विवेचन सारांश
সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণের পরিপূর্ণ সমত্বই হলো গুণাতীত

ID: 2431
Bangla - বাংলা
শনিবার, 04 ফেব্রুয়ারি 2023
অধ্যায় 14: গুণত্রয়বিভাগযোগ
1/2 (শ্লোক 1-10)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিদুষী মাননীয়া বন্দনা বর্ণেকর মহাশয়া


ভগবানের নিকট প্রার্থনার পর জীবনের বিকার রূপী অন্ধকার দূর করার হেতু ও জীবনের উন্নতির হেতু দীপ প্রজ্বলন করা হয়। গুরু বন্দনার পর মাতৃভূমিকে প্রণাম করে, ভগবান বেদব্যাস, জ্ঞানেশ্বর মহারাজ ও সদগুরুকে প্রণাম করে শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের বিবেচন সত্র শুরু হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন যখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়,  ভগ্নহৃদয়, নিরাশ, মোহগ্রস্ত  এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদগীতা বলেছিলেন এবং গীতাজীর জ্ঞানের মাধ্যমে হতাশ অর্জুনকে উৎসাহিত ও সুস্থির করে তুলেছিলেন যাতে অর্জুন তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন। আজকের পরিপ্রেক্ষিতেও, গীতার জ্ঞান সমানভাবে কার্যকরী। অর্জুনের পংক্তিতে যারা বসে রয়েছেন, তাদের জন্য এই শাশ্বত জ্ঞানের স্রোত পাঁচ হাজার বছর ধরে অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে। শ্রী ভগবান স্বয়ং সারথি হয়ে আমাদের পথ প্রশস্ত করেন। আমরা সবাই নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং সঠিক জ্ঞানের অভাবে বিপথগামী হয়ে যাই। গীতার জ্ঞান নিরন্তর প্রবাহিত হয়, যা আমরা আজও প্রাপ্ত করতে পারি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমন অর্জুনের সারথি হয়ে তাঁকে বিজয়ের পথের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তেমনি আমরাও শ্রীমদ্ভগবদগীতার জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে  সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারি। আমাদেরও অর্জুনের মতো শিষ্যত্বের অনুভূতি থাকা উচিত এবং শিষ্যের কর্তব্য হলো সকলকে  জ্ঞানের প্রসাদ বিতরণ করা। শ্রী ভগবান গীতার নবম অধ্যায়ে জ্ঞান ও বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেছেন এবং দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তি মার্গের সঠিক ব্যাখ্যা করেছেন।

চতুর্দশ অধ্যায়ে ভগবান সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ, এই তিনটি গুণের কথা বলেছেন। এসব গুণের পাশাপাশি তিনি অভ্যুদয় (উন্নতি) ও নিঃশ্রেয়স সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। অভ্যুদয় লৌকিক (জাগতিক) এবং আধ্যাত্মিক, এই দুইপ্রকারের হয় এবং উভয়ই আবশ্যক। এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে অভ্যুদয় বা জাগতিক উন্নতি আমাদের বন্ধনে আবদ্ধ করে। এই অধ্যায়ে যে সব গুণসমূহের বিষয় আমাদের এই বন্ধনে বেঁধে রাখে,  সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ভগবান যে এই গুণসমূহের উর্দ্ধে অর্থাৎ গুণাতীত, এ কথাও বোঝানো হয়েছে। ঠিক যেমন ভাবে নবম অধ্যায়ে, ঈশ্বর জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলি প্রকাশ করেছেন, সেই একই প্রকারে, এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তবে এই অধ্যায় তুলনামূলকভাবে সহজ এবং ব্যবহারিক স্তরে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়টি আলোচনা করার সময়, জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জী তাঁর গুরুদেবের শরণাপন্ন হন এবং একটি খুব সুন্দর কথা বলেন যে:-

म्हणुन साधका तु माऊली पिके सारस्वत तुझ्या पाऊली
या कारणी तुझी साऊली न खंडिन मी कदा

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন যে আমি  এটা জানি যে  আপনার চরণের সাথেই মা সরস্বতীর প্রবেশ হয়, তাই আমি কখনই আপনার ছায়াকে ছাড়ব না। কিন্তু  আপনি আমার ওপর এই কৃপা করুন যে আমার বুদ্ধি যেন আদর্শ সিদ্ধান্তে পরিপূর্ণ হয় এবং আমি যেন এই সিদ্ধান্তগুলি আমার ভক্তদের উপর বর্ষণ করতে থাকি।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কারণ আমরা যেই অভীষ্ট প্রাপ্ত করতে চাই, এটি সেখানে পৌঁছানোর পথ প্রশস্ত করে। অভ্যুদয় (উন্নতি) ও নিঃশ্রেয়স (মোক্ষ লাভ) মানবধর্মের দুই চাকা বলে মনে করা হয়  বিবেচিত। অভ্যুদয় থেকে নিঃশ্রেয়সের অভিমুখে গমনই মানব জীবনের অন্তিম গন্তব্য। আমরা কেন আমাদের অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছতে অসমর্থ হই ? কোন বন্ধন আমাদের আটকে দেয় ? এ হলো গুণের বন্ধন। এই বন্ধনে কে আমাদের বেঁধে রেখেছে? এই অধ্যায় আমাদের দর্পণ দেখায়।  আমাদের নিজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই অধ্যায়ে, অর্জুনের কোনো  জিজ্ঞাস্য না থাকা সত্ত্বেও স্বয়ং ভগবান এই জ্ঞান প্রদান করেছেন।

14.1

শ্রীভগবানুবাচ

পরং(ম্) ভূয়ঃ(ফ্) প্রবক্ষ্যামি, জ্ঞানানাং(ঞ) জ্ঞানমুত্তমম্
যজ্জ্ঞাত্বা মুনয়ঃ(স্) সর্বে, পরাং(ম্) সিদ্ধিমিতো গতাঃ॥1॥

শ্রীভগবান বললেন - আমি আবারও বলবো সকল জ্ঞানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (এবং) সর্বোত্তম জ্ঞান, যা জেনে সমস্ত ঋষিরা এই জগৎ থেকে পরম সিদ্ধি লাভ করেছেন (ক্ত)।

বিবেচন: শ্রী ভগবান বললেন, আমি তোমাকে সকল জ্ঞানের মধ্যে যা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান, তা পুনঃ অত্যন্ত সরলভাবে বলবো। এটি সর্বোত্তম জ্ঞান। ভগবান বলেন যে এই জ্ঞান দ্বারা পরমসিদ্ধি প্রাপ্ত হবে। একে বারবার শুনতে হয়, বুঝতে হয়, যতক্ষণ না স্থিরতা আসে। জ্ঞান প্রাপ্ত করার জন্য পুনরাবৃত্তি অত্যন্ত আবশ্যক কারণ জ্ঞান মনের মধ্যে স্থির থাকে না, আসা যাওয়া করতে থাকে, তাই আমি বারবার একথা বলব। একে প্রাপ্ত করে ঋষিগণ পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত করেন। এখানে ঋষিদের বিষয়টাও বুঝতে হবে। একজন মননশীল ব্যক্তিকে ঋষি বলা হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ এইসব কথা শুনে ভুলে যায়, কিন্তু যিনি মনন, চিন্তন এবং মন্থন করেন, তাকে ঋষি বলা হয়। এই জ্ঞানের মাধ্যমে ঋষিরা পরমসিদ্ধি প্রাপ্ত করে নেন।

সিদ্ধিও অনেক প্রকারের আছে, কিন্তু পরমাত্মার সাথে একরূপতা প্রাপ্ত করাই হল পরম সিদ্ধি। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জ্ঞান সম্বন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে সমস্ত জ্ঞানকে বুঝতে হবে। যেমন, উপজীবিকার জন্য জ্ঞান বা প্রপঞ্চের জ্ঞান বা জীবজগতের জ্ঞান, কিন্তু নিজেকে জানার জন্য, আত্ম তত্ত্বের জ্ঞানও আবশ্যক। শ্রীভগবানও সপ্তম অধ্যায়ে অর্জুনকে জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগের কথা বলেছেন। প্রকৃতি ও চৈতন্য মিলে সব ভূতমাত্রের সৃষ্টি হয়েছে। যদি হাত, পা, নাক, কান প্রভৃতি দেহের সব অঙ্গ থাকে কিন্তু  চৈতন্য না থাকে, তবে সেই দেহকে মৃত বলা হয়। চৈতন্য থাকলেই  শরীর সমস্ত কাজ সম্পন্ন  করতে পারে। অর্থাৎ পঞ্চভূত দেহ এবং  চৈতন্য রূপ আত্মাই সৃষ্টির জন্য আবশ্যক। এই অধ্যায়ে আমরা স্বয়ংকে জানতে পারি। এই অধ্যায়টি স্বয়ংকে দ্রষ্টার ভূমিকায় (সাক্ষী ভাব) দেখার অধ্যায়।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব উপাসনা ও যোগ সাধনার মাধ্যমে অনেক সিদ্ধি লাভ করেন। তিনি মা জগদম্বার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। যখন তার ভাই তাকে বলেছিলেন যে গদাধর, তোমাকে মা জগদম্বার সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে, তখন তিনি ভক্তিভরে মায়ের পূজা শুরু করলেন এবং তিনি তার মাকেও বলেছিলেন যে আমি যেন উপজীবিকার জন্য বিদ্যা অর্জন করবো না, আমি পরম জ্ঞান প্রাপ্ত করতে চাই, আমাকে পরম সিদ্ধি প্রাপ্ত করতে হবে এবং এই পরমসিদ্ধিই হলো শাশ্বত এবং চিরন্তন।

ভগবান বলেন, "আমি তোমাকে যে জ্ঞানের কথা বলছি, সেই জ্ঞানই অন্তঃকরণের আবরণ দূর করেই উদ্ভূত হয়। হে অর্জুন! এই জ্ঞান প্রাপ্ত  করে নিলে তুমি পরম তত্ত্বের গুণকে প্রাপ্ত করবে।" শ্রীভগবান আরও বলেন, যে ভক্তের পরমসিদ্ধি প্রাপ্ত করার ভাব উদ্দীপ্ত হয়, তখন 'যোগক্ষেমম্ বহাম্যহম' অর্থাৎ আমি তার যোগ ও ক্ষেমের(মঙ্গল) দায়িত্ব নিই।

14.2

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেন, যারা এই জ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে আমার স্বরূপ প্রাপ্ত করেন, তারা মহাপ্রলয়েও বিচলিত হন না। উপাশ্রিত্যের অর্থ হল আশ্রিত হওয়া, আবৃত হওয়া। যিনি এই জ্ঞানের আশ্রয়ে আছেন, যিনি নিয়মিত চিন্তন করেন, ধ্যান করেন, তিনি আমার রূপকে প্রাপ্ত করেন । সাধর্ম্য মানে একরূপতা, সামীপ্য (নৈকট্য) প্রাপ্তি  বা আমার মূল স্বরূপ "সত-চিৎ-আনন্দ" কে প্রাপ্ত করে নেওয়া। এই আনন্দ যা কখনও বিনষ্ট হয় না। এই জ্ঞানের দ্বারা, অজ্ঞতার মলিনতা দূর হয় এবং আমরা আত্ম স্বরূপ অর্থাৎ নিজের আত্ম সত্ত্বার স্পষ্ট দর্শন পাই।

উদাহরণস্বরূপ,  যদি একটি আংটি ক্লেদপূর্ণ বা অপরিষ্কার নদীতে পড়ে তবে তা বাইরে থেকে দেখা যাবে না, তবে জল স্থির ও শান্ত হয়ে গেলে এবং ক্লেদ পরিষ্কার করা হলে, সেই আংটিটি দৃশ্যমান হয়।

প্রলয়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গুরুদেব বলেছেন যে প্রলয় শব্দের অর্থ হল " লয়", সমস্ত কিছু পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়া। প্রলয় অনেক প্রকারের আছে। প্রধানত চার প্রকারের প্রলয়ের বর্ণনা করা হয়েছে - নিত্য, নৈমিত্তিক, প্রাকৃত ও অত্যন্তিক (অত্যাধিক)।

নিত্য প্রলয় - যেমন আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন চারপাশের জগত আমাদের কাছে লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়, সমাপ্ত হয়ে যায়। সকল প্রকার জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান হল আত্মজ্ঞান। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান হল সাধারণ জ্ঞান বা প্রপঞ্চের জ্ঞান। সর্বোত্তম জ্ঞান হল আত্ম-জ্ঞান।

গুরুদেব  এই প্রসঙ্গে সুন্দর একটি ঘটনা বলেছেন- এক মহাজন অনেক টাকা অর্জন করল। অতিরিক্ত সম্পদের কারণে তার পরবর্তী প্রজন্মের নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে। তাই দেখে মহাজন তার পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি তার এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে ডেকে বললেন, আমার সমস্ত টাকা তুমি মাটির নীচে লুকিয়ে রাখো এবং আমার মৃত্যুর পর যদি আমার ছেলেরা সমস্ত ধন সম্পত্তি উড়িয়ে শেষ করে দেয় তবে এই টাকাটি তাদের দিয়ে দেবেন। পরবর্তীকালে ঠিক তেমনটাই হলো। মহাজনের ছেলেরা সব টাকা উড়িয়ে খরচ করে দরিদ্র হয়ে গেল। মহাজনের এক ছেলে খুব যোগ্য ছিল, সে বিদেশে থাকতো। দেশে ফিরে সব পরিস্থিতি দেখে সে অত্যন্ত দুঃখিত হলো। তখন মহাজনের বন্ধু ছেলেটিকে তার কাছে গচ্ছিত সেই লুকানো টাকার কথা বলল এবং টাকা পেয়ে সেই ছেলেটি খুব খুশি হয়ে মহাজনের বন্ধুকে বলল যে আমাকে টাকা দেওয়ার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। তখন মহাজনের বন্ধু বললেন, আমি তোমাকে কোনো টাকা দিইনি, আমি শুধু তোমার টাকার ওপর থেকে আবরণ সরিয়ে দিয়েছি। একইভাবে গুরুর কৃপায় আমাদের জ্ঞানের উপরের আবরণ দূর হয় এবং আমাদের জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়। এখানে শ্রী ভগবান হলেন অর্জুনের শিক্ষক এবং মোহের আবরণ দূর করে তিঁনি অর্জুনকে জ্ঞান প্রদান করেছিলেন।

14.3

ইদং(ঞ) জ্ঞানমুপাশ্রিত্য, মম সাধর্ম্যমাগতাঃ
সর্গেপি নোপজায়ন্তে, প্রলয়ে ন ব্যথন্তি চ॥2॥

এই জ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে যারা আমার ধার্মিকতা লাভ করেছে, (তারা) মহাকল্পেও জন্ম নেয় না এবং মহাপ্রলয়েও দুঃখ পায় না।

বিবেচন:শ্রীভগবান বলেন, হে অর্জুন! আপনি এবং সমস্ত পঞ্চভূত, শুধুমাত্র আমার মায়া দ্বারাই নির্মিত হয়েছে। 

प्रकृतिं स्वामवष्टभ्य विसृजामि पुनः पुनः।
भूतग्राममिमं कृत्स्नमवशं प्रकृतेर्वशात्।।

শ্রী ভগবান অর্জুনকে ব্যাখ্যা করেন যে কিভাবে এই সৃষ্টিকে সঞ্চালিত করা হয়। শ্রীভগবান প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, প্রকৃতি আমার নির্দেশনায় এই জগৎ সংসারকে সৃষ্টি করে। আমার মহদ্ ব্রহ্মরূপ মূল প্রকৃতিই হল সমস্ত প্রাণীর যোনি, অর্থাৎ গর্ভাশয় এবং আমিই বীজ রূপে তাতে গর্ভ স্থাপন করি এবং এই সংসারের নির্মাণ করি। এই বিষয়টি বিশদভাবে বোঝানোর জন্য  একজন পুরুষ এবং  মহিলার উদাহরণ নেওয়া হয়েছে। প্রকৃতি হলো নারী এবং আমিই মহদ্ ব্রহ্মরূপ পুরুষ রূপে গর্ভ স্থাপন করি এবং সমগ্র সৃষ্টির নির্মাণ করি যার মধ্যে  চুরাশি লক্ষ যোনি রয়েছে।

এখানে বিদ্যুতের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে , যেমন বিদ্যুৎ শক্তি যোগায় এবং ফ্রিজে শীতলতা এবং হিটার আমাদের তাপ দেয়। একইভাবে পরমাত্মার চেতনা শক্তি, বিভিন্ন নামে ও রূপে ভূতমাত্রের দ্বারা, কর্ম সম্পাদিত করে যাচ্ছে।

এই কর্মটি জড় ও চেতনার সমন্বয়ে সম্পন্ন হয়। যেমন, কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজ করার অর্থ হল কম্পিউটারটি হলো জড়, যার নিজের স্বরূপ  সম্পর্কে জ্ঞান নেই এবং যে ব্যক্তি কম্পিউটারে কাজ করছে, যার নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে, সে হলো চেতনা। সমস্ত যোনিতে কোষ রয়েছে যেমন অন্নময় কোশ, মনোমায় কোশ, বিজ্ঞানময় কোশ ইত্যাদি।

আমিই পিতা, যিনি সকল প্রাণীর মধ্যে বীজ স্থাপন করেন। সবার মধ্যেই আমার গুণ বিদ্যমান। আমরা সমস্ত পঞ্চভূতকে ভিন্ন ভিন্ন দেখি কিন্তু  সবার মধ্যে আমি, পরম পিতার রূপে বিদ্যমান আছি। সাংখ্য যোগীরা বিশ্বাস করেন যে প্রকৃতি এবং পুরুষের সমন্বয়ের (মিলন) মাধ্যমে কার্য সম্পাদন হয়, কিন্তু তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু ঈশ্বর এখানে বলেছেন যে আমিই স্বয়ং প্রকৃতি এবং পুরুষের সংযোগ করাই। প্রকৃতি সবাইকে বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং এই বন্ধনগুলি হল ত্রিগুণ। এই ত্রিগুণ হল সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ।

14.4

মম যোনির্মহদ্ব্রহ্ম , তস্মিন্ গর্ভং(ন্) দধাম্যহম্
সম্ভবঃ(স্) সর্বভূতানাং(ন্), ততো ভবতি ভারত॥3॥

হে ভারতবংশোদ্ভব অর্জুন! আমার আদি প্রকৃতিই উৎপত্তিস্থল (এবং) আমি এতে আত্মার গর্ভ স্থাপন করি। তা থেকে সমস্ত প্রাণীর জন্ম হয়।

বিবেচন: ভগবান বলেন, হে অর্জুন! এই সংসারে অসংখ্য প্রকারের যোনি রয়েছে। বলা হয় যে কীট থেকে মানুষ পর্যন্ত চুরাশি লাখ যোনি আছে। মানুষ সর্বোত্তম সৃষ্টি কারণ মানুষের শরীরের  সমস্ত কোষ বিকশিত। মানুষের মধ্যে অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় এবং আনন্দময় কোশ বিকশিত হয়। পৃথিবীতে অসংখ্য ধরনের জীব রয়েছে। অসংখ্য যোনিতে শরীর নির্মিত হয়। এই জীবদের পিতা-মাতার আবশ্যকতা হয়।  সমস্ত ভূতমাত্রের (মূর্তিসমূহ) যে গর্ভে সৃষ্টি হয়, সেই যোনি আমার পত্নী এবং আমিই বীজ প্রদানকারী পিতা। যে প্রকার সূর্যের আভা ও আলো সূর্যের  অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চন্দ্রের শীতলতা, জলের শীতলতা তাদের সাথে অবিচ্ছেদ্য, একইভাবে প্রকৃতিও পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আলাদা নয়। পৃথিবীতে এত বৈচিত্র্য কি কারণে আছে ? এটা আমাদের বুঝতে হবে।

हर देश में तू, हर वेश में तू, तेरे नाम अनेक, तू एक ही है।

আমরা এই একরূপতা দেখতে পাই না, কেবলমাত্র  বৈচিত্র্যই  দেখি। অগণিত প্রকারের ফুল, ফল, প্রাণী, পাখি ও মাছ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা সেই বিচিত্রতার উপলব্ধি করি। কিন্তু আমাদের এই  বৈচিত্র্যের থেকে ঐক্যের দিকে যেতে হবে। শ্রী ভগবান বলেছেন, কীভাবে চুরাশি লক্ষ যোনি সৃষ্টি হয়েছিলো এবং তারপর সৃষ্টির সময় এই সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়েছিল। কে তাদের প্রকাশিত করেছিলো?

14.5

সর্বযোনিষু কৌন্তেয় , মূর্তয়ঃ(স্) সম্ভবন্তি যাঃ
তাসাং(ম্) ব্রহ্ম মহদ্যোনিঃ(র্), অহং(ম্) বীজপ্রদঃ(ফ্) পিতা॥4॥

হে কুন্তীনন্দন! সমস্ত প্রাণীর মধ্যে যে সমস্ত দেহের জন্ম হয় তার আদি প্রকৃতি হল মাতা (এবং) আমিই পিতা যিনি বীজ স্থাপন করেন।

বিবেচন: শ্রী ভগবান বলেছেন যে কিছু কাজ আছে, যা আমরা করতে পারি, করা সম্ভবপরও  কিন্তু তবুও আমরা করতে পারি না। কোন কোন বাধা আমাদের পথকে  অবরোধ করে ?

আগমের খুব সুন্দর একটি বাক্য আছে-

पाश बद्ध सदा जिव:, पाश मुक्त सदा शिव:।

যিনি বন্ধনে আছেন তিনি জীব, কিন্তু যিনি বন্ধনমুক্ত তিনি সদা শিব।

ভগবান অর্জুনকে মহাবাহো বলেছেন কারণ ভগবান ক্রমাগত অর্জুনকে তার বিশেষত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একজন গুরু এবং একজন উপদেষ্টার (Mentor) এটা কর্তব্য। ভগবান এই শ্লোকে অর্জুনকে প্রকৃতির স্বভাব সম্পর্কে বলেছেন। জীব পাশবদ্ধ প্রাণী।  এই পাশ বা বন্ধন দেহীকে (দেহধারী) দেহের সাথে আবদ্ধ করে। এই বন্ধন হলো তিনটি গুণ - সত্ত্বগুণ , রজোগুণ ও তমোগুণ। জীব হলো পাশবদ্ধ এবং শিব অর্থাৎ আমি হলাম পাশমুক্ত। ক্ষয়শীল দেহ অক্ষয় (অব্যয়) চৈতন্যকে তিনটি গুণের সাথে আবদ্ধ করে রাখে । এখানে গুণের অর্থ বোঝাটাও খুব জরুরি। এখানে গুণ অর্থাৎ গুণধর্মকে (quality) বলা হয়েছে। যেমন অগ্নির গুণধর্ম দহন করা এবং জলের গুণধর্ম শীতলতা। গুণকে সংস্কৃতে দড়িও বলা হয়। দড়ি যেমন বাঁধে, তেমনি এই তিনটি গুণ জীব মাত্রকে  বেঁধে রাখে।

সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনটি গুণ এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায় - যেমন স্টিয়ারিং, পেট্রোল এবং ব্রেক, তিনটিই গাড়ি চালানোর জন্য অপরিহার্য। গাড়িকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য স্টিয়ারিং আবশ্যক, এটি সত্ত্বগুণের উদাহরণ। জ্বালানী হিসাবে পেট্রোল শক্তি দেয় যা রজোগুণের উদাহরণ এবং গাড়ি থামাতে ব্রেকের প্রয়োজন যা তমোগুণের উদাহরণ। সঠিক জায়গায় পৌঁছানোর জন্য এই তিনটির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন।

আত্ম-তত্ত্ব অব্যয়, অবিনশ্বর। এই তিনটি গুণ সেই অবিনশ্বর আত্মাকে দেহের সাথে আবদ্ধ করে। এদের বিস্তারিতভাবে উপলব্ধি করতে হবে। যিনি অবিনশ্বর, অব্যয় জীবাত্মা, যার বিস্তৃত (সর্বব্যাপী) স্বরূপ রয়েছে, তাকে দেহের সাথে আবদ্ধ করে। বিস্তৃত এবং ব্যাপ্ত হল পরস্পরবিরোধী স্বরূপ কিন্তু এরা একাত্ম হয়ে থাকে। চেতনা বিস্তৃত, জড় ব্যাপ্ত । গ্যাস বেলুন যাতে উপরে না যায়, তাই বেলুনের সাথে আমরা ওজন বেঁধে দিই, একইভাবে আমাদের দেহের সাথে গুণগুলি বাঁধা রয়েছে, তাই আমরা পরমাত্মার সচ্চিদানন্দ স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে দেহের বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছি। আমরা শরীর থেকে প্রাপ্ত আনন্দে খুশি আর দুঃখে দুঃখী হয়ে যাই। গুণের লক্ষণগুলিও বুঝে নাও। প্রতিটি জীবের মধ্যে গুণের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণ রয়েছে। যা 'permutations and combinations'  দ্বারা বোঝা যায়। প্রত্যেকের মধ্যে  সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণ  রয়েছে। কিন্তু যারা অলস তাদের সত্তর শতাংশ তমোগুণ থাকে। যারা জ্ঞানী তারা সত্তর শতাংশ সত্ত্ব গুণসম্পন্ন হয়। দাঁত ওঠার প্রক্রিয়াটি সবাই পছন্দ করে, তবে সময়মত দাঁত আসা বন্ধ হওয়াও প্রয়োজন। তমোগুণের কারণে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং তা অনিবার্যও বটে। এই তিনটি গুণের ব্যবহার করে, তাদের ক্ষতিকারক প্রভাব এবং অতিরিক্ত প্রভাবগুলি কিভাবে এড়ানো যায়, এটা যখন তুমি উপলব্ধি করে নেবে, তখন গুণাতীত হওয়ার ইচ্ছা বাড়তে শুরু করবে। ভগবান অর্জুনকে এটাই বুঝিয়েছেন। শ্রী ভগবান বলেন, এখন সত্ত্বগুণের লক্ষণও জেনে নাও ।

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন:-

एरवी ज्ञान हे रूप आपुले | परि परके ऐसे जाहले | कारण आवडोनि घेतले | भवस्वर्गादिक || 

এই জ্ঞান হলো আমাদের নিজস্ব জ্ঞান যা আবরণে ঢাকা পড়ে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এবং মানুষ মর্ত্য ও স্বর্গের আনন্দে মগ্ন হয়েছে।

तैसे हे ज्ञान येता उदया | अन्य ज्ञाने जात लया | म्हणोनिया धनंजया | उत्तम हे ||  

স্বয়ংকে জানা সর্বোত্তম জ্ঞান এবং যখন এই জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তখন অন্য জ্ঞানের আবশ্যকতা থাকে না। তখন এই জ্ঞান স্বয়ংস্ক্রিয়ভাবে প্রাপ্ত হতে থাকে।

14.6

সত্ত্বং(ম্) রজস্তম ইতি, গুণাঃ(ফ্) প্রকৃতিসম্ভবাঃ
নিবধ্নন্তি মহাবাহো, দেহে দেহিনমব্যয়ম্॥5॥

হে মহান যোদ্ধা! সত্ত্ব, রজ (এবং) তম প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত - এই (তিন) গুণগুলি অবিনশ্বর আত্মা।(জীবাত্মা) দেহে।

বিবেচন: শ্রী ভগবান বলেন হে অনঘ্ অর্জুন! এই তিনটি গুণের মধ্যে সর্বোত্তম গুণ হল সত্ত্বগুণ। ভগবান অর্জুনকে অনঘ বললেন কারণ অর্জুন নিষ্পাপ, শুদ্ধ, কুটিল নন।

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জী বলেছেন:-

तु समनु शुद्धमती, अनिंदकु अनन्य गती।
गौप्य तरी तुज प्रति आवळिजे।।

অর্জুন তুমি সুমনের অধিকারী। তোমার হৃদয় সুন্দর, তোমার মনের ভাবও শুদ্ধ এবং তুমি কারুর নিন্দা করো না এবং গুরুদেবের শরণাগত কিভাবে হতে হয়, তা যেন তোমার থেকেই সবাই শেখে । এই কারণেই আমি তোমাকে এই সিদ্ধান্তের কথা বলার জন্য লালায়িত। গুলাবরাজ জী মহারাজ বলেছেন যে সত্ত্ব গুণ বৃদ্ধি করাই একজন মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত । মানুষের নিরন্তর চেষ্টা করা উচিত যাতে সে তম থেকে রজ এবং রজ থেকে সত্ত্বগুণে প্রবেশ করে।

শ্রীভগবান বলেছেন যে সত্ত্বগুণ পবিত্র, শুদ্ধ, প্রকাশের উৎস, জ্ঞানদাতা। সত্ত্বগুণ মনের বিকার দূর করে।  এই সেই গুণ যা মনের মলিনতা ধুয়ে দেয়। এই সত্ত্বগুণ হল অনাময় অর্থাৎ  এটি রোগ নিরাময় করে । এই গুণ সুখ প্রদানকারী ।

গীতাজীর মাহাত্ম্য গাইতে গিয়ে মহানুভব বলেছেন যে:-

 मलनिर्मोचनं पुंसां जलस्नानं दिने दिने |
सकृद्गीताम्भसि स्नानं संसारमलनाशनम्||

আমরা যেমন জল দিয়ে স্নান করে আমাদের এই জাগতিক দেহের ময়লা পরিষ্কার করি, ঠিক তেমনি গীতাজীর জল দিয়ে প্রতিদিন স্নান করা উচিত, যা আমাদের  ভিতর এবং বাইরে থেকে শুদ্ধ ও  পবিত্র করে তোলে। গীতা পাঠ, শ্রবণ এবং মুখস্ত করলেও অন্তঃকরণের শুদ্ধি হয় এবং সত্ত্বগুণের উদ্ভব হয় ।

কিন্তু এই সত্ত্ব গুণও আমাদের বন্ধনে আবদ্ধ করে। এটি সুখ প্রাপ্তির বন্ধনে আবদ্ধ করে। জ্ঞান অর্জন করার  উৎপন্ন হয়। জ্ঞান দ্বারা অহংকারের উৎপত্তি হতে পারে, অন্যদের প্রতি হীন দৃষ্টিভাবের কারণও হয়ে উঠতে পারে যা আমাদের মানসম্মানের ক্ষতি করতে পারে।

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন:-

हा ज्ञानाने माजतो, अहंकारा ने ताठ होतो।

যখন জ্ঞানের সাথে অহংকার আসে, তখন মানুষ অহংকারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তখন জ্ঞান আহরণ করাই উত্তম মনে হয় কর্ম  করার ইচ্ছা হ্রাস পায়। অসম্পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি এর বন্ধনে বেঁধে যায়। শুদ্ধ সত্ত্বগুণী মনুষ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয় না।

এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের একটি খুব সুন্দর ঘটনা আছে।

স্বামীজীকে একবার বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখন সেখানে বর্ণবৈষম্য খুবই প্রচলিত ছিল। স্বামীজি শ্যামলা বর্ণের ছিলেন, তাই অনুষ্ঠান সভায় দারোয়ান স্বামীজীকে নিগ্রো মনে করে ভিতরে যেতে দেয়নি। স্বামীজী ফিরে চলে এলেন। কিছুদিন পর সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করে এবং স্বামীজীকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি অনুষ্ঠানে কেন আসেননি ? স্বামীজী বললেন আমি সেখানে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমার দারোয়ান আমাকে নিগ্রো ভেবে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। ভদ্রলোক তখন বললেন, আপনি দারোয়ানকে কেন বলেননি যে আপনি নিগ্রো নন। এর উত্তরে স্বামীজী বললেন, আমি একথা বললে তা নিগ্রোদের অপমান করা হতো। কাউকে নিচে দেখিয়ে আমি উপরে উঠতে চাই না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের শেখায় যে কীভাবে দৃষ্টিকে উপরে রাখতে হয় যাতে আমরা  অধঃপতনের দিকে অগ্রসর না হই।

14.7

তত্র সত্ত্বং(ন্) নির্মলত্বাৎ , প্রকাশকমনাময়ম্
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি, জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ॥6॥

হে পাপহীন অর্জুন! এই গুণগুলির মধ্যে সত্ত্ব উপাদানটি নির্মল (পরিচ্ছন্ন) হওয়ার কারণে, প্রকাশক (এবং) অপরিবর্তনীয়। (শরীরকে) সুখের আসক্তি এবং জ্ঞানের সাথে সংযুক্ত করে।

বিবেচন:শ্রীভগবান বলেছেন, হে কুন্তীনন্দন অর্জুন! রজোগুণ মনুষ্যকে আসক্ত করে, কামনা-বাসনা সৃষ্টি করে। রজ শব্দটি রঞ্জন থেকে এসেছে, এই গুণটি মনোরঞ্জন চায়, বিনোদন চায়। আসক্তি নির্মাণ করে। তোমাকে নিরলস কর্ম করতে ও কর্ম সম্পাদিত করতে বাধ্য করে। কোথায় থামা উচিত, রজোগুণী ব্যক্তি তা বুঝতে পারে না। এটি মনের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, অতৃপ্তি তৈরি করে। রজোগুণী ব্যক্তি আশা ও আকাঙ্ক্ষার বন্ধনে পড়ে সম্পূর্ণ শক্তিতে তা পরিপূর্ণ করার জন্য পরিশ্রম করতে থাকে। শ্রীমদ্ভগবদগীতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমাদের কিভাবে দেখা এবং বোঝা উচিত।

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জী বলেছেন:-

रंजन करतो जिवाचे म्हणून रज नाव याचे |  

রজোগুণ বিনোদন চায়। এই গুণ রাগ (অনুরাগ) এবং আসক্তি বৃদ্ধি করে। অত্যধিক আসক্তির সাথে কামনা, তৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। একের পর এক উন্নতি, একের পর এক প্রতিপত্তি পাওয়ার দৌড় শুরু হয়ে যায়। পরিশ্রম ছাড়া সফলতা নেই, এটাই সত্য। কিন্তু কাজ করার সময় কোথায় থামতে হবে তাও শিখতে হবে।

14.8

রজো রাগাত্মকং(ম্) বিদ্ধি , তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় , কর্মসঙ্গেন দেহিনম্॥7॥

হে কুন্তীনন্দন! রজোগুণকে (আপনি) বিবেচনা করুন যা তৃষ্ণা ও আসক্তি সৃষ্টি করে। তিনি মূর্ত আত্মাকে কর্মের সংযুক্তি দ্বারা আবদ্ধ করেন।

বিবেচন :  শ্রী ভগবান বলেন, হে ভরতবংশী অর্জুন! তমোগুণের সৃষ্টি অজ্ঞতা থেকে হয়। এখানে অর্জুনকে ভারত বলা হয়েছে যার অর্থ জ্ঞানে নিযুক্ত হওয়া। তমোগুণে আসক্তি, অজ্ঞানতা, অলসতা উৎপন্ন হয়। তমোগুণ বৃদ্ধি পেলে প্রমাদ (ভুল), অলসতা, তন্দ্রা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। অলসতা, নিদ্রা প্রভৃতি দ্বারা তমোগুণ জীবকে আবদ্ধ  করে রাখে । এটাও আমাদের বুঝতে হবে।

জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জী বলেছেন:-

मार्गी जाता घसरुन पडला तरी तेथेच लागे डोळा
झोप येता अम्रुताला नाकारतो।

তমোগুণ এমন যে, তমোগুণের নিয়ন্ত্রণে পথে চলতে গিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি কোথাও হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তবে সে সেখান থেকে না উঠে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে এবং তাকে যদি অমৃতও দেওয়া হয়, সেটাও  গ্রহণ করার জন্য উঠতে পারে না। তার ওপর এমনভাবেই নিদ্রার আধিপত্য থাকে !  এই ধরনের ব্যক্তি ঘুম বা বিশ্রাম খুব পছন্দ করেন। তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করে এবং অজ্ঞানে আবদ্ধ করে।

14.9

তমস্ত্বজ্ঞানজং(ম্) বিদ্ধি, মোহনং(ম্) সর্বদেহিনাম্
প্রমাদালস্যনিদ্রাভিঃ(স্ ), তন্নিবধ্নাতি ভারত॥8॥

আর হে ভরত অর্জুন! তমগুণ (আপনি) বিবেচনা করুন যা অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত সমস্ত অবতারকে প্রলুব্ধ করে। তিনি পরমানন্দ, অলসতা এবং ঘুমের দ্বারা (যারা দেহের সাথে তার সম্পর্কে বিশ্বাস করেন) আবদ্ধ করেন।

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেন, বন্ধনের অর্থ না বুঝলে বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন যে  সত্ত্বগুণের কথা বলতে বলতে এই দেশ, ভারতবর্ষ তমোগুণের প্রভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিবেচনাসভায় শুনতে গিয়েও অনেকের ঘুম পেয়ে যায়। সত্ত্বগুণ কখন তমোগুণে পরিবর্তিত হয়ে যায়, তা বোঝা যায় না।

শ্রীভগবান বলেছেন হে অর্জুন, সত্ত্বগুণ সুখের সাথে আসক্ত করে রাখে।  রজোগুণ কর্মের বন্ধনে বেঁধে রাখে এবং জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে। তমোগুণের কারণে ভুলভ্রান্তি বেড়ে যায়। নিদ্রার মধ্যে সুখের অনুভব আসতে থাকে, অলসতা বাড়ে। এই তিনটি গুণ একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে। এটা আমাদের বুঝতে হবে।

14.10

সত্ত্বং(ম্) সুখে সঞ্জয়তি, রজঃ(খ্) কর্মণি ভারত
জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ(ফ্), প্রমাদে সঞ্জয়ত্যুত॥9॥

হে ভারতবংশোদ্ভব অর্জুন! সত্ত্বগুণ জয় করে (মানুষের উপর) সুখে (এবং) রজোগুণকে কর্মে রেখে। কিন্তু তমোগুণ (মানুষকে) জয় করে জ্ঞান ঢেকে এবং পরমানন্দে রেখে।

বিবেচন: শ্রীভগবান বলেন, হে অর্জুন! রজোগুণ ও তমোগুণকে দমন করলে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পায়। প্রাতঃকালে ঘুম থেকে ওঠা,  যোগব্যায়াম করা, এগুলি সত্ত্বগুণ। তমোগুণ বাড়লে প্রাতঃকালে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছা হয় না। আমাদের দেখা উচিত তিনটি গুণের মধ্যে কোনটি প্রবল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। তমোগুণকে দমন করে রজোগুণ ও সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। শ্রী ভগবান বললেন আমি এই তিন গুণ থেকে মুক্ত, আমি গুণাতীত। যাঁরা এই গুণগুলিকে বুঝতে পারেন এবং সাক্ষী (দ্রষ্টা) ভাব নিয়ে গুণগুলিকে অনুধাবন করে গুণাতীত হওয়ার প্রচেষ্টা করেন, তাঁরা সিদ্ধিপ্রাপ্ত হন।

এই প্রসঙ্গে একটি খুব সুন্দর উদাহরণ বলা হয়েছে : -  একটি গর্ভবতী সিংহী কিছু ছাগল শিকার করতে গিয়ে আহত হয় এবং প্রসব বেদনা শুরু হয় এবং তার শাবকের জন্ম হয়। শাবকের জন্মের সাথে সাথে সিংহী মারা যায়।  সিংহ শাবকটি সেই ছাগলদের সাথেই বড় হয় এবং ছাগলের মতোই আচরণ করে। সে বুঝতে পারে না যে সে একটি সিংহ এবং সে তার আসল স্বরূপ ও প্রকৃতি ভুলে যায়। একদিন অন্য একটি  সিংহ তাকে পুকুরের জলে তার প্রতিবিম্ব দেখায়, অর্থাৎ তার আসল স্বরূপ, তখন তার মধ্যে আবার সিংহ হওয়ার জ্ঞান, উপলব্ধি জেগে ওঠে এবং শরীরে শক্তিও আসে। তাই সঠিক জ্ঞান অত্যন্ত আবশ্যক।

আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন:-

न मे मृत्यु शंका न मे जातिभेद: पिता नैव मे नैव माता न जन्म:
न बन्धुर्न मित्रः गुरुर्नैव शिष्य: चिदानन्द रूप: शिवोऽहम् शिवोऽहम्।

অর্থাৎ আমি মৃত্যুও নই, শঙ্কাও নই, জাতিভেদও নই, পিতাও নই, মাতাও নই, জন্মও নই, বন্ধুও নই, গুরু নই, শিষ্যও নই। আমি চিদানন্দ স্বরূপ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং আমাদের সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ আমাদের সেই গন্তব্যে নিয়ে যায় এবং আমাদের নিজের প্রকৃত স্বরূপের দর্শন করায়। উপরোক্ত গল্পে, সিংহ যখন সিংহীর বাচ্চাকে তার আসল স্বরূপ দেখালো, তখনই সে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তি অনুভব করেছিল।

রামচরিতমানস, জ্ঞানেশ্বরী, শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং আমাদের সমস্ত ধর্মগ্রন্থ,  আমাদের নিজের স্বরূপের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়। আমাদের বলে, তুমি এই দেহ নও, তুমি চৈতন্য স্বরূপ।

এই সকল গুণ এবং গুণাতীতের বৈশিষ্ট্য, আমরা আগামী বিবেচন সত্রে বুঝব। গুরুদেব যেন আমাদের সেই গন্তব্যে নিয়ে যান এবং আমাদের পথ প্রশস্ত করেন, এই প্রার্থনার মাধ্যমে আজকের বিবেচন সত্র শেষ হয় এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়।

প্রশ্নোত্তর পর্ব 

প্রশ্নকর্তা:
হার্দিক জী 
প্রশ্ন:
আমি আচরণে সত্ত্বগুণ ধারণ করার চেষ্টা করি এবং এই প্রকার খাবারও খেতে চাই, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমি যখন এই প্রকার খাবার না পেয়ে দুঃখিত বোধ করি, তখন আমার কী করা উচিত?
উত্তর-:  
সত্ত্বগুণ সম্পন্ন খাবার খাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করুন এবং তা যদি সম্ভবপর না হয় তবে জীবন ধারণ করার জন্য অন্য খাবার গ্রহণ করলে সত্ত্বগুণ হ্রাস পাবে না। যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ | যে খাবার আপনি গ্রহণ করছেন, প্রথমে তা ভগবানকে নিবেদন করুন এবং তারপরে খান। কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর থাকবে না। 

প্রশ্নকর্তা:
গীতা জী 
প্রশ্ন-
  তিনটি গুণের ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখা যায়?
উত্তর-
সত্ত্বগুনকে বৃদ্ধির করার হেতু কর্ম করতে থাকুন। রজোগুণকে শান্ত রাখুন, অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করুন এবং তমোগুনের প্রতি মনোযোগ দিয়ে তাকে সংযত রাখার চেষ্টা করুন।

প্রশ্নকর্তা:
শিব রাম জী
প্রশ্ন-
 ভগবানকে সর্বগুণসম্পন্ন বলা হয়, এটা কি এই ত্রিগুণের সম্পর্কেই বলা হয়েছে?
উত্তর- 
ভগবানের সর্বগুণসম্পন্ন হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণ তিঁনি এই তিনটি গুণের উর্দ্ধে, তিঁনি গুণাতীত। তিঁনি যখন মানব রূপে অবতার হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেন, তখন তিঁনিও এই  ত্রিগুণের  বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান কিন্তু তিনি সেই গুণগুলির সাথে মানুষের মতোই আচরণ করেন। তিঁনি নিজের আচরণের মাধ্যমে সবাইকে বলেন যে কিভাবে এই তিনটি গুণের ভারসাম্য বজায় রেখে জীবন যাপন করা যায়।  এখানে এর একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন শ্রীকৃষ্ণকে সত্ত্বগুণের উদাহরণের রূপে এবং অর্জুনকে রজোগুণের উদাহরণ রূপে বলা হয়েছে ।

প্রশ্নকর্তা:
শিব রাম জী 
প্রশ্ন-
অহংকারের ব্যাখ্যা করুন ?
উত্তর-
অহংকার খুবই সূক্ষ্ম। এটি "আমার" এই প্রকার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত হয়। আমি ভালো, এই ভাব হলো আত্মসম্মানবোধের ভাব, কিন্তু আমি যদি বলি যে শুধুমাত্র আমিই ভালো, তাহলে সেটা গর্ব ও অহংকারের ভাব।

প্রার্থনার শেষে বিবেচন সত্র সমাপ্ত হয়।