विवेचन सारांश
মনের সংযম, আসক্তি, কর্ম ও প্রকৃতিজাত গুণগুলির ক্রিয়া আমাদের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
ভগবদ্গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের বিষয় হল তিনটি গুণের বিভাগ যোগ এবং এখানে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে আমাদের মন আমাদের বন্ধু হতে পারে এবং শত্রুও হতে পারে। বলা হয়েছে সুখ এবং সাফল্য কিভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত।
বিবেচন সত্রটি আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে শুরু হল।
এই অধ্যায় আমাদের মনস্তত্ত্ব, প্রকৃতি এবং মনের ক্রিয়া সম্বন্ধে বুঝতে সাহায্য করে। মন হল মানুষের সবথেকে শক্তিশালী হাতিয়ার যা মানুষের বন্ধু হতে পারে আবার শত্রুও হতে পারে। যিনি মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি সফল হন, সাফল্যের সাধনায় মনের সংযম নিতান্ত প্রয়োজনীয়। সাফল্য কি এবং কেন লোকে সাফল্যের অন্বেষণ করেন ?
সফলতা মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সোপান। সবাই সফল হতে চান। বস্তুগত বিষয়ে হোক বা অন্য কোন বিষয়ে হোক সুখের জন্য মানুষ সাফল্যের অন্বেষণ করেন। সবাই সুখী হতে চান। সুখ জীবনের এমন একটা অবস্থা যেখানে ব্যথা বা দুঃখ থাকে না।
প্রত্যেক আকাঙ্ক্ষা এবং কর্মের উৎস হল সুখ। আমরা সুখের সন্ধান করি কারণ আমরা অপূর্ণ সাধ, দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ব্যথা বা দুঃখ অনুভব করতে চাইনা। যারা পরিপূর্ণরূপে সন্তুষ্ট তাদের আমরা সফল বলে ধরে নেই।
প্রত্যেকেরই সুখের ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি থাকে। কিছু লোক সন্তানপ্রাপ্তিতে সুখী হন, একটি ছাত্র পরীক্ষাতে প্রথম হলে সুখী হয় এবং কেউ যা অর্জন করে তার জন্য প্রশংসিত হলে সুখী হয়। কিছু লোক নতুন দক্ষতা এবং জ্ঞানার্জনে সুখ খুঁজে পায় যা তাদের সুখী ও তৃপ্ত করে। কেউ প্রচুর অর্থ অর্জন করে বড় প্রাসাদ কেনার জন্য, বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য এবং সব কিছু নিজের দখলে রাখার জন্য যা তাকে তৃপ্ত করবে এবং এটাই তার সফলতার মাপকাঠি। আমাদের নিজস্ব কর্তব্য এবং দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন যেমন একটি ছাত্রের দায়িত্ব হল রোজ পড়াশোনা করা এবং শিক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত অনুশীলন সম্পূর্ণ করা। যদি এই কর্তব্যগুলি অসম্পূর্ণ থাকে তাহলে ভবিষ্যতে কষ্ট ভোগ করতে হয়। এই কষ্টগুলি আমাদের দুঃখ ও পীড়ার কারণ হয়।
মনের অস্থিরতা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং কাম্য লক্ষ্য অর্জন থেকে মনকে বিচ্যুত করে। মন এবং তার সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাকে সংযত রাখতে হলে আমাদের মনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বুঝতে হবে যা
শ্রীভগবান এই অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেছেন।
দুই ধরনের ছাত্রদের কথা ধরা যাক একদল যারা ৮০% নম্বর পেয়েছে আর একদল যারা ৯০% এরও বেশী নম্বর পেয়েছে। দুইদল ছাত্রেরই বুদ্ধিমত্তা প্রায় একইরকম। এই দুই দলের পার্থক্যের কারণ হল প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা। প্রথম দল পড়াশোনায় অনিয়মিত, কখনও অনেকক্ষণ ধরে পড়ে আবার কখনও একদম পড়াশোনা করেনা, যেখানে দ্বিতীয় ধরনের ছাত্রেরা নিয়মিত ভাবে পড়াশোনা করে তা অল্প কয়েক ঘণ্টার জন্যই হোক না কেন। প্রথম ধরনের ছাত্রদের তুলনায় এদের মানসিক সংযম অনেক বেশী।
যে কোন সফলতা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা ও অধ্যাবসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একমাত্র মানসিক সংযম দ্বারাই প্রাপ্ত হয়। কি করে আমরা মনের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ আনতে পারব যোগেশ্বর এই অধ্যায়ে সেই জ্ঞানের ব্যাখ্যা করেছেন। এই যোগে মনের প্রকৃতি এবং তাকে সংযত রাখার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
একইভাবে গীতা পরিবারের ক্লাসেও কিছু ছাত্র আছেন যাদের গীতার শ্লোক শেখার প্রচেষ্টায় ধারাবাহিকতা রয়েছে আবার কিছ ছাত্রের মধ্যে সেটা নেই। উভয়েই শেখার জন্য উত্তম ভাবে চেষ্টা করেন কিন্তু প্রথম ধরনের ছাত্রেরা খুব সহজভাবেই গীতার শ্লোকগুলি কণ্ঠস্থ করে ফেলেন।
14.1
শ্রীভগবানুবাচ
পরং(ম্) ভূয়ঃ(ফ্) প্রবক্ষ্যামি, জ্ঞানানাং(ঞ) জ্ঞানমুত্তমম্
যজ্জ্ঞাত্বা মুনয়ঃ(স্) সর্বে, পরাং(ম্) সিদ্ধিমিতো গতাঃ॥1॥
একটি কাহিনী বলা যাক।
এক মা তার বাচ্চাকে জোর করে খাওয়াচ্ছিল যদিও শিশুটি কিছুতেই খেতে চাইছিল না। তিনি তার পিছনে তাড়া করছিলেন এবং খাইয়ে যাচ্ছিলেন, যতক্ষণ না সে তার প্রয়োজনীয় পরিমাণের খাবার খাচ্ছিল। এক্ষেত্রে তিনি শিশুটির প্রয়োজন তার থেকেও বেশী অবগত ছিলেন। পরমেশ্বরও জানতেন যে এই জ্ঞানের কথা অর্জুনের বার বার শোনা প্রয়োজন তার নিজের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য। একজনের চাহিদা ও প্রয়োজন সর্বদা সমান হয় না। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিলাসবহুল অট্টালিকায় বাস করতে চাইতে পারেন কিন্তু তার প্রয়োজন কেবলমাত্র একটি ঘর। একইভাবে আমরা কয়েক মিনিটের জন্য ধ্যান করতে চাইতে পারি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধ্যানের কাম্য ফল পেতে গেলে আমাদের আরও দীর্ঘ সময় ধরে তা করা উচিত। গীতার সব অধ্যায়গুলি শেখার পর কেউ মনে করতে পারে সে গীতা সম্বন্ধে জ্ঞানী কিন্তু এই বিশাল এবং পরম জ্ঞানকে গভীরভাবে জানতে গেলে তাকে ধারাবাহিক ভাবে প্রত্যহ শ্লোকগুলির চর্চা করতে হবে এবং তা বুঝতে হবে।
পরমেশ্বর অনেক ধরণের যোগের ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু বিশেষ জোর দিয়েছেন কর্মযোগে যেহেতু মানব জীবন তার কর্মের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। গীতা হল জ্ঞানের সমুদ্র যার মধ্যে ব্যাপক এবং গভীর দর্শন রয়েছে। অনেক সাধুরা যেমন আদি শঙ্করাচার্য্য, রামসুখদাসজী, বল্লভাচার্য্যজী, মধুসূদন সরস্বতীজী এবং আরও অনেকে তাদের ভাষ্য রচনায় তা বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন। এই জ্ঞানী মনিষীরা একেকটি শ্লোক নানা উপায়ে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গান্ধীজী সর্বদা বলতেন তিনি তার সমস্ত সমস্যার সমাধান গীতার মধ্যেই খুঁজে পান ।
জ্ঞান লাভ করা সহজ কিন্তু তার প্রয়োগ কঠিন। একজন গীতার অন্তর্নিহিত জ্ঞান উপলব্ধি করতে পারেন কিন্তু সেই জ্ঞান নিজের জীবনে এবং কর্মে প্রয়োগ করা অত্যন্ত দুরূহ।
শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাসাজ্জ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে ।
ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্ ।।১২.১২।।
দ্বাদশ অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে শ্রী ভগবান ব্যাখ্যা করেছেন অসচেতন হয়ে অভ্যাস করার থেকে জ্ঞান শ্রেয়। জ্ঞানের থেকে তাঁর ধ্যান শ্রেয়তর এবং কর্মফলত্যাগ ধ্যান হতে শ্রেষ্ঠ। তাই জ্ঞান তখনই সত্যিকারের কাজে লাগে যখন কেউ তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করে। যেমন কেউ যদি গীতা থেকে অর্জিত জ্ঞান নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন তাহলে তিনি তার প্রত্যেক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবেন। প্রয়োগ ছাড়া জ্ঞান শব্দ মাত্র এবং অর্থহীন।
ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ ।।১৬.২১।।
ষোড়শ অধ্যায়ের ২১ নং শ্লোকে শ্রী ভগবান বলেছেন কাম, ক্রোধ এবং লোভ হল নরক প্রবেশের তিনটি দরজা। তবুও সবার জীবনেই ক্রোধ এবং অন্যান্য আবেগের অভিজ্ঞতা হয়। আধ্যাত্মিক পথে কাম, ক্রোধ এবং লোভ বর্জন একান্ত আবশ্যকীয়, ধীরে ধীরে অভ্যাস করে তা আয়ত্ত করতে হয়। অতএব যদিও একলপ্তে আয়ত্ত করা কঠিন তবুও আমাদের অধ্যাবসায়ের সাথে গীতালব্ধ জ্ঞানকে জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি ছাড়াও জ্ঞান আমরা বিভিন্ন ভাবে পেয়ে থাকি যেমন অংক, বিজ্ঞান, নৃত্য, কলা, সঙ্গীত ইত্যাদি। পরমেশ্বর ঘোষণা করেন যে ভগবদ্গীতালব্ধ জ্ঞান সব রকম জ্ঞানের থেকে শ্রেষ্ঠ। যখন সন্ধানী ব্যক্তি এই পরম জ্ঞান লাভ করেন তিনি তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের সমস্ত চাপ ও সমস্যাজাত দুঃখ থেকে মুক্ত হন যেহেতু তিনি এই জগতের প্রতি অনাসক্ত থাকেন।
চিরস্থায়ী সুখ হল দুঃখ, আনন্দ এবং পীড়ার ভয় থেকে মুক্ত হওয়া যা অবশেষে আমাদের পরম সুখের দিকে নিয়ে যায়। যে সাধুরা খাদ্য, বাসস্থান, পরিধান এবং অন্যান্য বিষয়বস্তুর প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত তারা এই পরম জ্ঞানের প্রয়োগ সম্বন্ধে জেনেছেন এবং তারা এই ত্যাগের পথ অনুসরন করে শেষ পর্য্ন্ত পরম সিদ্ধি লাভ করেন অর্থাৎ এই জগত থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি ।
এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে ।।৯.২১।।
নবম অধ্যায়ের ২১ নং শ্লোকে তিনি বলেছেন স্বর্গলোক প্রাপ্ত হলেই যে কেউ চিরদিনের জন্য দুঃখ ও পীড়ামুক্ত হবে এমনটা নয়, কারণ তার পুণ্যকর্মের ফল শেষ হয়ে গেলে তাকে আবার এই মরজগতে জন্ম নিতে হবে, কিন্তু এই পরম জ্ঞান দ্বারা মোক্ষ লাভ হয় ও জন্ম মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এই পরম জ্ঞান আমাদের মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় এমনকি পৃথিবী বিনাশকালেও সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ হয়। আসক্তিই হল সব দুঃখ ও পীড়ার কারণ। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ তার বন্ধুবান্ধব, পরিবার এমনকি অনেক সময় শত্রুদের কথাও চিন্তা করে। এই পরম জ্ঞান যে কোন আসক্তি থেকে মুক্তি সহজতর করে এবং মনুষ্য শরীর থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রমণে সাহায্য করে।
ইদং(ঞ) জ্ঞানমুপাশ্রিত্য, মম সাধর্ম্যমাগতাঃ
সর্গেপি নোপজায়ন্তে, প্রলয়ে ন ব্যথন্তি চ॥2॥
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্ ।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্বিপরিবর্ততে ।।৯.১০।।
নবম অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে শ্রী ভগবান নিজেকে প্রকৃতির অধীক্ষক রূপে বর্ণনা করেছেন কিন্তু এখানে তিনি সমস্ত সৃষ্টির পিতাস্বরূপ ( জগত পিতা ) এবং প্রকৃতিকে এই বিশ্বের মাতা বলে ( জগত মাতা ) ঘোষণা করেছেন। প্রকৃতিকে জড় ( প্রানহীন ) বলে গণ্য করা হয় এবং পরমেশ্বরকে চৈতন্য ( জীবন শক্তি ) বলে। প্রকৃতি তাঁর নির্দেশে এই বিশ্বকে সৃষ্টি করে। যেমন একটি বৈদ্যুতিক পাখার সাধারণ ভাবে কাজ করতে হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন, সেই একইভাবে প্রকৃতিও ততক্ষণ নিষ্ক্রিয় থাকে যতক্ষণ না পরমেশ্বর তাতে সঠিকভাবে কাজ করবার জীবনীশক্তি প্রদান করেন ( চৈতন্য )।
মম যোনির্মহদ্ব্রহ্ম , তস্মিন্ গর্ভং(ন্) দধাম্যহম্
সম্ভবঃ(স্) সর্বভূতানাং(ন্), ততো ভবতি ভারত॥3॥
শ্রীভগবান বারংবার বলেন যে যত সৃষ্টির অস্তিত্ব আছে তিনি হলেন তাদের পিতা এবং প্রকৃতি তাদের মাতা। প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে যেমন বলা আছে জীবন্ত সত্তার ৮৪ লক্ষ যোনি ( প্রজাতি ) রয়েছে, তারা যেমন ভাবে জন্ম গ্রহণ করে সেই ভিত্তিতে তাদের চার ভাগে ভাগ করা হয়।
জরায়ুজ : মায়ের গর্ভে যাদের জন্ম যেমন মানুষ, স্তন্যপায়ী প্রানী।
অণ্ডজ : ডিম থেকে যাদের জন্ম যেমন সরীসৃপ, পাখী।
উদ্ভিজ : মাটি থেকে জন্ম যেমন গাছ।
স্বেদজ : ঘাম, মল মূত্র থেকে জন্ম যেমন পতঙ্গ।
এইভাবে সব জীবন্ত সত্তার অস্তিত্ব তিনি প্রকৃতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন।
সর্বযোনিষু কৌন্তেয় , মূর্তয়ঃ(স্) সম্ভবন্তি যাঃ
তাসাং(ম্) ব্রহ্ম মহদ্যোনিঃ(র্), অহং(ম্) বীজপ্রদঃ(ফ্) পিতা॥4॥
পূর্ববর্তী শ্লোক পর্যন্ত তিনি বর্ণনা করেছেন এই বিশ্ব কি ভাবে তৈরি হয়েছে। এই শ্লোকে পরমাত্মা মনের প্রকৃতি, জীবসমূহের প্রত্যেক কর্মের উপায় ও কারণ এবং এই বিশ্বের সর্বত্র যে সকল
ঘটনা ঘটে চলেছে তার কারণ সম্বন্ধে আমাদের আলোকিত করেছেন।
ন তদস্তি পৃথিব্যাং বা দিবি দেবেষু বা পুনঃ ।
সত্ত্বং প্রকৃতিজৈর্মুক্তং যদেভিঃ স্যাত্রিভির্গুণৈঃ ।।১৮.৪০।।
উপরোক্ত শ্লোকের অর্থ হল পৃথ্বীলোক এবং অন্যান্য লোকে বর্তমান প্রতিটি উপাদান তিনটি গুণ দ্বারা সৃষ্ট যথা সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক গুণ যা প্রকৃতির অন্তর্গত। এই গুণগুলি জীবদের কামনা দ্বারা বন্ধন করে। তারা আত্মাকে তাদের কামনা এবং কর্ম দিয়ে আচ্ছাদিত করে। এই জীবাত্মাকে মুক্ত করতে সত্য জ্ঞান অর্জন করা নিতান্ত প্রয়োজন।
তিনটি গুণ হল যথাক্রমে –
সাত্ত্বিক গুণ – এর সাথে ধার্মিকতা জড়িত। এখন একজন কি ভাবে ধার্মিকতা নিরূপণ করবেন। তিনি ষোড়শ অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেছেন।
অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধির্জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ ।
দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্ ।।১৬.১।।
ধার্মিকতার ২৬ টি দৈবী গুণ তিনি ষোড়শ অধ্যায়ে বিশদভাবে বলেছেন যথা নির্ভয় হওয়া, হৃদয়ের পরিশুদ্ধি, অবিচলতা, দান, আত্ম সংযম, শুদ্ধতা, জ্ঞান এবং সম্প্রীতি ইত্যাদি।
রাজসিক গুণ – এই গুণের বৈশিষ্ট্য হল লোকজন, জিনিসপত্র, জ্ঞান এবং আরও অনেক কিছুর সাথে সংযোগের অনুভূতি, কামনা নিবৃত্তির এবং কর্মের পরিনতির আকাঙ্ক্ষা।
তামসিক গুণ - এই গুণের প্রকাশ হয় অশুদ্ধতা, আলস্য, অন্ধকার এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞতা যা জ্ঞান ও বুদ্ধির অভাবকে প্রকট করে।
এই তিনটি গুণই প্রকৃতিজাত। প্রত্যেক জীবের মধ্যেই এই তিনটি গুণ বিভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করে। বর্তমান প্রধান গুণটি একজনের ব্যক্তিত্ব নিরূপণ করে, যেমন অনেকের মধ্যে বর্তমান রাগ, লোভ এবং কাম তার নেতিবাচক দিকটি উন্মুক্ত করে, আবার নির্ভীকতা, সততা, সত্যবাদিতা একজনের ইতিবাচক আবেগগুলির উপস্থিতি বোঝায়। এই গুণগুলি আসক্তির সৃষ্টি করে।
রামায়ণের একটি সুন্দর গল্প এই গুণগুলিকে গভীর ভাবে বোঝার জন্য আলোকপাত করে। একদা রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ এই তিন ভাই প্রভু ব্রহ্মার জন্য কঠোর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন তাতে খুশী হয়ে তিনি আবির্ভূত হলেন এবং তাদের বর চাইতে বললেন। তারা সবাই হুবহু একই বর চাইলেন যা হল “সোনা”।
বিভীষণ ছিলেন সাত্ত্বিক, তিনি চাইলেন “সো…না” অর্থাৎ কোন নিদ্রা নয়, অজ্ঞতা থেকে জাগতে চান তিনি, এখানে নিদ্রা অজ্ঞতা, বিভ্রম এবং কামনাকে ইঙ্গিত করছে। তিনি তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে চাইছেন, ন্যায়পরায়ণতার পথ অনুসরণ করতে চাইছেন, শ্রীরামের ভক্ত হতে চাইছেন এবং নিদ্রার মত অনর্থক বিষয়ের আরাধনা করে জীবন নষ্ট করতে চাইছেন না।
রাবণ ছিলেন রাজসিক, অপরপক্ষে তিনি “সোনা” অর্থাৎ স্বর্ণ চাইলেন যা ক্ষমতা, যশ, বস্তুগত কামনার প্রতীক। তিনি উপদেবতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তিনি বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন, সমস্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান তার আয়ত্ত ছিল কিন্তু সেই জ্ঞান অনুসরন করে একজন উত্তম ব্যক্তি হওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। আজকের আধুনিক সমাজেও, আমাদের অবগত থাকা উচিত যে, একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি সব সময় ভাল নাও থাকতে পারেন, তার ক্ষমতা এবং পদ ব্যবহার করে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন যা তাকে ভুল কর্মের পথে পরিচালিত করতে পারে। বাহ্যিক জ্ঞান লাভ যে যথেষ্ট নয় তিনি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সমস্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান তার ছিল তবুও তিনি শ্রীরামের ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত থেকেও সীতা মাতাকে অপহরণ করেছিলেন কারণ তিনি কামনায় অত্যধিক পরিমাণে আসক্ত ছিলেন। এর ফল হয়েছিল তার সবংশে বিনাশ। অত্যধিক পরিমাণে রাজসিক গুণ মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার দিকে পরিচালিত করতে পারে এবং বিভিন্ন কামনায় মন আসক্ত হয়ে যেতে পারে। একজন ব্যক্তি ক্ষমতা এবং অর্থের আকাঙ্ক্ষা করে তাই তার অপূর্ণ সাধগুলির শৃঙ্খল তাকে দুঃখ ও পীড়ায় নিমজ্জিত করে। রাবণের জ্ঞান ছিল কিন্তু তিনি সেই জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন নি কারণ তার অনেক বেশী বস্তুগত কামনা ছিল। অনেক সময় কারও মিষ্টির প্রতি লালসা থাকতে পারে এবং মিষ্টি খাওয়ার সেই অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছাটাই হল রাজসিক গুণ।
কুম্ভকর্ণ ছিলেন তামসিক, তিনি “সোনা” অর্থাৎ নিদ্রা চাইলেন, এটা এক প্রকার বরটি নষ্ট করা, যেহেতু কেউ ঘুমন্ত অবস্থায় তার আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে না। এটা নিছক অজ্ঞতার ফল। এই ধরণের লোকেরা ভাল কাজ ও মন্দ কাজের তফাৎ করতে পারে না।
যখন এক ব্যক্তি অন্ধকার ঘরে থাকেন তিনি স্বচ্ছ দৃষ্টির ক্ষমতা হারান এবং পড়ে যাওয়ার ভয়ে কোন দিকেই আর এক পা এগোতে পারেন না । এইভাবে অত্যধিক তমগুণের প্রভাবে একজন ব্যক্তির দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে পরে এবং চিন্তাও বিভ্রান্তিকর হয়।
দড়ি দিয়ে যে কোন একটি জিনিস যেমন করে বাঁধা যায় এই তিনটি গুণ তেমন ভাবে আত্মাকে বহির্বিশ্বের সাথে বেঁধে রাখে। এমনকি সাত্ত্বিক ব্যক্তিও একটি স্বর্ণ শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ থাকে আর রাজসিক রৌপ্য এবং তামসিক লৌহ শৃঙ্খল দ্বারা।
সত্ত্বং(ম্) রজস্তম ইতি, গুণাঃ(ফ্) প্রকৃতিসম্ভবাঃ
নিবধ্নন্তি মহাবাহো, দেহে দেহিনমব্যয়ম্॥5॥
আমাদের নিশ্চিতরূপে মনে রাখা উচিত সুখ হল দুঃখের বিপরীত কিন্তু স্বর্গীয় সুখ বা আনন্দের কোন বিপরীত হয় না, তা অপার্থিব। শ্রী ভগবান জোর দিয়ে বলেছেন যদি কেউ বহিঃস্থ উৎসের কাছে সুখের সন্ধান করে তাহলে তার আসক্তি জন্মায় যার দ্বারা সে এই মায়ার জগতে আবদ্ধ হয়।
সুখের দুইটি রূপ হয়।
- সুখ - কেউ বহিঃস্থ উৎসের কাছে সুখের সন্ধান করে এবং আসক্তি গঠন দ্বারা এই মায়ার জগতে আবদ্ধ হয় যেমনটি শ্রী ভগবান জোর দিয়ে বলেছেন। আমরা এটাও জানি দুঃখের বিপরীত হল সুখ, এইরকম পার্থিব কামনা থেকে কেউ সহজে পরিত্রাণ পায় না।
- আনন্দ – এটা পরম সুখের অনুভূতি যা কখনও কারও মন থেকে সরানো যায় না যেহেতু এটা ঐশ্বরিক আসক্তি দ্বারা লব্ধ হয়। একে পরমানন্দও বলা হয়, যা অবিনাশী এবং যা জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে।
উপনিষদের একটা গল্প বলা যাক।
শ্বেতকেতু নামে এক ছাত্র গুরুকুল থেকে বিদ্যা লাভের পর অত্যন্ত অহংকারী হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরে এলে সে তার পিতার সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারল একমাত্র ব্রহ্মবিদ্যার প্রশ্নে নীরব থাকল।
তাই জ্ঞানের সাধনা করা ভাল কিন্তু প্রশংসা প্রাপ্তির জন্য যদি সে অধীত বিদ্যায় আসক্ত হয়ে পরে তাহলে সেই আসক্তি আত্মাকে এই বস্তু জগতের সাথে বেঁধে ফেলবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সাত্ত্বিক গুণেরও আসক্তি পরিত্যাগ করা কারণ এটাও বস্তু জগতের সাথে আমাদের বন্ধন করে।
অনেকে রোজ তিলক কাটলে, তুলসির মালা পরলে, মন্দিরে গেলে, নানা আচার এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান করলে তা নিয়ে গর্ব করে, যা কিন্তু তার বিনম্রতার পরিচয় নয় যেহেতু তা ভণিতা মাত্র। এটা এই জগতের সাথে তাদের আসক্তিকেই প্রদর্শন করে।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সাত্ত্বিক গুণেও আসক্তি পরিত্যাগ করা তাহলে আমরা ত্রিগুনাতীত (যিনি তিনটি গুণেরই আসক্তি ত্যাগ করতে পেরেছেন) হতে পারব।
তত্র সত্ত্বং(ন্) নির্মলত্বাৎ , প্রকাশকমনাময়ম্
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি, জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ॥6॥
এখানে তৃষ্ণা বলতে অশেষ তৃষ্ণাকে বোঝানো হয়েছে আর সঙ্গ কথাটির অর্থ হল আসক্তি। অতিরিক্ত কামনা বিভ্রমের সৃষ্টি করে। কিন্তু রজোগুণ মন্দ নয় কারণ কিছু আসক্তি প্রেরণামূলক ।
একটি দশম শ্রেণীর ছাত্রের উদাহরণ নেওয়া যাক যে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করতে চায়, সে পদার্থ বিদ্যা নিয়েই পড়াশোনা শুরু করবে। যদি তার আগ্রহ তৈরি হয়, তাহলে সে এই বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করবে এবং অবশেষে সে একজন প্রফেসর বা পদার্থ বিজ্ঞানী হবে। এতে তার একটি আসক্তি জন্মাবে যা তাকে জনপ্রিয় করতে পারে এবং প্রশংসা পাওয়ার জন্য প্রেরণা দিতে পারে।
গীতা ক্লাসে যদি প্রশিক্ষক কোন সাধককে অডিও পাঠানোর জন্য প্রশংসা করে তাহলে একটা আসক্তি জন্মায় এবং সাধকটি প্রশিক্ষকের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আরও সুর ও সঙ্গীত যোগ করে আবৃত্তি করতে থাকে। অপরপক্ষে যদি প্রশিক্ষক তারিফ না করেন তাহলে সাধক ভগ্নহৃদয় হন এবং ক্লাস করা বন্ধ করে দেন এবং এইভাবে তিনি গীতা শেখার যাত্রায় ইতি টানেন। এইভাবে কোন কর্মে আসক্তি কখনও কখনও প্রেরণারূপেও কাজ করে।
যাইহোক, এটা ভেবেচিন্তে করতে হবে এবং এটাই যেন কর্মের একমাত্র কারণ না হয়। আসক্তি ততক্ষণই থাকুক যতক্ষণ তা প্রেরণার উৎস হয়, এটা এত তীব্র হওয়া উচিত নয় যে বাধা সৃষ্টি করে। যাই হোক, সাবধান হতে হবে যেহেতু এটা একটি পিচ্ছিল ঢাল যেখানে লক্ষ্যের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি আত্মাকে সংসারের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারে।
রজো রাগাত্মকং(ম্) বিদ্ধি , তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় , কর্মসঙ্গেন দেহিনম্॥7॥
তমগুণ অজ্ঞতার সূচক। সাধারণ মানুষকে তাদের ইচ্ছার বিষয়ে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা দ্বারা তাদের অন্তর্নিহিত প্রধান গুণটির ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যায়। যদি কেউ বলেন –
- তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতে চান – সত্ত্বগুণ প্রধান
- তিনি কর্মব্যস্ত থাকতে চান ( খেলাধুলা, হাঁটা ইত্যাদি) – রজগুণ প্রধান
- তিনি কেবলমাত্র খেতে আর ঘুমাতে চান – তমগুণ প্রধান
তমস হল সম্পূর্ণ অজ্ঞতা এবং বিভ্রম, যেমন একটি প্রজ্জ্বলিত বাতি মোটা কম্বলে ঢেকে রাখলে তা অন্ধকার পথকে আলোকিত করতে পারে না, তেমনই তমগুণ জ্ঞান, বুদ্ধি, সুখ এবং সব ইতিবাচক অনুভূতিগুলিকে বিভ্রমের কম্বলে আচ্ছাদিত করে রাখে।
প্রমাদ শব্দটির অর্থ হল তোমার যা কর্তব্য তা না করা অথবা কিছু করা যা সঠিক নয়। যেমন পরিবারের সকলের জন্য যদি কারও রান্না করার কথা থাকে এবং সে সেই ক্ষুধার্ত পরিবারের জন্য তখন রান্না না করে অথবা শীতের রাতে খাবারের আগেই কেউ আইসক্রিম খায় ইত্যাদি।
আলস্য শব্দটির অর্থ হল অলসতা। সঠিক সময়ে কর্ম না করা বা ভবিষ্যতের জন্য তা ফেলে রাখাকে অলসতা বলে। উদাহরণস্বরূপ কিছু ছাত্র ঘুম চোখে ক্লাসে আসে এবং পুরো সময়টা হাই তুলতে থাকে, কয়েক মিনিট পরে চলেও যায়। খেলাধুলাতেও এই ছাত্রেরা অংশগ্রহন করে না এবং নিষ্ক্রিয় থাকে।
কিছু লোকের অভ্যাস আছে কাজ না করে ফেলে রাখা এমনও লোক আছে যাকে ফোন নম্বর দিতে বললে সে বলে পরের দিন দেবে, এইভাবে একটা সরল কাজ যা তক্ষুনি করা যায় তাও তারা ফেলে রাখে। এরা এমন যে চশমা পরিষ্কার করার কষ্টটুকুও করতে চায় না, এরা সারাক্ষণ শুধু বসে থাকে আর দূরদর্শন অবলোকন করে । যখন মা খেতে ডাকে তখন তারা রান্নাঘরে খেতেও যায় না বরঞ্চ মাকেই খাবার নিয়ে যেতে হয় তাদের কাছে কারণ তারা গেম খেলায় ব্যস্ত।
প্রত্যেকটি ব্যক্তির মধ্যেই এই তিনটি গুণের কিছু অংশ থাকে, কিন্তু সেই ব্যক্তি নিজেকে একটি গুণ থেকে অপর গুণে উন্নীত করতে পারে যেমন রাজসিক থেকে সাত্ত্বিক অথবা নিজেকে তামসিক গুণে পতিতও করতে পারে। যে গুণটি একটি ব্যক্তির মধ্যে বেশী পরিমাণে থাকবে তাই তার প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। এই গুণই তার মনকে প্রভাবিত করে তার কর্ম করাবে। যদি সত্ত্বগুণ বেশী থাকে তা মানুষকে সাত্ত্বিক হিসাবে পরিচিত করে। কারও ভাবনা চিন্তা তার কর্ম দ্বারা প্রতিফলিত হয় যা পর্যায়ক্রমে ঐ তিনটি গুণের প্রভাব দ্বারাই ঘটে।
সত্রটি হরি কীর্তন ও প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে সমাপ্ত হল।