মন্দিরে কলস দর্শন করলেই বিগ্রহের দর্শন লাভ হয়, তেমনি অষ্টাদশ অধ্যায় মনন করলে সম্পূর্ণ গীতা পাঠের আনন্দ লাভ করা যায়। কোন কর্মের পূর্ণতার জন্য শ্রী ভগবান পাঁচটি আবশ্যক কথা বলেছেন। সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো অধিষ্ঠান। যদি আমরা একজন ব্যক্তির কথা ভাবি, তাহলে এই শরীর হলো আমাদের আধিষ্ঠান। দ্বিতীয়, কর্তা থাকা আবশ্যক, অর্থাৎ জীবাত্মা থাকা আবশ্যক। তৃতীয় : করণ বা সাধন, যেমন হাত, পা, চোখ, কান, ত্বক, জিহ্বা ইত্যাদি আমাদের ইন্দ্রিয়সাধন যার মাধ্যমে আমরা কাজ করি। চতুর্থ চেষ্টা অর্থাৎ উদ্যোগ, এটা খুবই প্রয়োজনীয়। ঈশ্বর বলেছেন যে পঞ্চম হলো দৈব। এই দৈব কি? এটাও আমাদের বুঝতে হবে। পূর্বজন্মের কর্মের ফলস্বরূপ আমরা যা প্রাপ্ত করি, তা আমাদের দৈব (পরমাত্মা)। দৈবের চিন্তন আমাদের কর্ম সম্পাদন করার পরেই করা উচিত। কাজ সম্পন্ন হলে, তার কৃতিত্ব দৈবকেই দেওয়া উচিত। কোন কাজ যদি সফল না হয়, তা পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ ঘটেছে, এই বিবেচনা করা উচিত। মানুষকে কর্মোদ্যমী হওয়া উচিত, ভাগ্যবাদী নয়। যা ঘটে গিয়েছে সেই সম্পর্কে দৈবকে মেনে নেওয়া ঠিক আছে, তবে যা এখনো ঘটেনি সে সম্পর্কে ভাগ্যবাদী হওয়া ঠিক নয়, তবে কর্মোদ্যমী হওয়াই শ্রেয়। যে মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যায়, সে অবশ্যই দৈবের অনুগ্রহ লাভ করে। ঈশ্বর বলেন; হে অর্জুন! তুমি নিজের সর্বোত্তম কর্মপ্ৰচেষ্টা করো এবং ভবিষ্যতের চিন্তা ত্যাগ করো।
18.15
শরীরবাঙ্মনোভির্য়ৎ, কর্ম প্রারভতে নরঃ
ন্যায়্যং(ম্) বা বিপরীতং(ম্) বা, পঞ্চৈতে তস্য হেতবঃ॥15॥
শরীর, মন ও বাক্যের দ্বারা মানুষ শাস্ত্রীয় বা অশাস্ত্রীয় যা-কিছু কর্ম করে এই পাঁচটি হল তার কারণ। ১৫
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন যে মানুষ দেহ, মন, বুদ্ধি, বাণী ইত্যাদির মাধ্যমে কর্ম করে। যে কর্ম শাস্ত্র অনুসারেও (সৎকর্ম) হয়, আবার শাস্ত্র বিরুদ্ধও (দুষ্কর্ম) হয় । যে কোনো প্রকার কর্ম পূর্ণ করার জন্য পাঁচটি জিনিসের প্রয়োজন - অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, চেষ্টা ও দৈব।
তত্রৈবং(ম্) সতি কর্তারম্, আত্মানং(ঙ্) কেবলং(ন্) তু য়:
পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বান্, ন স পশ্যতি দুর্মতিঃ॥16॥
এতৎসত্ত্বেও যে-ব্যক্তি অশুদ্ধবুদ্ধি হেতু ঐ কর্ম সম্পাদনে শুদ্ধস্বরূপ আত্মাকেই কর্তা বলে মনে করে, সেই মলিন বুদ্ধিসম্পন্ন অজ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক ঠিক বোঝে না। ১৬
বিবেচন: শ্রীভগবান আরও বলেন, উপরোক্ত পাঁচটি জিনিস থাকা সত্ত্বেও মানুষ অশুদ্ধ বুদ্ধি এবং অসম্পূর্ণ জ্ঞানের কারণে ভেবে নেয় যে সবকিছুই আত্মা দ্বারা হয়েছে অর্থাৎ আমিই করেছি। সে নিজেকেই আত্মা মনে করে নেয়। অথচ বিশুদ্ধ আত্মা এখানে কোথাও বিদ্যমান নেই। এই প্রকারের বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি জ্ঞানকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। দ্বিতীয় অধ্যায় থেকেই ভগবান অর্জুনকে বলেছেন যে তুমি কে? এ দেহ তোমার নয়। এই দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। প্রকৃত রূপ অব্যয় ও অবিনশ্বর। কোন কাজ সম্পূর্ণ করার কর্তা আমি নই, তবে আপনার অস্তিত্বই এর জন্য দায়ী। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন যে যখন বাড়ীতে প্ৰদীপ জ্বলে এবং তার আলোয় চারিদিক প্রকাশিত হওয়ার ফলে যদি গৃহস্থালির সব কাজ চলে, তখন এটা তো বলা যাবে না যে সেই প্রদীপই সব কাজ করেছে, কিন্তু এটাও সত্যি যে প্রদীপ জ্বলার কারণেই সব কাজ হচ্ছে অর্থাৎ তার অস্তিত্বের কারণেই কাজ করা সম্পন্ন হয়েছে। একইভাবে আত্মার আলোকে দেহ দ্বারা কাজ সম্পন্ন হয়।
অর্থাৎ ভগবান সমস্ত প্রাণীদের তাদের কর্মানুযায়ী কাজ করানোর জন্য তাদের অন্তরে সাক্ষী ভাব রেখে পর্যবেক্ষক রূপে স্থিত হয়ে পূর্ণরূপে নির্লিপ্ত থাকেন।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেऽর্জুন তিষ্ঠতি
ভ্রাময়ন্সর্বভূতানি য়ন্ত্রারূঢানি মায়য়া॥১৮.৬১॥
ভ্রাময়ন্সর্বভূতানি য়ন্ত্রারূঢানি মায়য়া॥১৮.৬১॥
অর্থাৎ ভগবান সমস্ত প্রাণীদের তাদের কর্মানুযায়ী কাজ করানোর জন্য তাদের অন্তরে সাক্ষী ভাব রেখে পর্যবেক্ষক রূপে স্থিত হয়ে পূর্ণরূপে নির্লিপ্ত থাকেন।
য়স্য নাহংকৃতো ভাবো, বুদ্ধির্য়স্য ন লিপ্যতে
হত্বাऽপি স ইমাঁল্লোকান্,ন হন্তি ন নিবধ্যতে॥17॥
যে-ব্যক্তির অন্তঃকরণে ‘আমি কর্তা' এই ভাব নেই এবং যাঁর বুদ্ধি সাংসারিক পদার্থ এবং কর্মে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সকলকে হত্যা করলেও প্রকৃতপক্ষে হত্যা করেন না এবং পাপেও লিপ্ত হন না (১)। ১৭
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন মনের মধ্যে অহংবোধ থাকা ঠিক নয়। ভগবান বলেছেন আট প্রকারের প্রকৃতি আছে - অষ্টধা প্রকৃতি। অহং প্রকৃতির একটি প্রকার। এ আত্মা নয়। যার স্বভাবে কর্তাভাব নেই এবং যার বুদ্ধি লিপ্ত নয়, সে সর্বদা মুক্ত থাকে। মন থেকে এই "আমি" ভাব সহজে যায় না। এটি কেবল নিরন্তর গীতা অধ্যয়নের দ্বারাই সম্ভব। যক্ষ ধর্মরাজকে প্রশ্ন করলেন – পৃথিবীতে সবচেয়ে পূজনীয় কে? ধর্মরাজ উত্তর দিলেন- যার অহংকার বিলুপ্ত (নিশ্চিহ্ন) হয়েছে কারণ যার অহংকারের বিনাশ হয়েছে, সে শুদ্ধ পরমাত্মা রূপ লাভ করে। মারাঠি কবি শ্রী বহবো ভোবকরের একটি সুন্দর কবিতা আছে - যার সারমর্ম হল "জীবনের অর্থ সেই ব্যক্তিই বুঝতে পারে যার অহংকার সমাপ্ত হয়ে গেছে। "আমার অহং নেই", কেউ যদি এটা বলে তাহলেও এ তার অহংকার ভাব। নিষ্কাম কর্মযোগ আমাদের অহংকার থেকে মুক্ত করতে পারে। অর্জুন নিজের কর্মের পরিণামের কথা চিন্তা করছিলেন। ভগবান অর্জুনকে বললেন যে যদি বুদ্ধি অহং ভাব থেকে মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে কেউ কারোকে হত্যা করলেও, হত্যার জন্য সে দায়ী নয়। যতক্ষণ না আমার অহংবোধ নিঃশেষ হয়, ততক্ষণ জানা যাবে না যে 'আমি' কে। আমার মধ্যে যতক্ষণ এই "আমি" ভাব জীবিত থাকবে, ততক্ষণ আমি এই প্রশ্নের উত্তর পাব না। এ প্রসঙ্গে সন্ত কবির বলেন-
जब मैं था तब हरि नहीं, अब हरि है मैं नहीं।
"प्रेम गली अति सांकरी यामे दो न समाय"।
অর্থাৎ : যতদিন মনের মধ্যে অহং ছিল, আমার হৃদয়ে ঈশ্বর ছিলেন না, এখন ঈশ্বর আমার হৃদয়ে বাস করেন, আর সেখানে কোন অহংকার নেই। প্রেমের সরু গলিতে শুধু একজনই থাকতে পারে - হয় অহম নয় পরম ঈশ্বর।
জল্লাদ ফাঁসি দিয়েছে। যাকে সে ফাঁসি দিয়েছিল সে মারা গেল, সে তার কৃতকর্মের ফল পেয়ে গেলো। সেই কয়েদিকে জল্লাদ বা বিচারক, কেউই হত্যা করেনি। মানুষকে কখনও কখনও নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য কঠোর হতে হয়, তাকে তাই হওয়া উচিত। তার এই কাজের দায়িত্ব নিজের ওপর নেওয়া উচিত নয়। ভগবান অর্জুনকে কর্তাভাব থেকে মুক্ত হয়ে তার কর্তব্য করতে বলছেন।
जब मैं था तब हरि नहीं, अब हरि है मैं नहीं।
"प्रेम गली अति सांकरी यामे दो न समाय"।
অর্থাৎ : যতদিন মনের মধ্যে অহং ছিল, আমার হৃদয়ে ঈশ্বর ছিলেন না, এখন ঈশ্বর আমার হৃদয়ে বাস করেন, আর সেখানে কোন অহংকার নেই। প্রেমের সরু গলিতে শুধু একজনই থাকতে পারে - হয় অহম নয় পরম ঈশ্বর।
জল্লাদ ফাঁসি দিয়েছে। যাকে সে ফাঁসি দিয়েছিল সে মারা গেল, সে তার কৃতকর্মের ফল পেয়ে গেলো। সেই কয়েদিকে জল্লাদ বা বিচারক, কেউই হত্যা করেনি। মানুষকে কখনও কখনও নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য কঠোর হতে হয়, তাকে তাই হওয়া উচিত। তার এই কাজের দায়িত্ব নিজের ওপর নেওয়া উচিত নয়। ভগবান অর্জুনকে কর্তাভাব থেকে মুক্ত হয়ে তার কর্তব্য করতে বলছেন।
জ্ঞানং(ঞ্) জ্ঞেয়ং(ম্) পরিজ্ঞাতা, ত্রিবিধা কর্মচোদনা
করণং(ঙ্)কর্ম কর্তেতি, ত্রিবিধঃ(খ্) কর্মসঙ্গ্রহঃ॥18॥
জ্ঞাতা(২), জ্ঞান(৩), জ্ঞেয়(৪)—এই তিনটি হল সকল কর্ম প্রবৃত্তির হেতু এবং কর্তা(৬), করণ(৬), ক্রিয়া(?) এই তিনটি হল কর্মসংগ্রহ। ১৮
বিবেচন: কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রেরণা বা উদ্দীপনার প্রয়োজন। জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা এই তিনটি কর্মই অনুপ্রেরণার জন্য দায়ী। যেমন, বাড়িতে আম আনলে, ঘরে ঢুকতেই আমের সুগন্ধ আমের উপস্থিতি জানান দেয় অর্থাৎ আমের উপস্থিতির জ্ঞান হয়, আম হলো জ্ঞেয়, পরিজ্ঞাতা স্বয়ং আমি এবং এই সবের কারণেই আম খাওয়ার ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল, অর্থাৎ আম খাওয়ার প্রেরণা তৈরি হয়। যেমন, কার (গাড়ী) হলো জ্ঞেয়, কারের ব্যাপারে তথ্য হলো জ্ঞান এবং সেই জ্ঞান আমি প্রাপ্ত করেছি, তাই আমি পরিজ্ঞাতা। এইভাবে জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা, এই তিনটি কারণেই গাড়ি কেনার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। কর্ম সম্পাদনের জন্য আরও তিনটি জিনিসের প্রয়োজন, সাধন (করণ), কর্ম এবং কর্তা। এই তিনটি জিনিস থেকেই কর্ম সংগ্রহ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মাটির বল, একটি চাকা এবং একজন কুমোর। কুমোর মাটির তাল থেকে মাটির ঘট তৈরি করলো। মাটির তাল ও চাকা হয়ে উঠল করণ বা সাধন, কুমোর হল কর্তা এবং পাত্র তৈরির প্রক্রিয়া হল কর্ম। এভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা এবং কর্ম করার ক্রিয়া, ভগবান এখানে ছয়টি কথা বলেছেন।
জ্ঞানং(ঙ্)কর্ম চ কর্তা চ, ত্রিধৈব গুণভেদতঃ
প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে, যথাবচ্ছৃণু তান্যপি॥19॥
সাংখ্যশাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম ও কর্তাকে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণের ভেদ অনুসারে তিন প্রকারের বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেইগুলিও তুমি যথাযথভাবে আমার নিকট শোনো। ১৯
বিবেচন: শ্রীভগবান আরও বলেছেন যে জ্ঞান, কর্ম এবং কর্তাও তিন প্রকার - সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক। গুণের বৈশিষ্ঠের কারণে এগুলোও তিন প্রকার হয়ে গেছে। জ্ঞানের অভাবই তামসিক জ্ঞান, যেমন আলোর অভাবই অন্ধকার। জ্ঞান, কর্ম ও কর্তা, এরও তিন প্রকারের কথা আমার থেকে শোনো।
সর্বভূতেষু য়েনৈকং(ম্), ভাবমব্যয়মীক্ষতে
অবিভক্তং(ম্) বিভক্তেষু,তজ্জ্ঞানং(ম্) বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্॥20॥
যে-জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুধা বিভক্ত সর্বভূতে অবস্থিত এক অবিনাশী পরমাত্মতত্ত্বকে অবিভক্তরূপে দেখে, সেই জ্ঞানকে তুমি সাত্ত্বিক জ্ঞান বলে জানবে। ২০
বিবেচন: সর্বপ্রথম, ভগবান জ্ঞানের কথা বলেছেন। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক জ্ঞান। সাত্ত্বিক জ্ঞান কি? যা কিছুই সৃষ্টিতে রচনা হয়েছে তাকে বলা হয় ভূত (ভবতি ইতি ভূতঃ)। যে জ্ঞানের মাধ্যমে সমস্ত ভূতমাত্রের মধ্যে বা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে একই অব্যয় তত্ত্ব দেখা যায় তা হল সাত্ত্বিক জ্ঞান। ঠিক যেমন বিজ্ঞান বলে যে সমস্ত তত্ত্ব এই বিশ্বে রয়েছে, তা একটি পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং সেই পরমাণুও ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। একইভাবে জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করলে পরমাত্মা তত্ত্ব ব্যতীত কিছুই দেখা যায় না। এই পরমাত্মা তত্ত্ব অবিভাজ্য। তিনি একই সময়ে সকালের মধ্যে একই রূপে বিদ্যমান। যেমন একশত জল ভর্তি ঘড়া যদি রোদে রাখা হয়, তাহলে প্রত্যেকটি ঘড়ায় সূর্যের প্রতিফলন দেখা যাবে। একশত পাত্রে একশত সূর্য একত্রে দেখা যায়, কিন্তু সূর্য তো একটাই, সেই একইপ্রকারে পরমাত্মা তত্ত্ব একই। একই পরমাত্মার প্রতিফলন ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর মধ্যে দৃশ্যমান। আমাদের দেশের মূলমন্ত্র হলো- বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা। আদিশঙ্করাচার্য একতার চেয়ে সুন্দর শব্দটি ব্যবহার করেছেন- অদ্বৈত। অর্থাৎ দ্বিতীয় কোথাও নেই।
अयं निजः परो वेत्ति गणना लघुचेतसाम् ।
उदारचरितानां तु वसुधैव कुटुम्बकम् ॥
অর্থাৎ : এটা আমার, এটা তার। এই ধরনের চিন্তাধারা সংকীর্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের থাকে । অন্যদিকে, উদারচিত্ত মানুষের কাছে এই সমগ্র পৃথিবী একটি পরিবারের মতো।
हर देश में तू, हर वेश में तू,
तेरे नाम अनेक, तू एक ही है।
এখানে একের মধ্যেই অনেক রূপ আছে। যে জ্ঞানের মাধ্যমে একের মধ্যেই অনেকের দর্শন করা যায়, তা হল সাত্ত্বিক জ্ঞান। এই জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান।
अयं निजः परो वेत्ति गणना लघुचेतसाम् ।
उदारचरितानां तु वसुधैव कुटुम्बकम् ॥
অর্থাৎ : এটা আমার, এটা তার। এই ধরনের চিন্তাধারা সংকীর্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের থাকে । অন্যদিকে, উদারচিত্ত মানুষের কাছে এই সমগ্র পৃথিবী একটি পরিবারের মতো।
हर देश में तू, हर वेश में तू,
तेरे नाम अनेक, तू एक ही है।
এখানে একের মধ্যেই অনেক রূপ আছে। যে জ্ঞানের মাধ্যমে একের মধ্যেই অনেকের দর্শন করা যায়, তা হল সাত্ত্বিক জ্ঞান। এই জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান।
পৃথক্ত্বেন তু য়জ্জ্ঞানং(ন্),নানাভাবান্পৃথগ্বিধান্
বেত্তি সর্বেষু ভূতেষু, তজ্জ্ঞানং(ম্) বিদ্ধি রাজসম্॥21॥
কিন্তু যে-জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বহুধা-বিভক্ত সমস্ত ভূতে অবস্থিত নানা ভাবকে পৃথক পৃথক রূপে দেখে, সেই জ্ঞানকে রাজস জ্ঞান বলে জানবে। ২১
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, যে জ্ঞান আমাদের পার্থক্য করতে শেখায়; যেমন এটা আমার, ওটা তোমার, এবং এইরকম চিন্তা যখন সঠিক মনে হয়, তবে যে বুদ্ধির কারণে এরকম মনোভাব তৈরী হয়, সেটিই রাজসিক জ্ঞান। বিজ্ঞান পৃথকীকরণ করে, তাই বিজ্ঞান কখনোই পরম জ্ঞান অবধি পৌঁছাতে পারে না। আমাদের সাংস্কৃতিক মূলমন্ত্র হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য দেখা। তুকারাম মহারাজ যখন ভজন করার জন্য পাহাড়ে গিয়ে বসতেন, শুরু শুরুতে পাখিরা তার থেকে দূরে উড়ে চলে যেত, কিন্তু ধীরে ধীরে পাখিরা ফেরত এসে তার কাঁধে বসতে শুরু করে। পাখিদের মধ্যে এই একত্ববোধ জাগ্রত হয়েছিল যে তিনিও (মহারাজ) আমাদের একজন। সাধুসন্তরা এই একাত্মতার দৃষ্টির প্রত্যাশী হন। সমর্থ রামদাস স্বামী জি বলেছেন-
अभेद भक्ति दे दो राम,
आत्म निवेदन दे दो राम,
पावन भिक्षा दे दो राम।
উদাহরণস্বরূপ : একবার এক যৌথ পরিবারে ভুট্টা আনা হয়েছে । সেগুলিকে গরম করার পর সবাই খেতে শুরু করল। মা দুটো ভুট্টা নিলেন। সামনে ছেলে এবং ছোটজায়ের ছেলে বসে আছে দেখে মায়ের মনে হলো আমার ছেলেই যেন একটা বড় ভুট্টা পায়। কিন্তু মুশকিল এই হলো যে বড় ভুট্টা মায়ের ডান হাতে আছে আর তার ছেলে বাঁদিকে বসে আছে, তাই মা হাত আড়াআড়ি করে ছেলেকে ভুট্টা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ছেলেকে দুটুকরো বেশি ভুট্টা খাওয়ানোর জন্য মা এই অবিবেচকের ন্যায় কাজ করলেন। এই ভেদভাবের কারণেই পরিবারগুলো ভেঙ্গে যায়। এই ধরনের বুদ্ধি রাজসিক জ্ঞানের কারণে হয়।
अभेद भक्ति दे दो राम,
आत्म निवेदन दे दो राम,
पावन भिक्षा दे दो राम।
উদাহরণস্বরূপ : একবার এক যৌথ পরিবারে ভুট্টা আনা হয়েছে । সেগুলিকে গরম করার পর সবাই খেতে শুরু করল। মা দুটো ভুট্টা নিলেন। সামনে ছেলে এবং ছোটজায়ের ছেলে বসে আছে দেখে মায়ের মনে হলো আমার ছেলেই যেন একটা বড় ভুট্টা পায়। কিন্তু মুশকিল এই হলো যে বড় ভুট্টা মায়ের ডান হাতে আছে আর তার ছেলে বাঁদিকে বসে আছে, তাই মা হাত আড়াআড়ি করে ছেলেকে ভুট্টা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ছেলেকে দুটুকরো বেশি ভুট্টা খাওয়ানোর জন্য মা এই অবিবেচকের ন্যায় কাজ করলেন। এই ভেদভাবের কারণেই পরিবারগুলো ভেঙ্গে যায়। এই ধরনের বুদ্ধি রাজসিক জ্ঞানের কারণে হয়।
য়ত্তু কৃত্স্নবদেকস্মিন্ , কার্য়ে সক্তমহৈতুকম্
অতত্ত্বার্থবদল্পং(ঞ্)চ,তত্তামসমুদাহৃতম্ ॥22॥
যে-জ্ঞানের দ্বারা কোনো একটি কার্যরূপ দেহেই সম্পূর্ণের মতো আসক্তি জন্মায়, সেই যুক্তিবিহীন অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামস জ্ঞান বলে জানবে। ২২
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন যে জ্ঞান আমি এবং আমার দেহের মধ্যে আটকে আছে বা নিজের দেহের সঙ্গে আসক্ত রাখে তাকে তামসিক জ্ঞান বলা হয়। একে অজ্ঞতা বলে। এই প্রকার জ্ঞানকে বিনষ্ট করতে হলে এই শ্লোকগুলো মনন করে যেতে হবে।
নিয়তং(ম্) সঙ্গরহিতম্ ,অরাগদ্বেষতঃ(খ্) কৃতম্
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম, য়ত্তত্সাত্ত্বিকমুচ্যতে॥23॥
যে-কর্ম শাস্ত্রবিধির দ্বারা নির্দিষ্ট এবং কর্তৃত্বরহিত ব্যক্তির দ্বারা ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য তথা রাগ-দ্বেষ- -বর্জিত হয়ে করা হয় তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলা হয়। ২৩
বিবেচন: যে কর্ম আমার জন্য নির্ধারিত, অর্থাৎ আমার এই কর্তব্যকে জেনে, আসক্তি বিসর্জন করে, দ্বেষ ও ঘৃণা ত্যাগ করে, নিঃস্বার্থভাবে যে কর্ম করা হয় তাকে সাত্ত্বিক কর্ম বলে। একবার তানসেনকে রাজা বললেন, তুমি তোমার গুরুকে রাজদরবারে নিয়ে এসো। তানসেন সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে গুরুজী দরবারে আসবেন না। তানসেন তখন বললেন, আমি দিল্লির রাজার দরবারে রাজার জন্য গান করি কিন্তু আমার গুরু জগদীশ্বরের জন্য গান করেন।
য়ত্তু কামেপ্সুনা কর্ম, সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ
ক্রিয়তে বহুলায়াসং(ন), তদ্রাজসমুদাহৃতম্ ॥24॥
কিন্তু বহু কষ্টসাধ্য, ফলকামনাযুক্ত বা অহঙ্কারযুক্ত পুরুষের দ্বারা যে কর্মের অনুষ্ঠান করা হয় তাকে রাজস কর্ম বলা হয়। ২৪
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, যে কর্ম ভোগের আকাঙ্ক্ষায় সম্পাদন করা হয় এবং কর্তাভাব নিয়ে করা হয়, তা হল রাজসিক কর্ম। এতে মানুষের অহংবোধ জাগ্রত থাকে। অনেক কষ্ট ও পরিশ্রমের দ্বারা এই কর্ম করা হয়। আমি কী কর্মফল পাব সেই ধারণাটাই এতে মুখ্য হয়।
অনুবন্ধং(ঙ্) ক্ষয়ং(ম্) হিংসাম্, অনবেক্ষ্য চ পৌরুষম্
মোহাদারভ্যতে কর্ম, য়ত্তত্তামসমুচ্যতে॥25॥
ভাবী শুভাশুভ ফল, ধনক্ষয়, শক্তিক্ষয়, পরপীড়া ও সামর্থ্যের বিচার না করে কেবল অবিবেকবশতঃ যে কর্ম করা হয়, তাকে তামস কর্ম বলা হয়। ২৫
বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, অজ্ঞতাবশত যে কার্য করা হয়, যে কার্যের দ্বারা অন্যের ক্ষতি হয়, পরিণামের চিন্তা না করে যে কার্য করা হয়, তাকে তামসিক কর্ম বলে। কেবলমাত্র মোহের আবেশে এসেই এই প্রকার কর্ম করা হয়। যে কর্তা হয়, সে তামসিক কর্ম করার সময় তার নিজের সামর্থ্যের কথা না ভেবেই কর্ম সম্পাদন করে।
এই জ্ঞানগর্ভ বিবেচন সত্রের সমাপ্তির পর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়।
প্রশ্নকর্তা: পদ্মাবতী জী বনসালী
প্রশ্নঃ দৈবের স্থান কি পঞ্চম?
উত্তর: অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, চেষ্ঠা ও দৈব। যে কোন কাজের জন্য এই পাঁচটি জিনিস আবশ্যক। পঞ্চম স্থানে দৈব রাখাই শ্রেয় । বাকি বিষয়গুলি জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্নকর্তা: চিত্রা জী মুদ্ধেবিহালকার
প্রশ্ন: দৈব এবং প্রারব্ধ (কর্মফল) কি একই? কিভাবে প্রারব্ধ উত্তম করা যায়?
উত্তরঃ দৈবই হল প্রারব্ধ। অর্থাৎ এটা আমাদের পূর্ব কর্মের ফল যা দৈব বা প্রারব্ধে পরিণত হয়। যেমন, যদি একজন মানুষের ভাগ্যে একদিনও নির্জলা থাকা লেখা রয়েছে এবং সে নির্জলা একাদশীর উপবাসের মাধ্যমে সেটা ভোগ করে নেয়, তাহলে সে তার যা প্রারব্ধ, তা আনন্দে ব্যতীত করে নেয়। সে তার প্রারব্ধকে ধীরগতি করে দেয়।
প্রশ্নকর্তা: মিলিন্দ জী রঙনেকর
প্রশ্ন: আদৌ কি কোনো তত্ত্ব নেই? তাহলে ত্রিগুণাত্মক কি হয়?
উত্তর: পরমাত্মা তত্ত্ব হলো গুণাতীত , তিনি সকল গুণের ঊর্ধ্বে। তিনি সত্ত্ব, রজস ও তমসের ঊর্ধ্বে। এই হলো ত্রিগুণ প্রকৃতি। আইনস্টাইন নিজেই বলেছেন যে আমি এমন একটি সাগরের তীরে বসে আছি, যেখানে আমি কিছু ঝিনুক, শঙ্খ এবং মুক্তা পেয়েছি, কিন্তু আমি সমুদ্রে কী আছে তা জানতেও পারিনি।
প্রশ্নকর্তা: কেশব জী পাত্র
প্রশ্নঃ আমাদের কি রাজসিক ও তামসিক কর্ম করা উচিত নয়?
উত্তর: তামসিক কর্ম একেবারেই করা উচিত নয়। রাজসিক কর্ম রজোগুণের শক্তিতে সম্পাদিত হয়। রাজসিক কর্ম মধ্যম কর্ম। সত্ত্বগুণের প্রভাবেই রজোগুণ থাকা আবশ্যক। সত্ত্ব গুণের কথা বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আমার দেশ তমোগুণে মগ্ন হয়ে রয়েছে। অতএব, আমাদের প্রথমে রজোগুণ ধারণ করতে হবে যাতে পরবর্তীকালে সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রজোগুণের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদিত করানো যায়। গুরু বন্দনা নিয়ে আজকের অধিবেশন এখানেই শেষ হলো।
এই জ্ঞানগর্ভ বিবেচন সত্রের সমাপ্তির পর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়।
প্রশ্নকর্তা: পদ্মাবতী জী বনসালী
প্রশ্নঃ দৈবের স্থান কি পঞ্চম?
উত্তর: অধিষ্ঠান, কর্তা, করণ, চেষ্ঠা ও দৈব। যে কোন কাজের জন্য এই পাঁচটি জিনিস আবশ্যক। পঞ্চম স্থানে দৈব রাখাই শ্রেয় । বাকি বিষয়গুলি জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্নকর্তা: চিত্রা জী মুদ্ধেবিহালকার
প্রশ্ন: দৈব এবং প্রারব্ধ (কর্মফল) কি একই? কিভাবে প্রারব্ধ উত্তম করা যায়?
উত্তরঃ দৈবই হল প্রারব্ধ। অর্থাৎ এটা আমাদের পূর্ব কর্মের ফল যা দৈব বা প্রারব্ধে পরিণত হয়। যেমন, যদি একজন মানুষের ভাগ্যে একদিনও নির্জলা থাকা লেখা রয়েছে এবং সে নির্জলা একাদশীর উপবাসের মাধ্যমে সেটা ভোগ করে নেয়, তাহলে সে তার যা প্রারব্ধ, তা আনন্দে ব্যতীত করে নেয়। সে তার প্রারব্ধকে ধীরগতি করে দেয়।
প্রশ্নকর্তা: মিলিন্দ জী রঙনেকর
প্রশ্ন: আদৌ কি কোনো তত্ত্ব নেই? তাহলে ত্রিগুণাত্মক কি হয়?
উত্তর: পরমাত্মা তত্ত্ব হলো গুণাতীত , তিনি সকল গুণের ঊর্ধ্বে। তিনি সত্ত্ব, রজস ও তমসের ঊর্ধ্বে। এই হলো ত্রিগুণ প্রকৃতি। আইনস্টাইন নিজেই বলেছেন যে আমি এমন একটি সাগরের তীরে বসে আছি, যেখানে আমি কিছু ঝিনুক, শঙ্খ এবং মুক্তা পেয়েছি, কিন্তু আমি সমুদ্রে কী আছে তা জানতেও পারিনি।
প্রশ্নকর্তা: কেশব জী পাত্র
প্রশ্নঃ আমাদের কি রাজসিক ও তামসিক কর্ম করা উচিত নয়?
উত্তর: তামসিক কর্ম একেবারেই করা উচিত নয়। রাজসিক কর্ম রজোগুণের শক্তিতে সম্পাদিত হয়। রাজসিক কর্ম মধ্যম কর্ম। সত্ত্বগুণের প্রভাবেই রজোগুণ থাকা আবশ্যক। সত্ত্ব গুণের কথা বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, আমার দেশ তমোগুণে মগ্ন হয়ে রয়েছে। অতএব, আমাদের প্রথমে রজোগুণ ধারণ করতে হবে যাতে পরবর্তীকালে সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রজোগুণের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদিত করানো যায়। গুরু বন্দনা নিয়ে আজকের অধিবেশন এখানেই শেষ হলো।