विवेचन सारांश
সত্ত্ব, রজ ও তমগুণের পরিণাম এবং গুণাতীতের লক্ষণ

ID: 1552
बंगाली - বাংলা
রবিবার, 02 অক্টোবর 2022
অধ্যায় 14: গুণত্রয়বিভাগযোগ
2/2 (শ্লোক 14-27)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিদুষী মাননীয়া বন্দনা বর্ণেকর মহাশয়া


ভগবানের কাছে প্রার্থনা ও দীপ প্রজ্জ্বলন করে এবং মা সরস্বতী, সদগুরু গোবিন্দ দেব গিরি জী, বেদ ব্যাস জী এবং জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জীকে প্রণাম জানিয়ে আজকের বিবেচন সত্র শুরু হয়।

ভগবদ্গীতার মহিমা গাইতে গিয়ে মহর্ষিরা বলেন, প্রতিদিন আমাদের গীতা পাঠ করা উচিত। মানুষ যেমন জল ব্যবহার করে তার দেহের বর্জ্য দূর করে, তেমনি গীতার জল এই সংসারের বর্জ্য দূর করে। (অন্তঃকরণ চতুষ্ট্য হয়)। অন্তঃকরণ চতুষ্ট্য মানে মন (চিন্তা করে), বুদ্ধি (নির্ণয় নেয়), চিত্ত (এখানে সংসারের সমস্ত ঘটনা সঞ্চিত হয়ে থাকে ) এবং অহংকার। গীতা মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে তোলে এবং আমরা স্পষ্টভাবে ভগবানের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই।

সমগ্র সৃষ্টি বৈচিত্র্যে ভরা। সব মানুষের প্রকৃতি আলাদা। এগুলো মানসিক বন্ধনের কারণে হয়। তিনটি গুণের কারণে বন্ধন হয়। গুণ মানে দড়ি, এই গুণগুলো আমাদের বেঁধে রাখে। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে, শ্রী ভগবান অর্জুনের মাধ্যমে, তাঁর শ্রীমুখ থেকে আমাদের সকলকে ভগবদ্গীতার শাশ্বত জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। এত বছর পরেও তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। পরিস্থিতির পরিবর্তনের পরও মানুষের মন সেই একই প্রকার রয়েছে। তার বিকারও একই প্রকারের রয়েছে। অন্যের বিকার কীভাবে আমাদের ভিতরে প্রবেশ করে, এটা আমাদের বুঝতে হবে। নিজেকে এবং এই সংসারকে বুঝতে হবে। যিনি জগৎসংসারের সৃষ্টিকর্তা, স্রষ্টা, পরমাত্মা, তাঁকেও বুঝতে হবে। আমরা যদি জীব, জগৎ ও জগদীশকে বুঝে নিই, তবে আমাদের জীবন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই গীতার উদ্দেশ্য।

ভগবান এই অধ্যায়ের মাধ্যমে প্রকৃতির তিনটি গুণ ব্যাখ্যা করেছেন। এই তিনটি গুণ হল সত্ত্ব, রজস ও তম। রজোগুণের কারণে এই সংসারের কর্মকাণ্ড চলে, সত্ত্ব গুণের কারণে তা সঠিক পথে চলে এবং তমগুণের কারণে তা থেমে যায়। এই তিনটি গুণই আবশ্যক, কিন্তু এই গুণগুলিরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই কখন কোন গুণের প্রয়োগ করতে হবে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। কর্ম তো চলতেই থাকা উচিত, তবে তা যেন সঠিক পথে চলে, কখন তা শুরু করতে হবে, কখন তা থামিয়ে দিতে হবে, সেই ধারণা থাকতে হবে। সঠিক জীবন যাপন করা এবং গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া, এই কথা আমরা এই অধ্যায়ে বুঝবো।

প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের থেকে আলাদা, কারণ সবাইয়ের প্রকৃতিগত গুণের মিশ্রণ আলাদা। সেজন্যই দুজন মানুষ একরকম হন না। আমাদের কাউকে নিজের মতো করতেও হবে না এবং আমাদেরও অন্য কারোর মতো দরকারও নেই। আমি নিজেও বুঝবো এবং অন্যকেও বোঝার চেষ্টা করবো। নিজের জীবনকে উন্নত করবো এবং অন্যের জীবনকেও উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করবো।

14.14

অপ্রকাশোপ্রবৃত্তিশ্চ , প্রমাদো মোহ এব চ
তমস্যেতানি জায়ন্তে , বিবৃদ্ধে কুরুনন্দন॥13॥

হে কুরুনন্দন! তমসের গুণের বৃদ্ধির সাথে সাথে এই প্রবণতাগুলিও দেখা দেয় - অ-আলো, উদাসীনতা এবং ভ্রান্তি এবং ভ্রম।

বিবেচন: সত্ত্বগুণে স্থিত হয়ে একজন ব্যক্তি যখন দেহ ত্যাগ করেন, তখন তিনি উত্তম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে তার সাত্ত্বিকতা বৃদ্ধি হয়। মানুষ নিজের অন্তঃকরণে যে ভাব নিয়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করে, সেই ভাবই সে আগামী জন্মে প্রাপ্ত হয়। তাই অনেক মানুষ সাত্ত্বিকভাবে জীবনযাপন করে, ভগবানের চিন্তন-মননে সময় অতিবাহিত করে। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের অন্তিম সময়ে, তাঁর হাতে জপমালা ছিল। একইভাবে, যখন কোনও মানুষের শেষ সময়ে, তাকে গঙ্গা জল দেওয়া হয়, মুখে তুলসী পাতা রাখা হয়, ভগবত গীতা পাঠ করে শোনানো হয়, যাতে পরবর্তী জন্মে সে উত্তম জন্ম লাভ করতে পারে। All is well if it ends well.

14.15

যদা সত্ত্বে প্রবৃদ্ধে তু, প্রলয়ং(ম্)যাতি দেহভৃৎ
তদোত্তমবিদাং(ম্)লোকান্, অমলান্প্রতিপদ্যতে॥14॥

যে সময়ে সত্ত্ব গুণ বেড়েছে, সেই সময়ে যদি অবতারের মৃত্যু হয়, সে বিশুদ্ধ জগতে যায়।

বিবেচন: রজোগুণে স্থিত একজন ব্যক্তি যখন দেহ ত্যাগ করবে, তখন সে এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যেখানে প্রচুর কর্মব্যস্ততা থাকবে। যদি কেউ তমোগুণের অধিকতা নিয়ে শরীর ত্যাগ করে, তবে সে পশু-পাখি নিম্ন যোনিতে জন্ম নেয়। ভাগবতে জড় ভরতের একটি খুব সুন্দর গল্প আছে, জড় ভরত অত্যন্ত জ্ঞানী, তপস্বী ছিলেন। তিনি নিজের রাজ্য ত্যাগ করে বানপ্রস্থ আশ্রমে চলে যান। একদিন তিনি নদীর তীরে ধ্যানমগ্ন বসে থাকতে দেখেন নদীতে একটি হরিণের বাচ্চা বয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি সেই হরিণের বাচ্চাটিকে বাঁচান এবং তার যত্ন নেওয়া শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিঁনি তার মায়ায় পড়ে গেলেন। একদিন হরিণের বাচ্চাটি কোথাও চলে গেল। ভরতজী খুব বিচলিত হলেন, দিনরাত তার চিন্তা করতে লাগলেন। হরিণের কথা ভাবতে ভাবতে তিনি মারা গেলেন এবং পরের জন্মে তিনি হরিণ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শেষ মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়।

14.16

রজসি প্রলয়ং(ঙ) গত্বা , কর্মসঙ্গিষু জায়তে
তথা প্রলীনস্তমসি , মূঢযোনিষু জায়তে॥15॥

যে ব্যক্তি রজোগুণ বৃদ্ধির কারণে মৃত্যুবরণ করে, সে কর্মময় পুরুষের যোনিতে জন্মগ্রহণ করে এবং যে ব্যক্তি তমোগুণ বৃদ্ধির কারণে মরণশীল যোনিতে মৃত্যুবরণ করে।

বিবেচন : আমাদের কর্মের দ্বারাই হৃদয়ের শুদ্ধি হয়। সত্ত্বগুণের কর্মফল নির্মল, সুখ শান্তি ও আনন্দ দেয়। রজোগুণের কর্মফল দুঃখদায়ক হয়। তমোগুণের কর্মফলকে অজ্ঞান বলা হয়েছে। তিনটি গুণই শৃঙ্খল। যে মনুষ্য এই তিনটি গুণ পরিত্যাগ করে তাকে বলা হয় গুণাতীত।

14.17

কর্মণঃ(স্) সুকৃতস্যাহুঃ(স্), সাত্ত্বিকং(ন্) নির্মলং(ম্) ফলম্
রজসস্তু ফলং(ন্) দুঃখম্ , অজ্ঞানং(ন্) তমসঃ(ফ্) ফলম্॥16॥

জ্ঞানীরা বলেছেন, শুভ কর্মের ফল শুদ্ধ সাত্ত্বিক, রজস কর্মের ফলকে বলা হয় দুঃখ (এবং) তমস কর্মের ফলকে বলা হয় অজ্ঞানতা (মূর্খতা)।

বিবেচন: ভগবদ্গীতার মূল লক্ষ্য হল প্রজ্ঞা (জ্ঞান) জাগ্রত করা। বিবেক জাগ্রত হয় সত্ত্বগুণের কারণে। সত্ত্বগুণের কারণে জ্ঞানের প্রাপ্তি হয় এবং শান্তি লাভ হয়। রজোগুণের (চঞ্চলতা, মনোরঞ্জন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা) কারণে লোভ বৃদ্ধি পায়। লোভ একটি মানসিক রোগ। যা বয়সের সাথে সাথে বেড়ে যায়। তাই একে নারাকের দ্বার বলা হয়। তমোগুণের কারণে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞানতা বৃদ্ধি পায়।

14.18

সত্ত্বাৎসঞ্জায়তে জ্ঞানং(ম্), রজসো লোভ এব চ
প্রমাদমোহৌ তমসো, ভবতোজ্ঞানমেব চ॥17॥

সত্ত্ব গুণ থেকে জ্ঞান ও রজো গুণ লোভের দিকে নিয়ে যায় (ইত্যাদি); তমোগুণ থেকে অহংকার, ভ্রম ও অজ্ঞতা এছাড়াও উৎপন্ন হয়।

বিবেচন: ঈশ্বর তিনটি গুণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। সত্ত্ব গুণে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, তার জীবন ঊর্ধ্বমুখী হয়। তিনি স্বর্গ ইত্যাদি উচ্চতর লোকে গমন করেন। যার মধ্যে রজোগুণ আছে সে উপরেও যায় না, নিচেও যায় না, সে মধ্যম স্থানে (পৃথিবীতে) অবস্থান করে। তমোগুণী অধোগতি অর্থাৎ নীচ যোনিতে (নরকে) যায়। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন যে একজন সাত্ত্বিক মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তি তার কর্তব্য বিবেচনা করেই কাজ করে। তিনি কর্মের কোনো ফলও আশা করেন না। কর্ম সম্পাদনের আনন্দই হলো তার প্রাপ্তি। রজোগুণ মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মনোভাব সর্বদা এইপ্রকার হয় যে, আমার কাজই প্রথমে সম্পন্ন হয়ে যাওয়া উচিত,অন্যদের নয়, কেউ যেন আমার থেকে এগিয়ে না যায়। এই ধরনের ব্যক্তি নিজের স্বার্থকে সবসময় সবার আগে রাখে। তমোগুণী মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তি অধঃপতন প্রাপ্ত হয়। তার জন্ম নীচ যোনিতে হয় যেমন, পোকামাকড়, পশু, পাখি ইত্যাদি।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝা যাক। একজন মায়ের তিন সন্তান। প্রথম জন স্কুল থেকে বাড়িতে আসে এবং সমস্ত জিনিস সঠিক জায়গায় রাখে। সে হাত পরিষ্কার করেই খাবার খায়। এর পর সে বাড়ির দরকারি কাজ করে। তার মাকে কিছুই বলতে হয় না, সে নিজে নিজেই সব কাজ করে। সে হলো সত্ত্বগুণী বালক। দ্বিতীয় ছেলেটি বাড়িতে আসার সাথে সাথেই তার জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ফেলে দেয়। মা তাকে বারবার খাবার খেতে,পড়ালেখা করার কথা বলতে থাকেন, কাজ করানোর জন্য তাকে লোভ দেখাতে হয়। লোভে পড়ে সে কাজ করে। এই বালকটি হল রজোগুণী। তৃতীয় সন্তানটি বাড়িতে আসার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। তার জিনিসপত্রের দিকে কোনো খেয়ালও থাকে না, অনেক জিনিস সে স্কুলেই ভুলে ফেলে আসে। মা তাকে বলতে থাকেন যে সে যেন পড়াশুনা করে তাহলে সন্ধ্যায় তাকে আইসক্রিম খাওয়াবেন। কিন্তু সেই ছেলেটি বলে প্রথমে আমাকে আইসক্রিম দাও, তারপর আমি লেখাপড়া করব কি করব না,সেটা ভাববো। এই বালকের মধ্যে তমোগুণের প্রাচুর্য রয়েছে। 

14.19

ঊর্ধ্বং(ঙ) গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা , মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা , অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ॥18॥

সত্ত্ব গুণ থেকে জ্ঞান ও রজো গুণ লোভের দিকে নিয়ে যায় (ইত্যাদি); তমোগুণ থেকে অহংকার, ভ্রম ও অজ্ঞতা এছাড়াও উত্পন্ন হয়।

বিবেচন: ভগবান বলেছেন যখন মানুষ আত্ম তত্ত্বের সাথে এক হয়ে যায়, তখন দ্রষ্টার ভূমিকায় বসে উপলব্ধি করে যে, সে স্বয়ং কর্তা নয় এবং ভোক্তাও নয়। আমি সব গুণসমূহের ঊর্ধ্বে। এই তিনটি গুণ অতিক্রম করেই আমাদের গুণাতীত হতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যে বৃত্তিতে অবস্থিত থাকে, সে সেই অনুরূপই ফল প্রাপ্ত করে। অনেক সাধু সন্তরা একটি একটি গমের দানা নিয়ে রাম-রাম জপ করেন, তারপরে সেই গমের দানা পিষে রুটি তৈরি করে খান। আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন, আমি মনও নয়, শরীরও নয়, বুদ্ধিও নয়, ইন্দ্রিয়ও নয়। আমি তো চিদানন্দ স্বরূপ (চৈতন্য তত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব)। চিদানন্দ রূপম শিবোহম শিবোহম...........

আমরা এই গল্পের মাধ্যমে বুঝতে পারি কিভাবে তিনটি গুণ আমাদের আবদ্ধ করে রাখে। এক জঙ্গলে তিনজন ডাকাত থাকত। তারা একজন লোককে ধরে তার সমস্ত সম্পত্তি লুট করে নিয়ে নেয়। তার পর একজন ডাকাত বলল, এই লোকটাকে মেরে ফেলি, সে তমোগুণী ছিল। আরেকজন বলল, গাছে বেঁধে রাখি, কোনো বন্য প্রাণী এসে খেয়ে ফেলবে, এ রজোগুণী। তৃতীয় জন রাতের বেলায় সেই ব্যক্তিটিকে নিয়ে জঙ্গলের সীমান্তে নিয়ে যায় এবং বলে, আমি তোমাকে একটা গ্রামের ঠিকানা বলে দিচ্ছি, তুমি নিজে সেখানে চলে যাও। আমারও একটা গণ্ডি আছে, আমি তা লঙ্ঘন করতে পারবো না, এ হলো সত্ত্বগুণ সম্পন্ন ব্যক্তি।

14.20

নান্যং(ঙ) গুণেভ্যঃ(খ্) কর্তারং(ম্), যদা দ্রষ্টানুপশ্যতি
গুণেভ্যশ্চ পরং(ম্) বেত্তি, মদ্ভাবং(ম্) সোধিগচ্ছতি॥19॥

যখন বিচারশীল মানুষ তিনটি গুণ ব্যতিরেকে অন্য কাউকে কর্তা বলে না দেখেন এবং নিজেকে ত্রিগুণের অতীত বলে অনুভব করেন, তখন তিনি আমার স্বরূপ (ব্রহ্মভাব) প্ৰাপ্ত হন।

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, যে ব্যক্তি এই জন্ম, মৃত্যু ও বার্ধক্যের সকল প্রকার কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির এই তিনটি গুণ অতিক্রম করে, সে এই জীবনেই পরম আনন্দ স্বরূপ অমৃত পান করে। গুরু দেব আরও বলেন, Joy of being, Not joy of having.

14.21

গুণানেতানতীত্য ত্রীন্ , দেহী দেহসমুদ্ভবান্
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখৈঃ(র্) , বিমুক্তোমৃতমশ্নুতে॥20॥

মানুষ (বিবেকশীল মনুষ্য) দেহ উৎপত্তির কারণরূপ এই তিনটি গুণ অতিক্রম করে জন্ম, মৃত্যু, জরারূপ দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে অমরত্ব অনুভব করেন।

বিবেচন: মানুষের উপর তিনটি গুণের প্রভাবের তথ্য জেনে অর্জুন প্রশ্ন করেন, হে ভগবান, যে প্রকৃতির তিনটি গুণ অতিক্রম করে,সেই মানুষের লক্ষণ কী? তাদের আচরণ কেমন? কিভাবে মনুষ্য প্রকৃতির তিনটি গুণ অতিক্রম করতে পারে?

14.22

অর্জুন উবাচ

কৈর্লিংগৈস্ত্রীন্গুণানেতান্, অতীতো ভবতি প্রভো
কিমাচারঃ(খ্) কথং(ঞ) চৈতাংস্, ত্রীন্গুণানতিবর্ততে॥21॥

অর্জুন বললেন- —হে প্রভু ! এই তিনটি গুণের অতীত মানুষকে কোন কোন লক্ষণ দ্বারা জানা যায় ? তাঁর আচরণ কেমন হয় ? আর এই তিনটি গুণকে কীভাবে অতিক্রম করা যেতে পারে।

বিবেচন: শ্রীভগবান, অর্জুনকে উত্তর দিয়ে বলেন, যে মনুষ্য জ্ঞানরূপী প্রকাশ (সত্ত্বগুণ) এবং কর্মের জন্য আসক্তি (রজোগুণ) এবং মোহরূপী অজ্ঞানতার (তমোগুণ) প্রবৃত্তি বৃদ্ধি হলেও এই গুণসমূহকে ঘৃণা করেন না এবং সমভাবে স্থিত হয়ে তাদের প্রতি আকৃষ্টও হন না এবং গুণাবলী নিবৃত্ত হলেও তার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা রাখেন না। সুখ বা দুঃখ,উভয় পরিস্থিতিতেই সম-ভাবাপন্ন থাকেন।

14.23

শ্রীভগবানুবাচ

প্রকাশং(ঞ) চ প্রবৃত্তিং(ঞ) চ, মোহমেব চ পাণ্ডব
ন দ্বেষ্টি সম্প্রবৃত্তানি, ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি॥22॥

গুণাতীত ব্যক্তি এগুলিতে দ্বেষ করেন না এবং এগুলি যদি নিবৃত্ত হয় তবে সেগুলির ইচ্ছা রাখেন না।

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, যিনি সকল পরিস্থিতির প্রতি উদাসীন অবস্থায় স্থিত হয়ে, অর্থাৎ উচ্চতর আধ্যাত্মিক স্তরে অবস্থিত থেকে সাক্ষী ভাবে জীবনকে অবলোকন করেন, তিনি গুণসমূহের পরিণামেরে বিষয়ে অবগত। সেই সাধক গুণাবলীর প্রভাবে বিচলিত হয় না। কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে সে গুণসমূহের প্রকৃতি জেনেও একই ভাবে স্থিত থাকে। কৃষ্ণমূর্তি জী বলেছেন, সমস্ত ঘটনার পরিণাম আমাদের মনস্তাত্ত্বিক স্মৃতিতে (psychological memory) সংরক্ষিত থাকে। তাই আমরা বারবার সুখ-দুঃখ অনুভব করি। গুরুদেব বলেন, যদি সুখ আসে তাকে কাজে লাগাও। দুঃখ এলে তা হজম কর। জীবন যাপনের জন্য তিনটি গুণই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কখনোই পরমাত্মা ভাব থেকে দূরে থাকবেন না।

14.24

উদাসীনবদাসীনো , গুণৈর্যো ন বিচাল্যতে
গুণা বর্তন্ত ইত্যেব, যোবতিষ্ঠতি নেঙ্গতে॥23॥

যিনি উদাসীনের মতো অবস্থান করেন এবং গুণাদির দ্বারা যিনি বিচালিত হন না, গুণই (গুণাদিতে) কার্যান্বিত হতে থাকে - এই ভাব মনে রেখে যিনি নিজের স্বরূপে অবস্থিত থাকেন এবং স্বয়ং কোনো চেষ্টা করেন না।

বিবেচন: গুণাতীতের গুণাবলী বর্ণনা করে শ্রী ভগবান বলেছেন, যিনি সুখে-দুঃখে সমান ভাব রাখেন। যিনি আত্ম ভাবে স্থিত থাকেন। যিনি মাটি, পাথর ও সোনার প্রতি সম-ভাবাপন্ন। যার কাছে কেউ প্রিয়ও নয়, কেউ অপ্রিয়ও নয়। যিনি নিন্দা ও স্তুতিতে ধৈর্য হারান না, তাকেই গুণাতীত মনে করা উচিত। নিজের জীবনের রিমোট কন্ট্রোল কাউকে দেওয়া উচিত নয়। এক ব্যক্তি গৌতম বুদ্ধের শান্তি দেখে ঘৃণা করত, সে তাঁর শান্তি নষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করত। কিন্তু মহাত্মা বুদ্ধের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। তিঁনি বলতেন, আমি কারো আচরণে প্রভাবিত হই না।

14.25

সমদুঃখসুখঃ(স্) স্বস্থঃ(স্), সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো ধীরঃ(স), তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ॥24॥

যে ধৈর্যশীল ব্যক্তি সুখদুঃখে সমভাবাপন্ন ও নিজস্বরূপে স্থিত, যিনি মাটির ডেলা, পাথর এবং সোনায় সমভাবাপন্ন; যিনি প্রিয়-অপ্রিয় বিষয়ে তথা নিজের নিন্দা-স্তুতিতে সমভাব বজায় রাখেন;

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেছেন, যিনি মান ও অপমানকে সমান মনে করেন। যিনি বন্ধু ও শত্রুকে সমানভাবে দেখেন। যার মধ্যে কর্ম করার সময় কর্তাবোধ থাকে না। এই ধরনের মানুষকে প্রকৃতির গুণসমূহের অতীত বলা হয়। আমরা একটি উদাহরণ দিয়ে এটি বুঝতে পারি। রাবণ সীতাকে অপহরণ করলে ভগবান রাবণকে শত্রুরূপে বধ করেন। রাবণের মৃত্যুর পর ভগবান বিভীষণকে রাবণের অন্তিম সংস্কার করতে বলেন। বিভীষণের প্রত্যাখ্যানে ভগবান বললেন, নিজের ভাই না ভেবে আমার ভাই ভেবেই তুমি রাবণের শেষকৃত্য কর। ভগবান রাম শত্রু ও বন্ধুকে সমান মনে করতেন।

14.26

মানাপমানয়োস্তুল্যঃ(স্), তুল্যো মিত্রারিপক্ষয়োঃ
সর্বারম্ভপরিত্যাগী , গুণাতীতঃ(স্) স উচ্যতে॥25॥

যিনি মান অপমানে ও মিত্র-শত্রু পক্ষের সঙ্গে সমভাব রাখেন, যিনি সর্ব কর্মারম্ভ পরিত্যাগ করেন, এইরূপ ব্যক্তিকেই গুণাতীত বলা হয়।

বিবেচন : শ্রী ভগবান অর্জুনকে বলেন গুণাতীত কিভাবে হওয়া যায়, যে মানুষ কোন অবস্থাতেই অবিচলিত থেকে আমার ভক্তিতে স্থিত থাকে। সেই ভক্ত প্রকৃতির তিনটি গুণকে দ্রুত অতিক্রম করে ব্রহ্মার পদে অধিষ্ঠিত হন। গুণাতীত হওয়ার অর্থ ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। ভগবান প্রাপ্তির একমাত্র শর্ত হল নিরাসক্ত ভাব নিয়ে ভগবানের শরণে আসা। সগুণ ও নির্গুণ উভয়ের প্রতি সম -ভাবাপন্ন হয়ে সমগ্র ভাবে আমাকে গ্রহণ কর। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন- মেঘের ফোঁটা যেভাবে পৃথিবীতে এসে পড়ে, সেইভাবে আত্মতত্ত্ব পরমাত্মাতত্ত্বের সাথে একাত্ম হয়ে জ্ঞানপূর্বক কর্ম করে, তখন তাকে পরম ভক্ত বলা হয়। সেই ভক্তই ভগবানের সচ্চিদানন্দ ভাব প্রাপ্ত করে।

14.27

মাং(ঞ) চ যোব্যভিচারেণ, ভক্তিযোগেন সেবতে
স গুণান্সমতীত্যৈতান্, ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥26॥

যে ব্যক্তি ঐকান্তিক ভক্তিযোগের সাহায্যে আমার উপাসনা করেন, তিনি এইসকল গুণ অতিক্রম করে ব্রহ্মপ্রাপ্তির যোগ্য হয়ে ওঠেন।

বিবেচন: ভগবান এই শ্লোকে নিজের মধ্যে একাত্ম হওয়ার বার্তা দিয়ে নিজের সম্পর্কে বলেছেন যে এই অবিনশ্বর ব্রহ্ম পদের আমিই অমৃত স্বরূপ, শাশ্বত স্বরূপ, ধর্মের স্বরূপ এবং পরম আনন্দ স্বরূপের একমাত্র আশ্রয়। যে এটা বুঝেছে, সেই এই অব্যভিচারিণী ভক্তিতে পৌঁছতে পারে এবং গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়। 

এই বিবেচন সত্র এখানেই শেষ হয় এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হল।

প্রশ্নকর্তা: পুনম জী 
প্রশ্ন: সত্ত্ব, রজস ও তম এই তিনটি গুণেরও কি বাস্তব জীবনে সমত্ব থাকা উচিত?
উত্তর: জীবনে সমত্ব ভাবে অবস্থিত থাকা প্রকৃত আনন্দ দেয়। ভগবানের ভক্তির মাধ্যমেই আমরা এই আনন্দ পেতে পারি। ভক্তি দ্বারা আমাদের অন্তঃকরণ পবিত্র হবে এবং এই ভক্তিই ভগবানের সাথে একাত্ম করবে। এর দ্বারা আমরা জীবনের প্রভাব থেকে মুক্ত হব। পরমাত্মার সাথে একাত্ম হলে আমাদের মধ্যে সমত্বভাব চলে আসব।

প্রশ্নকর্তা: অলোক জী 
প্রশ্নঃ গীতার শেষে ভগবান অর্জুনকে বলেন, দেখ, আমি তোমাকে সমস্ত জ্ঞান দিয়েছি। সবকিছু ব্যাখ্যা করেছি। এবার তুমি নিজের বিবেক দিয়ে নির্ণয় নাও, কেন বললেন? তিঁনি কেন অর্জুনকে আদেশ দিলেন না?
উত্তর: ঈশ্বর জীবকে জীবন যাপনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভগবান অর্জুনকে সব বুঝিয়ে দিলেন। সব জ্ঞান প্রদান করলেন। অতঃপর ভগবান অর্জুনকে বললেন, যা করবে তা নিজের বিবেক অনুসরণ করেই কর। আত্মচিন্তন করো। বিচক্ষণতা বৃদ্ধি করাই জ্ঞানের মূল লক্ষ্য। এটা dictatorship নয়, এ হলো গুরুর মহিমা বা মহত্ত্ব। গুরুর মহত্ত্বই হলো শিষ্যকে গুরুর পদে নিয়ে উন্নীত করা। ভক্তের আত্মশক্তিকে উদ্দীপ্ত করাই এর উদ্দেশ্য। 

প্রশ্নকর্তাঃ রমা জী
প্রশ্ন: জীবনে প্রমাদ, আলস্য যায় না, সবসময় নিদ্রাভাব থাকে। পূজা পাঠ করতে করতে মন চঞ্চল হয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। কিভাবে এ সব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
উত্তরঃ নিজের দোষ জানা , সেই দোষ নিবৃত্ত করাই হলো প্রথম ধাপ। আমরা যদি মনে করি যে আমাদের মধ্যে কোন দোষ নেই, তবে আমরা কীভাবে দোষ দূর করব। স্বামী রামদাস জী বলেন, আমরা যদি আমাদের দোষ না জানি, তবে আমরা আমাদের দোষগুলিকে গুণ বলে ভাবতে শুরু করি। নিদ্রার সময় সংযত করতে আমরা কর্ম শীলতা বৃদ্ধি করার প্রয়াস করতে পারি। আমরা যখন সত্ত্বগুণে প্রবেশ করি তখন মাঝে মাঝে তমোগুণ প্রাধান্য পায়, তমোগুণ যখন সত্ত্বগুণকে দমন করে তখন ঘুম আসে। আপনি যদি তন্দ্রা অনুভব করেন তবে হয় আপনি ভালো করে ঘুমিয়ে নিন বা আপনার কর্মশীলতা বৃদ্ধি করুন (রজোগুণ)। রজোগুণ বাড়ার সাথে সাথে তমোগুণ হ্রাস পাবে। সে সময় পূজা করবেন না, কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করবেন। মানুষের মধ্যে দোষ আছে, কিন্তু দোষের জন্য বিষন্ন হবেন না। ত্রুটিগুলি ধীরে ধীরে দূর করতে হবে। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন, যে অনুশোচনার তীর্থযাত্রা থেকে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়েছে সে পবিত্রতার দিকে যেতে পারে।

তথ্যপূর্ণ প্রশ্নোত্তর পর্বের পর এই বিবেচন সত্রের সমাপন হলো।

ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম , অমৃতস্যাব্যয়স্য চ
শাশ্বতস্য চ ধর্মস্য , সুখস্যৈকান্তিকস্য চ॥27॥

যেহেতু ব্ৰহ্ম, অবিনাশী অমৃত, সনাতন ধর্ম এবং ঐকান্তিক সুখের আশ্রয়, সবই আমিই।