विवेचन सारांश
পরমেশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে এবং আনন্দপূর্ণ জীবন প্রাপ্তির শক্তি যোগায়
পূর্ববর্তী সত্রে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। ঈশ্বর হলেন সর্বব্যাপী এবং তিনি গভীরভাবে আমাদের সাথে সংযুক্ত রয়েছেন এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য। যখন আমরা বলি “কলমটি বইয়ের ভেতরে আছে” বা “বাড়িটি মাটির তৈরি” তখন আমরা এই অর্থটাই বোঝাই যে কলম এবং বাড়ি যথাক্রমে বই এবং মাটির থেকে আলাদা। যাই হোক, যখন আমরা বলি কলম আর বই একই বা বাড়িও যা মাটিও তা, তখন পরোক্ষভাবে এই উপাদান গুলির প্রতিটির সমতা এবং ঐক্যের উল্লেখ করি। তেমনই পরমাত্মা বলেন তিনি শুধু মাত্র এই বিশ্বজগতের অংশ বিশেষ নন, প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেই এই বিশ্বজগত বা এই সংসার!
পরবর্তী শ্লোক গুলিতে আরও একবার বিশদভাবে বলা হয়েছে যে কেমন করে তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।
9.17
পিতাহমস্য জগতো, মাতা ধাতা পিতামহঃ
বেদ্যং(ম্) পবিত্রমোঙ্কার, ঋক্ সাম যজুরেব চ।।17।।
এই শ্লোকে পরমেশ্বর বলছেন যে তিনিই এই বিশ্বের সৃষ্টির একান্ত কারণ, তার ধারন ক্ষমতায় তিনি এই বিশ্বের পিতা, মাতা এবং পিতামহও তিনিই। আগে এই অধ্যায়ের দশম শ্লোকে তিনি ঘোষণা করেছেন –
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকতিঃ সূয়তে সচরাচরং ।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগদ্বিপরিবর্ততে ।। ৯.১০ ।।
(আমার পরিচালনাতে কাজ করে এই প্রকৃতি বা বস্তু শক্তি সমস্ত রূপ জড় এবং জীব সৃষ্টি করে । হে কৌন্তেয়, এই কারণের জন্যই এই বস্তু জগতে সর্বদা পরিবর্তন হতে থাকে।)
তিনিই এই অবিরাম সৃষ্টি, পালন এবং লয়ের চক্র প্রবর্তন করেন। অন্য কোন সত্তা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন এই ধারণা নির্মূল করতে শ্রী ভগবান বলেছেন তিনি একদিকে যেমন পিতা এবং মাতা তেমন পিতামহও তিনিই। এক কথায় তিনি স্বয়ম্ভূ, এক এবং একমাত্র সত্য বা অস্তিত্ব, একমাত্র উপযুক্ত জ্ঞেয়। তিনিই হলেন সংশোধক যিনি অন্যদের সংশোধন করেন, তিনিই পবিত্র ওঁ অক্ষর, প্রণব। বেদে যা কিছু আছে তাঁকেই মূর্ত করে।
বেদের মধ্যে সমগ্র জ্ঞানের সংগ্রহ রয়েছে। মুলতঃ একটিই বেদ ছিল, ব্যাসদেব পরে বিষয় বস্তু অনুযায়ী একে চারটি বেদে বিভক্ত করেন। এই চারটি বেদ হল–
- ঋক বেদ
- সাম বেদ
- যজুঃ বেদ
- অথর্ব বেদ
অন্য কিছু দর্শন মতে অথর্ব বেদকে প্রথম তিনটি বেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সুতরাং ঈশ্বরের সাথে গভীর সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের কঠোরভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত যেহেতু তিনিই একমাত্র উপযুক্ত জ্ঞেয়।
গতির্ভর্তা প্রভুঃ(স্) সাক্ষী, নিবাসঃ(শ্) শরণং(ম্) সুহৃৎ
প্রভবঃ(ফ্) প্রলয়ঃ(স্) স্থানং(ন্), নিধানং(ম্) বীজমব্যয়ম্।।18।।
একই ভাব বজায় রেখে পরমাত্মা ঘোষণা করেন যে তিনিই হলেন পরম লক্ষ্য বা পরম গতি এবং সেইজন্য প্রত্যেকের উচিত তাঁর নিকট আসা। আমাদের আদর্শ লক্ষ্য স্থির করব তাঁর শাশ্বত স্বরূপ জানার জন্য যা হল পরম জ্ঞান। তিনি হলেন ভর্তা যেহেতু এই জগতকে তিনি ভরণপোষণ করেন। যেহেতু তিনি অসীম শক্তিধর, আমাদের সঙ্কটের সময় নশ্বর মানুষের রুদ্ধ ক্ষমতার উপর নির্ভর না করে তাঁর কাছেই যাওয়া উচিত।
শ্রী ভগবান আমাদের সমস্ত কর্মের, চিন্তার এবং অভিপ্রায়েরও নীরব সাক্ষী। প্রায়শঃ আমরা সুকর্ম করি এটা কল্পনা করে যে কত জন আমাদের এই প্রয়াস দেখতে পেলেন বা অনেক সময় আমরা যখন মানবিকতার মৌলিক নীতি গুলিকে লঙ্ঘন করি তখন আমরা এই ভেবে আত্মসন্তুষ্ট হই যে কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে না। এই রকম সময়ে আমাদের মনে রাখা উচিত যে তিনি আমাদের ওপর নজর রাখছেন এবং আমাদের পাপকর্ম এবং পুণ্যকর্মের হিসাবও রাখছেন।
সাধারণ মানুষ যেখানে আমাদের ভাল বা মন্দ কাজের কেবলমাত্র বিচার করতে পারে, একমাত্র পরমেশ্বরের মধ্যেই ক্ষমতা রয়েছে আমাদের সেই কর্মের ফল প্রদান করার।
প্রভব বা উৎস, প্রলয় বা বিলীন ও অবসান এবং নিধানম্ বা সৃষ্টি সমূহের স্থিতি স্থল এ সবই তাঁর সমুজ্জ্বল আত্মপ্রকৃতির অংশ বিশেষ। সর্বশেষভাবে, অন্তিম লয়ের সময় এই জগত ও আমাদের কর্ম সকল তাঁর সাথে সম্মিলিত হয়ে যাবে এবং ওই সকল কর্মের ভিত্তিতে আমাদের নতুন জন্ম প্রাপ্তি হবে এবং এক নতুন স্থাপনা হবে যখন এই বিশ্বের পুনরুত্থানের সময় হবে।
তিনিই সমস্ত সৃষ্টির অবিনাশী বীজ, যখন পুনরুত্থান ও লয়ের এই অবিরাম চক্রে অবশিষ্ট জগতের সব কিছুই শেষ হয়ে যায় তিনি চিরন্তন থাকেন।
প্রকৃতপক্ষে এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক চিন্তা যে যা কিছুই হোক এই পৃথিবী থাকুক বা না থাকুক তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডে নিয়ত অবস্থান করেন।
তিনি আগেও ছিলেন, তিনি বর্তমানে আছেন এবং তিনি আগামীকালও একইভাবে থাকবেন।
তপাম্যহমহং(ব্ঁ) বর্ষং(ন্), নিগৃহ্ণাম্যুৎসৃজামি চ।
অমৃতং(ঞ্) চৈব মৃত্যুশ্চ, সদসচ্চাহমর্জুন॥9.19॥
প্রকৃতি প্রদত্ত আমাদের সবকিছুই প্রকৃতপক্ষে তাঁরই স্বর্গীয় দীপ্তির প্রকাশ। পরমেশ্বর হলেন সূর্যের বিকিরিত উত্তাপ আবার তিনিই হলেন বৃষ্টির বর্ষণ। যা কিছু ভাল বা মন্দ এবং অশুভ প্রতিটি তিনি তাঁর কাঁধে বহন করেন। পরমাত্মা হলেন অমরত্ব এবং মৃত্যু দুইয়েরই ব্যক্তিরূপ।
ত্রৈবিদ্যা মাং(ম্) সোমপাঃ(ফ্) পূতপাপা,
যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং(ম্) প্রার্থয়ন্তে
তে পুণ্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকম্,
অশ্নন্তি দিব্যান্দিবি দেবভোগান্।।20।
স্বর্গ কি ? কে তার নিয়ন্ত্রণ করে ? কেমনভাবে কেউ এই স্বর্গ রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে ? আমাদের কাছে কি কি উপায় আছে এর জন্য ? আমরা যখন একবার ইন্দ্রলোকে পৌঁছাব তখন আমাদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হবে ?
এই শ্লোকটি স্বর্গলোকের বিষয়ে আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে। এটি আমাদের এটাও বোঝায় যে স্বর্গলোক প্রাপ্তি করাটাই আমাদের জীবনের চূড়ান্ত এবং প্রধান লক্ষ্য নয়।
গরুড় পুরাণের মত কিছু লিপি আছে যা স্বর্গ এবং নরকের বর্ণনা দেয়।
যারা তাদের কর্মফল লাভের কামনা করেন তারা যথাবিহিত আচার অনুষ্ঠান দ্বারা তাঁকে তৃপ্ত করতে যজ্ঞ সম্পাদন করেন । সফল ভাবে যজ্ঞ সমাধা হলে তারা সোমরস পান করেন যা সোমলতার নির্যাস মাত্র, একে মদ ভেবে আমরা যেন ভুল না করি।
সুরেন্দ্রলোক অর্থাৎ স্বর্গধাম যা দেবরাজ ইন্দ্রের রাজত্ব, সেই ধামে গমন করে যজ্ঞকারী বিশেষভাবে দেবতাদের ভোগ্য সব আনন্দের উপকরন উপভোগ করেন যেমনটি শ্লোকে বলা হয়েছে “অশ্নন্তি দিব্যানদিবি দেবভোগান”।
যখন আমরা এই নশ্বর ভূলোকে অবস্থান করছি, আমরা যত স্বর্গলোকের আনন্দের আকাঙ্খায় নিমজ্জিত হব তা আমাদের এই ভঙ্গুর শারীরিক সীমাবদ্ধতার দ্বারা বিঘ্নিত হবে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক যেমন একাদশীর উপবাস পালন কালে যতদূর সম্ভব আমরা আমাদের অন্ন গ্রহনের আকাঙখাকে আটকে রাখতে বাধ্য হই যাতে সংযম কালে খাওয়ার জন্য আমরা লালায়িত না হই। একইভাবে সারাদিন ধরে আমরা টিভি দেখব না যেহেতু আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
স্বর্গলোকে আমরা সূক্ষ শরীর প্রাপ্ত হই যাতে পার্থিব কোন অবরোধের বন্ধন থাকে না । তাই এই রাজ্যে আমরা অপার আনন্দ উপভোগ করতে পারি যেহেতু শারীরিক ক্লান্তি বা অন্তরায় আমাদের বাধা দিতে পারে না। যাই হোক এই স্বর্গসুখ লাভ আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না তার কারণ পরের শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষত পরমেশ্বরকে জানা এবং তাঁর সাথে একাত্ম হওয়াই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য।
তে তং(ম্) ভুক্ ত্বা স্বর্গলোকং(ব্ঁ) বিশালং(ঙ্),
ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং(ব্ঁ) বিশন্তি।
এবং(ন্) ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না,
গতাগতং(ঙ্) কামকামা লভন্তে॥9.21॥
অষ্টম অধ্যায়ে পরমেশ্বর বলেছেন -
আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন ।
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ।।৮.১৬।।
( এই সমস্ত বস্তুজগত এবং সর্বোপরি ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সবই পুনর্জন্মের অধীন কিন্তু পরমেশ্বরের নিবাস প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না )
ব্রহ্মলোকে মোক্ষলাভের একটি সম্ভাবনা রয়েছে যদিও মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। স্বর্গলোকেও নানা প্রতিবন্ধকতার বাধা রয়েছে যেহেতু সেখানে কেউ তার সুকর্ম বৃদ্ধি করতে পারে না বা কেউ ব্রহ্মবিদ্যার জ্ঞান লাভ করতে পারে না, ভগবদ্গীতা এইরূপ ব্রহ্মবিদ্যার উদাহরণ। পুণ্যলাভ এবং ব্রহ্মবিদ্যার অপরিহার্য জ্ঞানলাভ একমাত্র এই মর্তলোকেই সম্ভবপর।
এই ব্যাপারে মনুষ্য দেহ স্বর্গীয় দেহের থেকে এগিয়ে থাকে। মনুষ্য দেহের মধ্যে আবদ্ধ আত্মার অনেক ভাল সুযোগ থাকে পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়ার এবং তাঁর পরম ধাম প্রাপ্তির।
তথাপি ব্রহ্মলোক, স্বর্গলোক, মৃত্যুলোক এদের প্রত্যেকটিতে আমরা পরিবর্তনের যন্ত্রণা এবং অনিত্যতা ভোগ করি, যা সময়ের কাঠামোয় নির্দিষ্ট করা থাকে যেখানে আমদের সুকর্মের ফল ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে।
পরিস্থিতিটা হোটেলে রাত্রিবাস করার মত, ততক্ষণই আমরা সেখানে থাকতে পারব যতক্ষণের জন্য আমরা তার দাম দিতে পারব। একবার টাকা শেষ হয়ে গেলে অতিরিক্ত একদিনও আমরা হোটেলে থাকতে পারব না। একইভাবে আমাদের পুণ্য সঞ্চয় একবার শেষ হয়ে গেলে আমাদেরকে স্বর্গলোক ছেড়ে দিতে হয়।
আমাদের অশেষ কামনা আমাদের বাধ্য করে জন্ম এবং মৃত্যুর এই পৌনঃপুনিক চক্রে বারবার এই মৃত্যুলোকে ফিরে আসতে এবং পুণ্যকর্ম সঞ্চয় করতে যাতে আমরা আবার স্বর্গলোক প্রাপ্ত হই তা সাময়িকই হোক না কেন। স্বর্গলোকের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির জন্য এটি লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটি তুচ্ছ লক্ষ্যে পরিণত হয়ে ওঠে।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং(য়্ঁ), য়ে জনাঃ(ফ্) পর্যুপাসতে।
তেষাং(ন্) নিত্যাভিয়ুক্তানাং(য়্ঁ), য়োগক্ষেমং(ব্ঁ) বহাম্যহম্॥9.22॥
আমাদের বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক জীবনে সাফল্য পেতে হলে নীচের তিনটি মূল শব্দে মনোযোগ দিতে হবে।
অনন্যা : শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রতি একাগ্রভাবে সচেতনতা,যাকে আমরা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের আত্মায় পরিণত করতে পারি আমাদের প্রয়োজন ও সঙ্কটের সময়। একজন ছাত্র যে পরীক্ষায় ভাল ফল করতে চায় সে বাইরের কোন ঘটনা দ্বারা যেমন তার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে বিক্ষিপ্তচিত্ত হবে না। সে তার পড়াশোনায় ডুবে থাকবে এবং তার উচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবে।
চিন্তয়ন্তো ঃ পরমাত্মাকে ঘিরে সচেতনভাবে চিন্তাগুলিকে আবর্তন করার একটি প্রচেষ্ট । পার্থিব সব মানসিক বিভ্রান্তিতে তাঁকে মনে রাখাই হল “চিন্তয়ন্তো” শব্দটির তাৎপর্য। গীতা পরিবারের
ভক্তরা একে অন্যকে “জয় শ্রী কৃষ্ণ” বলে নমস্কার করেন । অন্য কেউ কেউ “হরি ওঁ” বলেন। এই সব পবিত্র শব্দগুলি বারবার বলার অর্থ হল সর্বদা তাঁর প্রতি সচেতন থাকার লক্ষ্যের কথা আমাদের মনে করানো।
আমাদের গীতা পরিবারের উদাহরণ নেওয়া যাক, যেখানে শুদ্ধ উচ্চারণে ভগবদ্গীতা পাঠ শেখানোর জন্য চারটি স্তরে ক্লাস নেওয়া হয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকেন সমস্ত স্তর বিশেষভাবে রপ্ত করে গীতাব্রতী হতে। আরও অনেকে আছেন যারা এদের অনুসরন করতে প্রলুব্ধ হন এবং কাল্পনিক ভাবে পার্থিব সাধনায় আকৃষ্ট হন এবং তাদের এই আধ্যাত্মিক যাত্রা থেমে যায়। আমাদের লক্ষ্য হল প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা পরমেশ্বরকে স্মরণ করব যা আমরা সর্বদা মনে রাখব।
নিত্যাভিয়ুক্তানাম্ ঃ শ্রী ভগবানের প্রতি ভক্তি এবং তার সাথে সংযোগ রাখার ধারাবাহিকতা। আমাদের কার্যসমূহ যেন সেই দিক ভিত্তিক হয় যাতে আমরা শ্রী ভগবানের আরও সন্নিকটে আসতে পারি। তাঁর সাথে একাত্ম হতে আমরা যেন আমাদের মধ্যে ধারাবাহিকতার বোধকে অন্তরে প্রবিষ্ট করাই এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই। আমরা যেভাবে নিবেদিত প্রাণ হয়ে ধারাবাহিকতার সাথে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভক্তি তাঁকে অর্পণ করতে পারব, প্রতিদানে পরমাত্মা তেমনই তাঁর প্রেম ও অনুগ্রহ আমাদের ওপর বর্ষণ করবেন।
শ্লোকটিতে আরও দুটি কথা আছে : যোগ এবং ক্ষেমম্। পরমেশ্বর সর্বদা তাঁর ভক্তদের যা কিছু প্রয়োজন তা প্রদান করেন।
যোগ কি ? একজন একটি আই ফোন পেতে চাইলেন এবং তিনি তা পেলেন এটা যোগের উদাহরণ। এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হল ক্ষেমমের উদাহরণ ।
আমরা যদি অনন্যা, চিন্তয়ন্তো এবং নিত্যাভিয়ুক্তানামের অভ্যাস নিবেদিত হয়ে এবং যথাযথ অধ্যাবসায়ের সাথে অনুসরণ করি তাহলে পরমাত্মা শুধু আমাদের প্রাপ্ত জিনিসগুলিই নয় আমাদের সর্বথা মঙ্গলও সংরক্ষিত করেন।
সেই সব ভক্তরা যারা সম্পূর্ণভাবে পরমেশ্বরের চিন্তাতেই ডুবে থাকেন তাদের কোন উদ্বেগ থাকে না কারণ তিনি তাদের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার অভাব মিটিয়ে দেন এবং তাদের যা আছে তা সুরক্ষিত রাখেন।
যেপ্যন্যদেবতা ভক্তা, যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ
তেপি মামেব কৌন্তেয়, যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।।23।।
একমাত্র তাঁরই দৈবী এক্তিয়ার আছে আমাদের মনস্কামনা পূরণের অথবা তা আটক রাখা।
একটি সরকার মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত হয় যাদের হাতে বিভিন্ন দফতর থাকে। মন্ত্রীদের মাথার ওপর প্রধানমন্ত্রী থাকেন যার হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতার ভাণ্ডার থাকে এবং সেখান থেকে তিনি কিছু কিছু ক্ষমতা নীচের মন্ত্রীদের দফতর অনুযায়ী দিয়ে থাকেন । আমরা আমাদের কাজ করানোর জন্য অসংখ্যবার বিভিন্ন সরকারি অফিসে যাতায়াত করি। বিভিন্ন মন্ত্রীদের দরজায় দরজায় ঘুরে সময় নষ্ট না করে আমরা যদি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারতাম তাহলে আমরা অনেক সময় ও প্রয়াস বাঁচাতে পারতাম। একইভাবে আমরা আমাদের দৈনন্দিন মুদিখানা বা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছোট ছোট বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে কিনি যেখানে সুপার মার্কেটে গেলে আমরা অনেক সহজ ভাবে এবং সুবিধা মত সব জিনিসগুলো একবারে কিনতে পারি।
অনেকে আছেন যারা নিজের ইচ্ছামত সপ্তাহের কোন একদিন উপবাস করেন। যারা বুদ্ধি বা মেধা বৃদ্ধি করতে চান তারা বুধবার উপোস করেন। যারা বিবাহে আগ্রহী তারা সোমবার উপোস করেন। পরিশেষে তিনিই আমাদের ইচ্ছা মঞ্জুর করেন যেহেতু অন্য দেবতাদের প্রদান করা শক্তি হল সীমিত।
অতএব একমাত্র পরমাত্মা-কেন্দ্রিক আত্মনিবেদনই হল আদর্শ অভ্যাস আর অন্যান্য উপদেবতাদের পূজনকে বলা হয় “অবিধিপূর্বকম্” অর্থাৎ ভ্রান্ত হয়ে পূজা করা।
অহং(ম্) হি সর্বযজ্ঞানাং(ম্), ভোক্তা চ প্রভুরেব চ
ন তু মামভিজানন্তি, তত্ত্বেনাতশ্চ্যবন্তি তে।।24।।
কোন সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি হয়ত এই পৃথিবীর সমস্ত বিষয়বস্তু অধিগত করে অত্যন্ত ধনী কিন্তু যদি তার জিহ্বা না থাকে তাহলে সে কোন সুস্বাদু খাদ্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না তখন তার ওই ধন সম্পত্তি কি কাজে লাগবে। একটি মনুষ্য শরীর যা পার্থিব আনন্দ ভোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা ঈশ্বরের উপহার। এই শরীর কি আমরা কিনে আনতে পারি ?
আধ্যত্মিক পথে শেষ পর্যন্ত এটাই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যে আমরা কত গভীরভাবে তাঁর সাথে সংযুক্ত আছি যিনি আমাদের প্রাণ দিয়েছেন, আমাদের ভর্তা, আমাদের পালন কর্তা।
আমাদের পূর্বের কর্ম সকল চূড়ান্ত পরিণতি পায় আমাদের বর্তমান জীবনে কর্মফল হিসাবে। যাই হোক আমরা ভবিষ্যতে কি পাব তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাঁর দৈবী ইচ্ছার ওপর। যেহেতু তিনি হলেন নিয়ন্ত্রক, প্রতিটি ঘটনার পিছনে শক্তি, প্রতিটি ক্রিয়া, তাই আমরা যেন আমাদের গৌরব গাঁথা নিয়ে উৎসব না করি এবং গর্ব না করি যেমন রাবণ এবং কংস করেছিল।
ষোড়শ অধ্যায়ে অসার অহংকার এবং ভ্রান্ত অহংবোধের মত আসুরিক গুণের কথা বলা হয়েছে।
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি ।
ঈশ্বরোহহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্ সুখী ।।১৬.১৪।।
( আমি বিনাশকারী, আমি ভগবান, আমি ভোক্তা, আমি শক্তিমান ) এইরূপ নিজেকে অসীম শক্তিশালী মনে করারা বাতিকগ্রস্ত চিন্তাধারার জন্যই রাবণ এবং কংসের মত বড় রাজাদের পতন হয়েছিল।
পরমাত্মা বার বার বলেছেন যারা তাকে চিনতে পারে না বা তাঁর দৈবী গুণগুলি স্বীকার করে না তারা বার বার জন্ম ও মৃত্যুর সাজা ভোগ করতে থাকে।
প্রশ্ন ওঠে কেন পরমেশ্বর অনন্য ভক্তির গুরুত্বের ওপর এত জোর দিয়েছেন ?
তিনি হলেন মায়ের মত যিনি জেনেশুনে কোন বিষবৃক্ষের কাছে তার সন্তানকে যেতে দেবেন না। এই অলীক বস্তুজগতের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ার বিপদ এবং সংশ্লিষ্ট ভোগান্তির সম্বন্ধে তিনি ভালভাবেই অবগত রয়েছেন। তিনি চান না তাঁর ভক্তদের জীবন এই বেদনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হোক।
কোন এক লেখক ঈশ্বরকে “ঈর্ষান্বিত প্রেমিক” বলে বর্ণনা করেছেন। যাই হোক আমাদের প্রতি তাঁর প্রেম হল বিশুদ্ধ এবং সর্বব্যাপ্ত যার তুলনা মানুষের পারস্পারিক সংকীর্ণমনা প্রেমের সাথে করা যায় না। তিনি কেবল আমাদের সুখের জন্য যত্নবান হন এবং কখনই আমাদের দুর্দশা চান না। তাই তিনি বলেন তিনি একদিকে ভোক্তা আবার অন্যদিকে প্রভুও তিনি। তাঁর সাথে আমাদের গভীর বন্ধন এটা নিশ্চিত করবে যে জীবনে যে কোন অপরিহার্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করার শক্তি আমরা তাঁর কাছ থেকে পাব।
ঈশ্বর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন,
শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ
জীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতি অনিবার্য । কিন্তু তিনি নিশ্চিত করেন যে আমরা যেন জীবন সংগ্রাম পার করতে শক্তি পাই। আমরা জানিনা পর জীবনে আমরা কি ধরণের জন্ম পাব বা আমাদের কৃত কর্ম আমাদেরকে কোন দিকে নিয়ে যাবে । আমরা যদি তাঁর সাথে শক্তভাবে গাঁটছড়া বাঁধতে পারি তাহলে এইসব অনিশ্চিত মুহূর্ত গুলি অতি সহজেই পার হয়ে যেতে পারব। এই সংসারে কিছুই চিরস্থায়ী নয় বা এর কোন সার নেই সুতরাং আমরা যেন তাঁর প্রতি নিবদ্ধ থাকি।
দুই জন সহপাঠীর উদাহরণ নেওয়া যাক, যারা একইরকম ভাবে পীড়াগ্রস্ত। কিন্তু একজন হাসিমুখে রয়েছে আর একজনের দুঃসহনীয় অবস্থা। যে হাসিমুখে রয়েছে সে ঈশ্বরের সাথে সংযোগের জন্য অন্তরে সেই শক্তি পেয়েছে যা দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে দুঃখজনক ভাবে অনুপস্থিত।
যারা পরমাত্মার সাথে গভীরভাবে যুক্ত তারা অন্যদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন এবং তাঁর সাথে তাদের বন্ধন মজবুত করতে পারেন। আমাদের পুজ্য স্বামীজি এর আদর্শ উদাহরণ যিনি গীতা পরিবার স্থাপনা করে বহু মানুষকে গীতা অভিমুখী করার পথ দেখিয়েছেন। আমরাও যেন স্বামীজির অনুপ্রেরনায় আমাদের এই জ্ঞান অন্যের উপকারে লাগাতে পারি।
যান্তি দেবব্রতা দেবান্, পিতৃ়ন্যান্তি পিতৃব্রতাঃ
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা, যান্তি মদ্যাজিনোপি মাম্।।25।।
যে দেবতা বা সত্তাকে আমরা পূজা করি তা দেবতা, পৃিতৃপুরুষ বা অপদেবতা হোক তাদের দিকেই আমরা অগ্রসর হই। কিন্তু যারা শ্রী ভগবানকে পূজা করেন তারা নিশ্চিতরূপে তাঁকে পাবেন এবং তাঁর আশ্রয়ে অবশেষে পুনর্জন্ম ও মৃত্যুর এই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্তি পাবেন।
অতঃপর যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হল আমাদের চিন্তা আমদের আচরণের রূপ দেয় এবং তা বাস্তব কর্ম দ্বারা প্রকাশ পায়। যদি আমাদের চিন্তা সর্বদা ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাহলে আপাতদৃষ্টিতে আমরা তাঁর নিবাসে যাব। এই জন্যই ইতিবাচক চিন্তার ক্ষমতার ওপর এত জোর দেওয়া হয়েছে।
আমাদের মন চিন্তা দ্বারা নিয়ত জটিল অবস্থায় থাকে যা আমাদের বিচার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে এবং পরমাত্মা ও আমাদের মধ্যে বাধা হিসাবে কাজ করে। যেমন কাপড়ের সুতোর রঙ সম্পূর্ণভাবে ধুয়ে ফেলা যায় না তেমনি আমাদের চিন্তা, যতই আমরা নিয়ন্ত্রণ করি, মনের কাঠমো থেকে তা সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু আমরা আধ্যাত্মিক পথে অনুরক্ত ব্যক্তিদের সাহচর্যে মনে ইতিবাচক চিন্তার প্রভাব আনতে পারি। প্রায়শঃ আমরা রাজসিক এবং তামসিক চিন্তায় গা ভাসিয়ে দিই। পরমাত্মায় মন নিবদ্ধ করলে এগুলি চলে যাবে।
পত্রং(ম্) পুষ্পং(ম্) ফলং(ন্) তোয়ং(য়্ঁ), য়ো মে ভক্ত্যা প্রয়চ্ছতি।
তদহং(ম্) ভক্ত্যুপহৃতম্ , অশ্নামি প্রয়তাত্মনঃ॥9.26॥
তাঁকে পূজা করা কোন কঠিন বা জটিল কাজ নয় বা তাঁকে পাওয়া কোন ভয়ঙ্কর অনুশীলনও নয়।
পত্র, পুস্প বা জল যাই হোক না কেন তিনি এইসব সাধারণ অর্পণ সন্তুষ্ট হয়ে গ্রহণ করেন, বাস্তব রূপ ধারন করে কখনও কখনও তিনি অনুগ্রহ পূর্বক এর অংশ গ্রহণ করেন যদি তা বিশুদ্ধ ভক্তি এবং প্রেম সহকারে অর্পণ করা হয়। ভক্ত তাঁকে কি প্রদান করছেন এটা নয় কি মনোভাবে এবং কি উদ্দেশ্যে তাঁকে ভজনা করছেন সেটাই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
যৎকরোষি যদশ্নাসি, যজ্জুহোষি দদাসি যৎ
যত্তপস্যসি কৌন্তেয়, তৎকুরুষ্ব মদর্পণম্।।27।।
শুভাশুভফলৈরেবং(ম্), মোক্ষ্যসে কর্মবন্ধনৈঃ
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা, বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।28।।
সমস্ত কর্ম তা ভাল হোক কিংবা মন্দ হোক ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা উচিত। এইভাবে একজন কর্ম বন্ধন মুক্ত সন্ন্যাস যোগী হন যেহেতু সব কিছুই তাঁর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা হয়েছে। তিনি তখন তা নিজের ওপর নেন আমাদের সমস্ত কর্মের কলঙ্ক মুছে দেবার জন্য এবং আমাদের মুক্তি পেতে সাহায্য করেন।
এইভাবে প্রতিটি কর্ম তাঁকে অর্পণ করে একজন তাঁকে অর্জন করতে পারেন। এই পদক্ষেপ এটা সুনিশ্চিত করে যে আমাদের যে কোন ব্যক্তিগত কাজের থেকে আমরা আসক্তিহীন হয়ে পরি এবং তাদের ফল দ্বারা প্রভাবিত হই না।
সমোহং(ম্) সর্বভূতেষু , ন মে দ্বেষ্যোস্তি ন প্রিয়ঃ
যে ভজন্তি তু মাং(ম্) ভক্ত্যা , ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।29।।
সব প্রাণীই সমান ভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং পরমেশ্বরের চোখে তারা সমান গুরুত্ব বহন করে। মানুষ তার সীমিত পরিণামদর্শিতায় এবং ক্ষুদ্র মানসিকতায়, ঘৃণার অনুভূতিতে এদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, একে অপরের প্রতি অসহিষ্ণু এবং ঈর্ষান্বিত হয়েছে।
এই শ্লোকে শ্রী ভগবান দৃঢ়তার সাথে বলেছেন সবাই তাঁর চোখে সমান। তাঁর নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জাতি, বর্ণ, কূল বা জাতীয়তা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, সবার জন্যই তাঁর নিরপেক্ষ আকুলতা রয়েছে। তিনি কোন পক্ষপাতিত্ব এবং পূর্বসংস্কারের ঊর্ধ্বে। তিনি তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে সমান অনুভূতিতে ভালবাসেন।
যাই হোক যারা তাঁকে প্রেমপূর্বক ভজনা করেন তারা তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান, যেমনভাবে তিনি তাদের মধ্যেও বিরাজ করেন।
অপি চেৎসুদুরাচারো , ভজতে মামনন্যভাক্
সাধুরেব স মন্তব্যঃ(স্), সম্যগ্ব্যবসিতো হি সঃ।।30।।
এই শ্লোকের মাধ্যমে শ্রী ভগবান ঘোষণা করেছেন যে সব থেকে জঘন্য পাপীও তার পূর্বকৃত কর্মের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে যদি সে পরম বিশ্বাস নিয়ে তাঁর ভজনা করে।
তাঁকে ভজনা করতে থাকলে এবং তাঁর নাম জপ করতে থাকলে সেই পাপীকেও সুনিশ্চিত ভাবে অতীতের গ্লানি মুছে দিয়ে ধার্মিক ব্যক্তি বলে গণ্য করা হবে। এইরূপ মানুষের বিশ্বাস এবং অনন্যচিত্ত হয়ে ঈশ্বরের ভজনা তাকে সাধু বলার যোগ্য করে তোলে।
ক্ষিপ্রং(ম্) ভবতি ধর্মাত্মা , শশ্বচ্ছান্তিং(ন্) নিগচ্ছতি
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি , ন মে ভক্তঃ(ফ্) প্রণশ্যতি।।31।।
এই শ্লোকে পরমাত্মা একটি সপ্রতিভ ঘোষণা করেন যে তাঁর ভক্তরা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনে কখনই নিম্নগামী হবেন না।
আন্তরিক ভজনা এবং ভক্তির মাধ্যমে অত্যন্ত দুরাচারীও অল্প সময়ে ধার্মিক হয়ে ওঠে এবং শাশ্বত শান্তি লাভ করে। তাঁর ভক্তরা কখনও বিনষ্ট হন না কারণ তিনি তাদের সমৃদ্ধির সম্পূর্ণ দায়িত্ব
নেন।
মাং(ম্) হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য , যেপি স্যুঃ(ফ্) পাপযোনয়ঃ
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাঃ(স্) , তেপি যান্তি পরাং(ঙ) গতিম্।।32।।
মনুষ্যসৃষ্ট এই সব বিভাজনকে গুরুত্ব না দিয়ে পরমাত্মা এটা সুনিশ্চিত করেন যে প্রত্যেকে যারা তাঁকে একবার আশ্রয় করবে তারা পরম গতি লাভ করবে । তিনি স্ত্রীলোক হন, ব্যাবসায়ী সম্প্রদায়ের সদস্য হন বা শ্রমিক শ্রেনী হন, প্রত্যেকের ভাগ্য উদ্ধার করার এবং যথার্থ জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা তাঁর সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্য যে পবিত্র ভগবদ্গীতা এবং অন্যান্য ব্রহ্মবিদ্যাগুলি শুধুমাত্র অভিজাতদের জন্য সংরক্ষিত নয়, জন্ম ক্ষেত্রের তারতম্য নির্বিশেষে এগুলি সবার জন্যই এক মূল্যবান সম্পদ। ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার অধিকার কেবল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের নয় বরং তা সবার জন্যই মুক্ত।
কিং(ম্) পুনর্ব্রাহ্মণাঃ(ফ্) পুণ্যা , ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা
অনিত্যমসুখং(ম্) লোকম্, ইমং(ম্) প্রাপ্য ভজস্ব মাম্।।33।।
এই সব দৈবী জ্ঞান লাভ এবং শাস্ত্র কথিত নীতিগুলির অভ্যস করার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ এবং রাজর্ষিগণ আশীর্বাদধন্য ও বিশেষ সুবিধাভোগী । তারা সহজেই পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থগুলি আয়ত্ত করে নিতে পারে এবং ঈশ্বরের নাম জপ করতে পারে। এইগুলি করায়ত্ত থাকার জন্য পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ তারা পেয়ে থাকেন।
এই শ্লোকে শ্রী ভগবান বলেছেন যে সমাজের নীচুস্তরের লোকেরা যদি পরম গতি অর্জন করতে পারেন তাহলে তো সাধু এবং ক্ষত্রিয়দের পক্ষে তা অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য কারণ বহু বছর ধরে তারা অভ্যাস করছেন এবং ভাল সুযোগ পেয়েছেন।
সেইজন্য এই তাৎক্ষণিক, মায়াময় এবং অবসাদগ্রস্ত জীবন থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শ্রী ভগবান আমাদের বলেন অবিচল ভাবে তাঁর ভক্তিযুক্ত সেবায় নিমগ্ন থাকতে।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো , মদ্যাজী মাং(ন্) নমস্কুরু
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবম্ , আত্মানং(ম্) মৎপরায়ণঃ।।34।।
নবম অধ্যায়ের উপযুক্ত উপসংহারে শ্রী ভগবান তাঁর ভক্তদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি যে ভক্তিমার্গই অনুসরণ করুন তা ভক্তি,কর্ম বা জ্ঞান যোগ যাই হোক, সে যেন অবশ্যই তাঁর নাম গান করেন এবং পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে তাঁর ভজনা করেন, তাঁর চিন্তায় বিশ্বস্তভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে লিখিত তাঁর নির্দেশ গুলি মেনে চলেন, এইরূপ সম্পূর্ণ ভক্তি এবং সমর্পণ থাকলে ভক্ত নিশ্চিতভাবে তাঁর সাথে একাত্ম হবেন।
“ওঁ তৎ সদিতি” প্রার্থনাটি পূর্ণ বিশ্বাস ও প্রণিপাত সহ শ্রী কৃষ্ণকে নিবেদন করে সন্ধ্যার সত্রটি শেষ হল।
প্রশ্নোত্তর পর্ব –
প্রশ্নকর্তা – শ্রীমতী বৈষ্ণবী
প্রশ্ন –শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অধ্যায়গুলি “ওঁ শ্রী পরমাত্মনে নমঃ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা” এই শব্দগুলি দিয়ে শুরু হয় কেন ?
উত্তর – যখন কেউ কোন শুভ কাজ বা ধর্মাচরণ শুরু করেন তখন তাকে পরমেশ্বরকে স্মরণ বা আহ্বান করতে হয়। সেইজন্য কোন অধ্যায় আবৃত্তির শুরু হয় ওঁ শ্রী পরমাত্মনে নমঃ বলে। তার পরে বলতে হয় শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং অধ্যায়ের নাম ( যেমন দ্বাদশোধ্যায়ঃ ) যাতে বোঝা যায় কোন অধ্যায় পাঠ করা হবে। এটা যে অধ্যায় পাঠ হবে তাঁর ভূমিকা বিশেষ।
প্রশ্ন – পুষ্পিকা ( যাতে অধ্যায়ের নাম থাকে ) কেন শেষে আবৃত্তি করা হয়, শুরুতে কর হয় না কেন?
উত্তর – পুষ্পিকা একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি সীমা নির্দেশ করে এবং এতে যে অধ্যায় পাঠ করা হল তার নাম সবশেষে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই জন্য এটা শেষে আবৃত্তি করা হয়।