विवेचन सारांश
সাত্ত্বিক,রাজসিক,তামসিক প্রবৃত্তি
হরি নাম সংকীর্তন, প্রারম্ভিক প্রার্থনা ও দীপ প্রজ্জ্বলনের পর আজকের বিবেচন সত্র শুরু হয়। অষ্টাদশ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন। ভগবান অর্জুনকে মোক্ষলাভ ও সন্ন্যাসের পার্থক্য কি সে কথা বিস্তারিত ভাবে বলেছিলেন। এটি আমাদের সকলের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
18.29
বুদ্ধের্ভেদং(ন্) ধৃতেশ্চৈব, গুণতস্ত্রিবিধং(ম্) শৃণু
প্রোচ্যমানমশেষেণ, পৃথক্ত্বেন ধনঞ্জয়॥29॥
হে ধনঞ্জয় ! সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণানুসারে বুদ্ধি ও ধৃতির তিন প্রকারের ভেদ পৃথক পৃথক ভাবে বলছি শোনো। ২৯
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, হে ধনঞ্জয়! গুণ অনুসারে বুদ্ধি ও ধৃতি (সুগভীর জ্ঞান), উভয়েরই তিনটি প্রকার আছে, তার ভিন্ন-ভিন্ন রূপ আছে, তা পূর্ণরূপে শোনো। যেভাবে আমরা আমাদের প্রিয়জন বা পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন নামে সম্বোধন করি, যাতে আমরা তাদের মনোযোগ নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারি। একইভাবে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করেছেন এবং এখানে তিঁনি অর্জুনকে ধনঞ্জয় নামে সম্বোধিত করেন। অর্জুন অনেক যুদ্ধ জয় করে প্রচুর ধন-সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন, তাই ভগবান অর্জুনকে এই নামে সম্বোধন করেছেন। খাণ্ডব বন পুড়িয়ে যখন পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী গড়ে তুলছিলেন, তখন নগরী নির্মাণের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল, তখন অর্জুন অনেক রাজাকে পরাজিত করে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করেন। সেই থেকেই অর্জুনকে ধনঞ্জয় নামে সম্বোধিত করা হয়। এই ধন-সম্পদ লৌকিক (জাগতিক) ছিল, কিন্তু যা অলৌকিক ধন, তা যেন প্রাপ্ত করে অর্জুন প্রকৃত রূপে ধনঞ্জয় হয়ে যান, এইজন্যেই ভগবান অর্জুনকে বলছেন যে এখন আমি তোমাকে বুদ্ধি ও ধৃতির (সুগভীর জ্ঞান) সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক স্বরূপ বলছি। তুমি মনোযোগ দিয়ে শোনো।
প্রবৃত্তিং(ঞ্) চ নিবৃত্তিং(ঞ্) চ, কার্য়াকার্য়ে ভয়াভয়ে
বন্ধং(ম্) মোক্ষং(ঞ্) চ য়া বেত্তি, বুদ্ধিঃ(স্) সা পার্থ সাত্ত্বিকী॥30॥
হে পার্থ ! যে-বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি(২) ও নিবৃত্তি, (৩) কর্তব্য ও অকর্তব্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মোক্ষ ঠিকমতো বুঝতে পারা যায়, তা হল সাত্ত্বিকী বুদ্ধি। ৩০
হে পৃথানন্দন ! যে বুদ্ধি প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কর্তব্য ও অকর্তব্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তিকে সঠিকভাবে জানে, সেই হলো সাত্ত্বিক বুদ্ধি। এখন আমাদের মনে এই প্রশ্ন আসে যে এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি কি? প্রবৃত্তি অর্থাৎ যখন আমরা নিজের জন্য কার্য করি। অন্যদিকে, আমরা যখন সমাজ কল্যাণের জন্য কাজ করি, তখন তা হলো নিবৃত্তি। নিবৃত্তির অর্থ ঘরে বসে থাকা নয়। ষাট বছর বয়স পেরিয়ে গেলে অবসর গ্রহণ করে ঘরে বসে থাকাকে নিবৃত্তি বলে না। আবৃত অর্থাৎ আবরণে ঢেকে দেওয়া, যেমন কাউকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া বা কোনো পাত্রকে প্লেট দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা, একইভাবে আমাদের বুদ্ধি ও মনও আবৃত থাকে।
যেমন একজন শিক্ষক যখন বিদ্যালয়ে কাজ করেন, তখন তিনি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়মে আবদ্ধ থাকেন। তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান, উপাচার্য, প্রধান শিক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মধ্যে থেকে কাজ করেন। তারপর আবার তাকে এই সমস্ত নিয়মের উপরে শিক্ষা বিভাগের নিয়ম, রাজ্য সরকারের নিয়ম ইত্যাদি দ্বারা আবৃত হয়েও কাজ করে যেতে হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে নিরন্তর কাজ করার পর, সেই শিক্ষক ষাট বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়ে যান, তখন কোনো চাপের মধ্যে না থেকে, নিশ্চিন্তে, কোনো নিয়মাধীন না হয়ে, সেই শিক্ষক তার নিজের মনের মতো কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছানুসারে জীবনযাপন করতে পারেন। এখন তিনি আবৃত না থেকে নিবৃত হয়ে কাজ করতে পারেন।
যখন আমি নিজের বা পরিবারের জন্য কাজ করি, তখন সেটাই প্রবৃত্তির মার্গ। আমি যখন সমাজের জন্য, দেশের জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য বা ঈশ্বরের জন্য কাজ করি, তখন সেটাই নিবৃত্তির মার্গ ।
যখন আমরা চাপের মধ্যে থেকে কাজ করি, আমরা আবৃত হয়ে কাজ করি, তখন আমরা সেই কাজটি ততটা উপভোগ করি না, কিন্তু যখন আমরা সেই একই কাজ নিবৃত্ত হয়ে করি, কারণ তখন আমাদের মনে কোন ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা থাকে না। সমাজের জন্য বা অন্তর থেকে অন্যের জন্য কাজ করা হলো নিবৃত্তির মার্গ। কারণ তখন আমাদের মনে কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। এটাই কর্তব্য এবং অ-কর্তব্য, উভয়ের মধ্যে তফাৎ। কর্তব্যের মধ্যে স্বার্থ থাকে এবং অ-কর্তব্যের মধ্যে পরমার্থ থাকে। এই একই ব্যাপার ভয় আর অভয়ের মধ্যেও আছে। ভয় আমাদের অজ্ঞতা, যেমন- অন্ধকারে পড়ে থাকা দড়িতে পা রাখলে আমরা অজ্ঞতার কারণে তাকে সাপ মনে করি এবং যখন আলো থাকে, যখন আমরা জেনে যাই যে এটি একটি দড়ি, তখন আমরা ভয় পাই না, এ হলো অভয়। যে ব্যাপার শুরুতে আমাদের ভয়ভীত করে, তা ধীরে ধীরে জ্ঞান প্রাপ্তির দ্বারা আমাদের অভয়ও প্রদান করে। যখন আমরা জ্ঞান প্রাপ্ত করি, তখন আমাদের ভয়ও সমাপ্ত হয়ে যায়। যে ব্যক্তি ভয় ও অভয়, কর্তব্য ও অ-কর্তব্য, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, বন্ধন ও মোক্ষলাভের মধ্যে পার্থক্য বুঝে নেয়, সে মোক্ষলাভের পথে অগ্রসর হয়ে যায়।
বন্ধন হল মনের বন্ধন।
মোক্ষলাভের জন্য হিমালয় বা বৃন্দাবন বা মথুরা বা হরিদ্বারে যাওয়ার আবশ্যকতা নেই। ভগবান অর্জুনকে বলেন যে তুমি যেখানেই থাকো না কেন, সেই স্থান যেন বৃন্দাবনসম হয়ে যায়। এই মুহূর্তে তুমি শুধুমাত্র কর্তব্যের পথে চলতে থাকো। কিন্তু তোমার এই কর্তব্য পথে যেন কোনো স্বার্থ না থাকে, সেই পথ যেন অ-কর্তব্য হয়ে যায়।
জেনে নেওয়া এবং মেনে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কান দিয়ে শুনে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সেটা জানার জন্য চোখ দিয়ে দেখে নেওয়া আবশ্যক। মেনে নেওয়া হলো বাহ্যিক ব্যাপার। কোনো কিছু জানতে হলে গভীরে যেতে হয়। যিনি জেনে নেন ও তা অনুভব করেন, তার বুদ্ধি হলো সাত্ত্বিক।
পরবর্তী শ্লোকে ভগবান রাজসিক বুদ্ধির বর্ণন করেছেন।
যেমন একজন শিক্ষক যখন বিদ্যালয়ে কাজ করেন, তখন তিনি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়মে আবদ্ধ থাকেন। তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান, উপাচার্য, প্রধান শিক্ষক ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মধ্যে থেকে কাজ করেন। তারপর আবার তাকে এই সমস্ত নিয়মের উপরে শিক্ষা বিভাগের নিয়ম, রাজ্য সরকারের নিয়ম ইত্যাদি দ্বারা আবৃত হয়েও কাজ করে যেতে হয়। এই সমস্ত নিয়মকানুনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে নিরন্তর কাজ করার পর, সেই শিক্ষক ষাট বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়ে যান, তখন কোনো চাপের মধ্যে না থেকে, নিশ্চিন্তে, কোনো নিয়মাধীন না হয়ে, সেই শিক্ষক তার নিজের মনের মতো কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছানুসারে জীবনযাপন করতে পারেন। এখন তিনি আবৃত না থেকে নিবৃত হয়ে কাজ করতে পারেন।
যখন আমি নিজের বা পরিবারের জন্য কাজ করি, তখন সেটাই প্রবৃত্তির মার্গ। আমি যখন সমাজের জন্য, দেশের জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য বা ঈশ্বরের জন্য কাজ করি, তখন সেটাই নিবৃত্তির মার্গ ।
যখন আমরা চাপের মধ্যে থেকে কাজ করি, আমরা আবৃত হয়ে কাজ করি, তখন আমরা সেই কাজটি ততটা উপভোগ করি না, কিন্তু যখন আমরা সেই একই কাজ নিবৃত্ত হয়ে করি, কারণ তখন আমাদের মনে কোন ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা থাকে না। সমাজের জন্য বা অন্তর থেকে অন্যের জন্য কাজ করা হলো নিবৃত্তির মার্গ। কারণ তখন আমাদের মনে কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। এটাই কর্তব্য এবং অ-কর্তব্য, উভয়ের মধ্যে তফাৎ। কর্তব্যের মধ্যে স্বার্থ থাকে এবং অ-কর্তব্যের মধ্যে পরমার্থ থাকে। এই একই ব্যাপার ভয় আর অভয়ের মধ্যেও আছে। ভয় আমাদের অজ্ঞতা, যেমন- অন্ধকারে পড়ে থাকা দড়িতে পা রাখলে আমরা অজ্ঞতার কারণে তাকে সাপ মনে করি এবং যখন আলো থাকে, যখন আমরা জেনে যাই যে এটি একটি দড়ি, তখন আমরা ভয় পাই না, এ হলো অভয়। যে ব্যাপার শুরুতে আমাদের ভয়ভীত করে, তা ধীরে ধীরে জ্ঞান প্রাপ্তির দ্বারা আমাদের অভয়ও প্রদান করে। যখন আমরা জ্ঞান প্রাপ্ত করি, তখন আমাদের ভয়ও সমাপ্ত হয়ে যায়। যে ব্যক্তি ভয় ও অভয়, কর্তব্য ও অ-কর্তব্য, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, বন্ধন ও মোক্ষলাভের মধ্যে পার্থক্য বুঝে নেয়, সে মোক্ষলাভের পথে অগ্রসর হয়ে যায়।
বন্ধন হল মনের বন্ধন।
মোক্ষলাভের জন্য হিমালয় বা বৃন্দাবন বা মথুরা বা হরিদ্বারে যাওয়ার আবশ্যকতা নেই। ভগবান অর্জুনকে বলেন যে তুমি যেখানেই থাকো না কেন, সেই স্থান যেন বৃন্দাবনসম হয়ে যায়। এই মুহূর্তে তুমি শুধুমাত্র কর্তব্যের পথে চলতে থাকো। কিন্তু তোমার এই কর্তব্য পথে যেন কোনো স্বার্থ না থাকে, সেই পথ যেন অ-কর্তব্য হয়ে যায়।
জেনে নেওয়া এবং মেনে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কান দিয়ে শুনে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সেটা জানার জন্য চোখ দিয়ে দেখে নেওয়া আবশ্যক। মেনে নেওয়া হলো বাহ্যিক ব্যাপার। কোনো কিছু জানতে হলে গভীরে যেতে হয়। যিনি জেনে নেন ও তা অনুভব করেন, তার বুদ্ধি হলো সাত্ত্বিক।
য়য়া ধর্মমধর্মং(ঞ্) চ, কার্য়ং(ঞ্) চাকার্য়মেব চ
অয়থাবত্প্রজানাতি, বুদ্ধিঃ(স্) সা পার্থ রাজসী॥31॥
হে পৃথানন্দন ! যে-বুদ্ধি ধর্ম-অধর্ম এবং কর্তব্য অকর্তব্য সম্বন্ধে যথাযথ জানে না তা হল রাজসী বুদ্ধি। ৩১
হে পার্থ! যে বুদ্ধির দ্বারা মানুষ ধর্ম-অধর্ম, কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে যথার্থরূপে জানে না, তাকে তামসিক বুদ্ধি বলে। যে সাত্ত্বিক ব্যক্তি, সে এর যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে অবগত, কিন্তু যে রাজসিক, সে কিছুমাত্রায় জানে, কিন্তু সে সম্পূর্ণরূপে তা জানে না। সে এর পার্থক্য বুঝতে শুরু করেছেন, কিন্তু অনুভব করেননি, তাই সেই বুদ্ধি হলো রাজসিক।
অধর্মং(ন্) ধর্মমিতি য়া, মন্যতে তমসাবৃতা
সর্বার্থান্বিপরীতাংশ্চ, বুদ্ধিঃ(স্) সা পার্থ তামসী॥32॥
হে পার্থ! যে-বুদ্ধি তমোগুণে সমাবৃত হয়ে অধর্মকে ‘ধর্ম” মনে করে এবং সমস্ত বিষয়েই বিপরীত অর্থ করে, তা হল তামসী বুদ্ধি। ৩২
হে পৃথানন্দন ! তমোগুণ দ্বারা পরিবেষ্টিত যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম বলে মনে করে এবং সমস্ত কিছুকে বিপরীত বলে মেনে নেয়, সেই বুদ্ধি তামসিক। তামসিক বুদ্ধি সবসময় নেতিবাচক যুক্তির পথে চলে। এমন বুদ্ধি মনের কথাই শোনে, বুদ্ধির কথা নয়, তাই সেক্ষেত্রে মনই বিজয়ী হয়ে যায়। মন বড় বড় যুক্তি দেয়, এমনকি ভুল কাজের জন্যও তর্ক প্রস্তুত করে। এটি হলো তামসিক বুদ্ধি।
কেউ কেউ বলে, যে বৃন্দাবনে যাওয়ার ইচ্ছা নেই, কারণ সেখানে পাণ্ডারা টাকা-পয়সার জন্যে পিছনে ধাওয়া করে। ভগবানের চিন্তন কিভাবে করবো? আজকাল মন্দিরে দুই মিনিটের জন্য ভগবানের দর্শন করতে হলে ১০০ টাকা দিতে হয়। ব্যভিচার ও দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। ভগবানের মন্দিরও যদি এমন হয়ে যায়, তাহলে মন্দিরে গিয়ে লাভ কী? আমি তো বাড়িতেই ঠিক আছি। এই সব হলো মনের যুক্তি-তর্ক। আপনি তীর্থস্থানে পাণ্ডাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে যাননি। আপনি সেখানে ভগবানের দর্শন করতে গেছেন এবং ভগবানের দর্শন এত সহজ নয়। আমরা দেখতে পাই যে সমস্ত প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলি পাহাড়-পর্বতের উপরে অবস্থিত। মন্দির দর্শন করার জন্য ভক্তদের অনেক কষ্ট সহ্য করে সেইসব স্থানে পৌঁছতে হয়। সেটা জম্মু-কাশ্মীরের বৈষ্ণো দেবীর মন্দির হোক বা মহারাষ্ট্রের সপ্তশৃঙ্গী মন্দির। কষ্ট সহ্য করতে হবে। একইপ্রকার কষ্টই আমরা পাণ্ডাদের কাছ থেকে পাই। আমাদের সেসব কষ্টের চিন্তা না করে নিজেকে ভগবানের চিন্তনে একাগ্রচিত্ত হওয়া উচিত। আমাদের একাগ্রতা শ্রীকৃষ্ণ, রাধা রমন জী, গোবর্ধন গিরিধারীর দর্শনের প্রতি থাকা উচিত, অন্যান্য অসুবিধার দিকে নয়। তবেই আমরা প্রফুল্লচিত্তে ভগবানের দর্শন করতে পারি। যখন ভগবানকে দর্শন করতে যাই এবং তখন যদি আমাদের মন ফুল বিক্রেতার কাছে রেখে আসা জুতোর ওপরে পড়ে থাকে, তবে আমরা ভগবান দর্শনে আনন্দ প্রাপ্ত করতে পারি না। এই ধরনের বুদ্ধি হল তামসিক বুদ্ধি। জীবনের অন্তিম সময়েও এই তামসিক বুদ্ধি মনকে কোথাও না কোথাও আটকে রেখে দেবে, যেমন মন্দিরে গিয়ে মন জুতোয় আটকে থাকে, ঠিক তেমনিই স্বর্গে যাওয়ার সময় কিছু না কিছুতে আটকে যাবেই। জীবন শেষ হয়ে গেলেও, মন আত্মার সাথে আটকে থাকবে এবং পুনর্জন্ম গ্রহণ করে পুনঃ এই সংসারে ফিরে আসবে।
पुनरपि जननम्, पुनरपि मरणम्।
पुनरपि जननी जठरे शयनम्।
পুনরায় পুনর্জন্ম প্রাপ্ত করা, দুঃখ-কষ্ট, এসব থেকে মুক্তি পাওয়াকে মোক্ষ বলে। এই মোক্ষ লাভের জন্য সাত্ত্বিক বুদ্ধি থাকা আবশ্যিক।
পথে যেতে যেতে অনেক সময় ভিক্ষুক, দীন-দরিদ্র বা কিন্নর এসে টাকা চায়। সেই সময় আমাদের মন কি দ্রবীভূত হয়ে যায়? নাকি আমাদের বুদ্ধি অনেক যুক্তি-তর্ক দিতে থাকে। যে বুদ্ধি এই যুক্তি তৈরি করে তা হল তামসিক বুদ্ধি।
কেউ কেউ বলে, যে বৃন্দাবনে যাওয়ার ইচ্ছা নেই, কারণ সেখানে পাণ্ডারা টাকা-পয়সার জন্যে পিছনে ধাওয়া করে। ভগবানের চিন্তন কিভাবে করবো? আজকাল মন্দিরে দুই মিনিটের জন্য ভগবানের দর্শন করতে হলে ১০০ টাকা দিতে হয়। ব্যভিচার ও দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। ভগবানের মন্দিরও যদি এমন হয়ে যায়, তাহলে মন্দিরে গিয়ে লাভ কী? আমি তো বাড়িতেই ঠিক আছি। এই সব হলো মনের যুক্তি-তর্ক। আপনি তীর্থস্থানে পাণ্ডাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে যাননি। আপনি সেখানে ভগবানের দর্শন করতে গেছেন এবং ভগবানের দর্শন এত সহজ নয়। আমরা দেখতে পাই যে সমস্ত প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলি পাহাড়-পর্বতের উপরে অবস্থিত। মন্দির দর্শন করার জন্য ভক্তদের অনেক কষ্ট সহ্য করে সেইসব স্থানে পৌঁছতে হয়। সেটা জম্মু-কাশ্মীরের বৈষ্ণো দেবীর মন্দির হোক বা মহারাষ্ট্রের সপ্তশৃঙ্গী মন্দির। কষ্ট সহ্য করতে হবে। একইপ্রকার কষ্টই আমরা পাণ্ডাদের কাছ থেকে পাই। আমাদের সেসব কষ্টের চিন্তা না করে নিজেকে ভগবানের চিন্তনে একাগ্রচিত্ত হওয়া উচিত। আমাদের একাগ্রতা শ্রীকৃষ্ণ, রাধা রমন জী, গোবর্ধন গিরিধারীর দর্শনের প্রতি থাকা উচিত, অন্যান্য অসুবিধার দিকে নয়। তবেই আমরা প্রফুল্লচিত্তে ভগবানের দর্শন করতে পারি। যখন ভগবানকে দর্শন করতে যাই এবং তখন যদি আমাদের মন ফুল বিক্রেতার কাছে রেখে আসা জুতোর ওপরে পড়ে থাকে, তবে আমরা ভগবান দর্শনে আনন্দ প্রাপ্ত করতে পারি না। এই ধরনের বুদ্ধি হল তামসিক বুদ্ধি। জীবনের অন্তিম সময়েও এই তামসিক বুদ্ধি মনকে কোথাও না কোথাও আটকে রেখে দেবে, যেমন মন্দিরে গিয়ে মন জুতোয় আটকে থাকে, ঠিক তেমনিই স্বর্গে যাওয়ার সময় কিছু না কিছুতে আটকে যাবেই। জীবন শেষ হয়ে গেলেও, মন আত্মার সাথে আটকে থাকবে এবং পুনর্জন্ম গ্রহণ করে পুনঃ এই সংসারে ফিরে আসবে।
पुनरपि जननम्, पुनरपि मरणम्।
पुनरपि जननी जठरे शयनम्।
পুনরায় পুনর্জন্ম প্রাপ্ত করা, দুঃখ-কষ্ট, এসব থেকে মুক্তি পাওয়াকে মোক্ষ বলে। এই মোক্ষ লাভের জন্য সাত্ত্বিক বুদ্ধি থাকা আবশ্যিক।
পথে যেতে যেতে অনেক সময় ভিক্ষুক, দীন-দরিদ্র বা কিন্নর এসে টাকা চায়। সেই সময় আমাদের মন কি দ্রবীভূত হয়ে যায়? নাকি আমাদের বুদ্ধি অনেক যুক্তি-তর্ক দিতে থাকে। যে বুদ্ধি এই যুক্তি তৈরি করে তা হল তামসিক বুদ্ধি।
ধৃত্যা য়য়াধারয়তে, মনঃপ্রাণেন্দ্রিয়ক্রিয়া:
য়োগেনাব্যভিচারিণ্যা, ধৃতিঃ(স্) সা পার্থ সাত্ত্বিকী॥33॥
হে পার্থ ! যে অব্যভিচারিণী ধারণাশক্তিতে মানুষ ধ্যানযোগের দ্বারা মন-প্রাণ-ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া ধারণ করে, তাকে সাত্ত্বিকী ধৃতি বলে। ৩৩
হে পার্থ! সমতা যুক্ত অব্যভিচারিণী ধৃতি, যার দ্বারা একজন ব্যক্তি মন, প্রাণ এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াসকলকে নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাৎ সংযম বজায় রাখে, সেই ধৃতি সাত্ত্বিকী। ভোগের আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ ব্যভিচার। নিঃস্বার্থ উপলব্ধি, আসক্তি, দ্বেষ ও চিন্তা থেকে মুক্তিই হলো সাত্ত্বিক বুদ্ধি।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা হয়েছে: জমি সংক্রান্ত বিবাদের শুনানির জন্য এক পরিবারের ভাইয়েরা জেলা আদালতে যেতেন, আবার সেই পরিবারের মহিলারা নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতেন। এই বিবাদের বিষয়ে পরিবারের মহিলাদের কোনো চিন্তা ছিল না, কারণ তাদের বুদ্ধি সাত্ত্বিক ছিল। ভাইদের রাজসী বুদ্ধি ছিলো, আর তাদের স্ত্রীদের ছিল সাত্ত্বিক বুদ্ধি। আমাদের মনে দুই ধরনের বিচার-ভাবনা, নেতিবাচক এবং ইতিবাচক, প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।
Think of devil and devil is there.
অশুভ চিন্তা আমাদের মধ্যেই থাকে। এ কারণেই সন্ধ্যাকালে প্রদীপ জ্বালানোর সময় এই শ্লোকটি বলা হয়-
शत्रु बुद्धि विनाशय, दीप ज्योति: नमोस्तुते।
এখানে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় যে আমার মনের শত্রু বুদ্ধি বিনষ্ট হোক। শত্রু নাশের কোন কামনা করা হয় নি। এখানে অন্য কারো শত্রু বুদ্ধির বিনাশের কথাও বলা হচ্ছে না। এখানে স্বয়ং নিজের শত্রু বুদ্ধির বিনাশ করার কথা বলা হয়েছে।
मन प्राणेंद्रिय क्रिया:।
মন এবং প্রাণের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মনের সমস্ত ক্রিয়া যখন প্রাণকে সংযমিত করে, তখন মন নিজে নিজেও সংযমী হয়ে যায়। সোজা হয়ে বসুন, একটি দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করুন, তারপর ধীরে ধীরে শ্বাসটি ছাড়ুন।
श्रीकृष्ण: शरणम् मम।
এই উচ্চারণের সাথে শ্বাস গ্রহণ করতে হবে এবং এই একই উচ্চারণের সাথে সাথে শ্বাস ছাড়তে হবে। যেমন যেমন আমরা নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করি, সাথে সাথে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। মনকে সংযমী করলে ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে। মনের সংযম প্রাণের সংযম থেকে আসে। প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের সাথে ইতিবাচকতার প্রবেশ এবং প্রতিটি শ্বাস ত্যাগের সাথে নেতিবাচকতার প্রস্থানের এই প্রক্রিয়া নিরন্তর চলতে থাকে।
मन प्राणेंद्रिया क्रिया: योगेना व्यभिचारेणा।
এই ধ্যান যোগের মাধ্যমে যিনি নিজের মন ও প্রাণকে সংযমে রাখতে পারে, সেই ধৃতিকে সাত্ত্বিক ধৃতি বলা হয়। পরীক্ষার সময়, প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে হবে, শরীরের মধ্যে সমত্ব ভাব থাকলে বুদ্ধির একাগ্রতা আসে।
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ৷
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥৬.১৩॥
বহিরঙ্গের সমস্ত দিক এখন অদৃশ্য, সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন অভ্যন্তরীণে কেন্দ্রিত হয়েছে। সোজা হয়ে বসে শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাস ছাড়ার প্রক্রিয়ায় মনোযোগ কেন্দ্রিত করুন। নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। এটি দশবার করুন এবং তারপরে প্রশ্নপত্র পড়া শুরু করুন। পরীক্ষা হলে বসে যখন শিক্ষার্থীরা এটি করে, তখন তাদের মন, প্রাণ এবং ইন্দ্রিয় একাগ্র হয় এবং পরবর্তী তিন ঘন্টা তারা মনোযোগ সহকারে প্রশ্নপত্রটি সমাধান করে। পরীক্ষার আগে সবচেয়ে বড় ভয় exam phobia থেকে মুক্তি পায়।
রামায়ণে, বিভীষণ সাত্ত্বিক ধৃতির সাথে যুক্ত। রাবণ রাজসী ধৃতি এবং কুম্ভকর্ণ তামসী ধৃতির সাথে যুক্ত। সে ছয় মাস ঘুমায় আর ছয় মাস জেগে থাকে। এই তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে আমরা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক প্রবৃত্তিকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি। একদিকে যেখানে কুম্ভকর্ণ ছয় মাস ঘুমিয়ে ছয় মাস জেগে থাকার বরদান চান, অন্যদিকে রাবণ ভগবানকে প্রসন্ন করে বর পাওয়ার জন্য নিজের মাথা কেটে ভগবানকে নিবেদন করতেন। এইজন্য রাবণ নয়টি গ্রহকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। কুবেরের কাছ থেকে পুষ্পক বিমান কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি সবাইকে নিজের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের উপর নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে আমরা হিরণ্যকশিপুর রূপও বলতে পারি। হিরণ্যকশিপুও তপস্যার মাধ্যমে অমরত্বের বর চেয়েছিলো। ব্রহ্মা তা প্রত্যাখ্যান করলে সে বললো, আমাকে এমন বর দিন যাতে কোনো মানুষ, দানব বা কোনো দেবতা যেন আমাকে হত্যা না করতে পারে। না আমি দিনের বেলা মরব, না আমি রাত্রিবেলা মরব, না আমি অস্ত্রের আঘাতে মরব। না আমি ঘরের মধ্যে মরব, না আমি ঘরের বাইরে মরব, না আমি পৃথিবীতে মরব, না আমি পাতালে মরব, না আমি আকাশে মরব। ব্রহ্মা তাকে তথাস্তু বললেন এবং সেই বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে ভীতি-সন্ত্রাসের সৃষ্টি করলো, তখন ব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচাতে ভগবান বিষ্ণুকে নরসিংহের রূপে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তিনি মানুষও না, পশুও না, আবার দেবতাও না। হিরণ্যকশিপুকে নিজের উরুতে ঝুলিয়ে নখ দিয়ে পেট চিরে দিয়েছিলেন। না অস্ত্র দিয়ে না শস্ত্র দিয়ে, তখন সন্ধ্যাকাল ছিলো, না ছিলো দিন না ছিলো রাত্রি। তাকে ঘরের ভিতরে বা বাইরে হত্যা করা হয়নি, তার হত্যা দোরগোড়ার ওপর করা হয়েছিলো। হিরণ্যকশিপুর ঘরেই প্রহ্লাদের জন্ম হয়, যিনি ছিলেন সাত্ত্বিক প্রবৃত্তির।
এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা হয়েছে: জমি সংক্রান্ত বিবাদের শুনানির জন্য এক পরিবারের ভাইয়েরা জেলা আদালতে যেতেন, আবার সেই পরিবারের মহিলারা নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতেন। এই বিবাদের বিষয়ে পরিবারের মহিলাদের কোনো চিন্তা ছিল না, কারণ তাদের বুদ্ধি সাত্ত্বিক ছিল। ভাইদের রাজসী বুদ্ধি ছিলো, আর তাদের স্ত্রীদের ছিল সাত্ত্বিক বুদ্ধি। আমাদের মনে দুই ধরনের বিচার-ভাবনা, নেতিবাচক এবং ইতিবাচক, প্রতিনিয়ত চলতে থাকে।
Think of devil and devil is there.
অশুভ চিন্তা আমাদের মধ্যেই থাকে। এ কারণেই সন্ধ্যাকালে প্রদীপ জ্বালানোর সময় এই শ্লোকটি বলা হয়-
शत्रु बुद्धि विनाशय, दीप ज्योति: नमोस्तुते।
এখানে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় যে আমার মনের শত্রু বুদ্ধি বিনষ্ট হোক। শত্রু নাশের কোন কামনা করা হয় নি। এখানে অন্য কারো শত্রু বুদ্ধির বিনাশের কথাও বলা হচ্ছে না। এখানে স্বয়ং নিজের শত্রু বুদ্ধির বিনাশ করার কথা বলা হয়েছে।
मन प्राणेंद्रिय क्रिया:।
মন এবং প্রাণের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মনের সমস্ত ক্রিয়া যখন প্রাণকে সংযমিত করে, তখন মন নিজে নিজেও সংযমী হয়ে যায়। সোজা হয়ে বসুন, একটি দীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করুন, তারপর ধীরে ধীরে শ্বাসটি ছাড়ুন।
श्रीकृष्ण: शरणम् मम।
এই উচ্চারণের সাথে শ্বাস গ্রহণ করতে হবে এবং এই একই উচ্চারণের সাথে সাথে শ্বাস ছাড়তে হবে। যেমন যেমন আমরা নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করি, সাথে সাথে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। মনকে সংযমী করলে ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে। মনের সংযম প্রাণের সংযম থেকে আসে। প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের সাথে ইতিবাচকতার প্রবেশ এবং প্রতিটি শ্বাস ত্যাগের সাথে নেতিবাচকতার প্রস্থানের এই প্রক্রিয়া নিরন্তর চলতে থাকে।
मन प्राणेंद्रिया क्रिया: योगेना व्यभिचारेणा।
এই ধ্যান যোগের মাধ্যমে যিনি নিজের মন ও প্রাণকে সংযমে রাখতে পারে, সেই ধৃতিকে সাত্ত্বিক ধৃতি বলা হয়। পরীক্ষার সময়, প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে হবে, শরীরের মধ্যে সমত্ব ভাব থাকলে বুদ্ধির একাগ্রতা আসে।
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ ৷
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥৬.১৩॥
রামায়ণে, বিভীষণ সাত্ত্বিক ধৃতির সাথে যুক্ত। রাবণ রাজসী ধৃতি এবং কুম্ভকর্ণ তামসী ধৃতির সাথে যুক্ত। সে ছয় মাস ঘুমায় আর ছয় মাস জেগে থাকে। এই তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে আমরা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক প্রবৃত্তিকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি। একদিকে যেখানে কুম্ভকর্ণ ছয় মাস ঘুমিয়ে ছয় মাস জেগে থাকার বরদান চান, অন্যদিকে রাবণ ভগবানকে প্রসন্ন করে বর পাওয়ার জন্য নিজের মাথা কেটে ভগবানকে নিবেদন করতেন। এইজন্য রাবণ নয়টি গ্রহকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। কুবেরের কাছ থেকে পুষ্পক বিমান কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি সবাইকে নিজের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের উপর নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে আমরা হিরণ্যকশিপুর রূপও বলতে পারি। হিরণ্যকশিপুও তপস্যার মাধ্যমে অমরত্বের বর চেয়েছিলো। ব্রহ্মা তা প্রত্যাখ্যান করলে সে বললো, আমাকে এমন বর দিন যাতে কোনো মানুষ, দানব বা কোনো দেবতা যেন আমাকে হত্যা না করতে পারে। না আমি দিনের বেলা মরব, না আমি রাত্রিবেলা মরব, না আমি অস্ত্রের আঘাতে মরব। না আমি ঘরের মধ্যে মরব, না আমি ঘরের বাইরে মরব, না আমি পৃথিবীতে মরব, না আমি পাতালে মরব, না আমি আকাশে মরব। ব্রহ্মা তাকে তথাস্তু বললেন এবং সেই বর পেয়ে হিরণ্যকশিপু সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে ভীতি-সন্ত্রাসের সৃষ্টি করলো, তখন ব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচাতে ভগবান বিষ্ণুকে নরসিংহের রূপে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তিনি মানুষও না, পশুও না, আবার দেবতাও না। হিরণ্যকশিপুকে নিজের উরুতে ঝুলিয়ে নখ দিয়ে পেট চিরে দিয়েছিলেন। না অস্ত্র দিয়ে না শস্ত্র দিয়ে, তখন সন্ধ্যাকাল ছিলো, না ছিলো দিন না ছিলো রাত্রি। তাকে ঘরের ভিতরে বা বাইরে হত্যা করা হয়নি, তার হত্যা দোরগোড়ার ওপর করা হয়েছিলো। হিরণ্যকশিপুর ঘরেই প্রহ্লাদের জন্ম হয়, যিনি ছিলেন সাত্ত্বিক প্রবৃত্তির।
য়য়া তু ধর্মকামার্থান্,ধৃত্যা ধারয়তেऽর্জুন
প্রসঙ্গেন ফলাকাঙ্ক্ষী, ধৃতিঃ(স্) সা পার্থ রাজসী॥34॥
কিন্তু, হে পৃথাপুত্র অর্জুন ! ফলাসক্ত মানুষ যে ধারণাশক্তির দ্বারা অত্যন্ত আসক্তিপূর্বক ধর্ম, অর্থ ও কামনাকে ধারণ করে, তাকে রাজসী ধৃতি বলে। ৩৪
হে পৃথানন্দন অর্জুন ! মনুষ্য ফলের আকাঙ্ক্ষায় যে ধৃতির বশবর্তী হয়ে ধর্ম, কাম, ভোগ ও সম্পদকে পরম আসক্তি সহকারে ধারণ করে, সেই ধৃতিই হলো রাজসিক। সেই ব্যক্তি কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা রাখে। ঠিক যেমন একজন ব্যক্তি ভাগবত পাঠের আয়োজন করে এবং মনে মনে এই ইচ্ছা পোষণ করে যে সবাই যেন তাকে নিয়ে কথা বলে, তার গুণগান করে। আমার যেন অনেক নাম হয়, আমি যেন বিখ্যাত হয়ে যাই। কোন ধর্মীয় কাজে যদি এই ধরণের ইচ্ছা পোষণ করা হয়, তবে এই প্রকার ধৃতিকে রাজসিক বলা হয়।
য়য়া স্বপ্নং(ম্) ভয়ং(ম্) শোকং(ম্), বিষাদং(ম্) মদমেব চ
ন বিমুঞ্চতি দুর্মেধা, ধৃতিঃ(স্) সা পার্থ তামসী॥35॥
হে পার্থ ! দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যে ধারণাশক্তির দ্বারা নিদ্রা-ভয়-শোক-অবসাদ ও মদ ত্যাগ করে না অর্থাৎ এইগুলিকে ধরে রাখে তাকে তামসী ধৃতি বলে। ৩৫
হে পার্থ! দুষ্ট বুদ্ধি সম্পন্ন মনুষ্য যে ধৃতির কারণে নিদ্রা, ভয়, চিন্তা, দুঃখ, প্রমত্ততা ও অহংকার ত্যাগ করে না, সেই ধৃতি তামসিক। তারা এই প্রকার ধৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন থাকার কারণে বেশি না ঘুমিয়ে পারে না। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধনের প্রসঙ্গে বলা যায় যে একজন অত্যন্ত সাত্ত্বিক এবং অন্যজন অত্যন্ত রাজসিক। কর্ণ ও অর্জুনের কথা উঠলে অনেকেই বলে থাকেন যে কর্ণের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। কর্ণকে আদর্শ নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য অনেক লেখনী ও রচনা লেখা হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কি কম অবিচার করা হয়েছে? মা কুন্তী যেমন কর্ণকে পরিত্যাগ করেছিলেন, তেমনি ভগবান কৃষ্ণকেও মা দেবকী পরিত্যাগ করেছিলেন। ভগবান কৃষ্ণের জন্মের পূর্বেই কংসরূপী মৃত্যু তাঁর দিকে ঘনিয়ে এসেছিলো। প্রতি পদে পদে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অবিচার করা হয়েছিল। দুর্যোধন কর্ণকে অঙ্গ দেশের রাজা করে দিয়েছিলো কারণ তার মনে আকাঙ্ক্ষা ছিল, ফল প্রাপ্তির কামনা ছিল। কর্ণ অন্যায়কে সমর্থন করেছিলো, রাজসভায় জনসমক্ষে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য কর্ণ উপভোগ করেছিলো। আমাদের এই পার্থক্যগুলি বুঝতে হবে। যে ধৃতি স্বপ্ন, ভয়, চিন্তা, বিষাদ, দম্ভ ইত্যাদিকে ত্যাগ করে না, সেই ধৃতিকে তামসী বলে জানবে।
সুখং(ন্) ত্বিদানীং(ন্) ত্রিবিধং(ম্),শৃণু মে ভরতর্ষভ
অভ্যাসাদ্রমতে য়ত্র, দুঃখান্তং(ঞ্) চ নিগচ্ছতি॥36॥
য়ত্তদগ্রে বিষমিব, পরিণামেऽমৃতোপমম্
তত্সুখং(ম্) সাত্ত্বিকং(ম্) প্রোক্তম্, আত্মবুদ্ধিপ্রসাদজম্ ॥37॥
হে ভরতশ্রেষ্ঠ ! তিনপ্রকার সুখের বিষয় এইবার তুমি আমার নিকট শোনো। যে সুখে মানুষ ভজন, ধ্যান এবং সেবাদির অভ্যাসের দ্বারা প্রীত ও পরিতৃপ্ত হয় এবিং পরিণামে দুঃখ হতে সমারূপে মুক্ত হয়— এইরূপ সুখ, যা আরম্ভে বিষতুল্য মনে হলেও পরিণামে অমৃতের ন্যায় হয়ে থাকে; সেই পরমাত্ম বিষয়ক বুদ্ধির নির্মলতা হতে উৎপন্ন সুখকে সাত্ত্বিক সুখ বলা হয়। ৩৬-৩৭
হে ভারতশ্রেষ্ঠ অর্জুন! তিন প্রকার সুখের কথাও তুমি শুনে নাও। যে সুখে একজন ভক্ত নিরন্তর ধ্যান, সেবা ও সাধনার আনন্দ ভোগ করে এবং যা দুঃখের অবসান ঘটায়, যে সুখ প্রারম্ভে বিষতুল্য মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তার পরিণাম অমৃত তুল্য হয়ে যায়। পরমাত্ম-বিষয়ক বুদ্ধির দীপ্তি থেকে উৎপন্ন এমন সুখ, যা সংসারের আসক্তির কারণে শুরুতে বিষের মতো মনে হলেও শেষে তা অমৃত সমান মনে হয়, সেই সুখকে সাত্ত্বিক বলা হয়। প্রারম্ভে খুব কঠিন বলে মনে হয়। যেমন করোনার সময়ে আমাদের তেতো স্বাদের ভেষজ পানীয় খেতে হয়েছিল, কিন্তু সেই পানীয় অমৃত তুল্য হয়ে আমাদের করোনা মহামারী থেকে অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করেছে।
প্রাতঃকালে ঘুম থেকে ওঠা কঠিন মনে হয়, কিন্তু একবার যদি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস তৈরী হয়ে যায়, তখন দেখবেন আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করেছে, অর্থাৎ শুরুতে কষ্ট হলেও এর পরিণাম অমৃত তুল্য। একইভাবে, ভগবানের চিন্তন-মনন করা শুরুতে খুব কঠিন মনে হয়, কারণ মন তাতে আনন্দ উপভোগ করে না। মন বিভ্রান্ত থাকে, বিচলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু একবার যখন একাগ্র হয়ে ধ্যানে মনোনিবেশ করা শুরু করবেন, তখন আপনি প্রফুল্লিত বোধ করবেন। যে প্রকার, করলার সবজি স্বাদে তেতো হলেও এর সেবন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আমরা যখন আমাদের স্বাস্থ্যের খেয়াল না রেখে শুধু জিভের স্বাদের জন্য খাই, তখন তার ফল কিন্তু বিষ তুল্য হয়ে যায়।
কেউ কেউ মনে করে গীতা শেখা আর কণ্ঠস্থ করার একটা পাগলামি? এত সময় কার কাছে আছে যে গীতা পড়বে আবার তা মুখস্থও করবে। কিন্তু যারা এর স্বাদ একবার পেয়েছেন এবং এর ফলস্বরূপ তাদের জীবনে পরিবর্তন হতে শুরু হয়েছে, তাদের জন্য এর পরিণাম হলো অমৃত তুল্য। গীতা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে-
গীতা পঠন হলো অমৃত সমান। শ্রী কৃষ্ণ উপনিষদরূপী গাভীকে দোহন করে, বাছুর রূপী পার্থের মাধ্যমে গীতারূপী সুন্দর অমৃত আমাদের প্রদান করেছেন। যখন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন বা মুখস্থ করার কথা আসে, তখন কিছু কিছু লোক দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবে এ কিসের মধ্যে আটকা পড়লাম ? কিন্তু এই পথে একবার অগ্রসর হয়ে পড়লে শুধুই আনন্দের অনুভূতি প্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ এর পরিণাম অমৃত সম হয় । ছাব্বিশটি দৈবী গুণের মধ্যে ভগবান দমনকেও (সংযম, শাসন) দৈবী সম্পদ বলে বর্ণন করেছেন। শচীন তেন্ডুলকার তার কঠোর অনুশীলনের দ্বারা সকলের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন।
প্রাতঃকালে ঘুম থেকে ওঠা কঠিন মনে হয়, কিন্তু একবার যদি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস তৈরী হয়ে যায়, তখন দেখবেন আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করেছে, অর্থাৎ শুরুতে কষ্ট হলেও এর পরিণাম অমৃত তুল্য। একইভাবে, ভগবানের চিন্তন-মনন করা শুরুতে খুব কঠিন মনে হয়, কারণ মন তাতে আনন্দ উপভোগ করে না। মন বিভ্রান্ত থাকে, বিচলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু একবার যখন একাগ্র হয়ে ধ্যানে মনোনিবেশ করা শুরু করবেন, তখন আপনি প্রফুল্লিত বোধ করবেন। যে প্রকার, করলার সবজি স্বাদে তেতো হলেও এর সেবন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আমরা যখন আমাদের স্বাস্থ্যের খেয়াল না রেখে শুধু জিভের স্বাদের জন্য খাই, তখন তার ফল কিন্তু বিষ তুল্য হয়ে যায়।
কেউ কেউ মনে করে গীতা শেখা আর কণ্ঠস্থ করার একটা পাগলামি? এত সময় কার কাছে আছে যে গীতা পড়বে আবার তা মুখস্থও করবে। কিন্তু যারা এর স্বাদ একবার পেয়েছেন এবং এর ফলস্বরূপ তাদের জীবনে পরিবর্তন হতে শুরু হয়েছে, তাদের জন্য এর পরিণাম হলো অমৃত তুল্য। গীতা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে-
সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।
গীতা পঠন হলো অমৃত সমান। শ্রী কৃষ্ণ উপনিষদরূপী গাভীকে দোহন করে, বাছুর রূপী পার্থের মাধ্যমে গীতারূপী সুন্দর অমৃত আমাদের প্রদান করেছেন। যখন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন বা মুখস্থ করার কথা আসে, তখন কিছু কিছু লোক দ্বিধান্বিত হয়ে ভাবে এ কিসের মধ্যে আটকা পড়লাম ? কিন্তু এই পথে একবার অগ্রসর হয়ে পড়লে শুধুই আনন্দের অনুভূতি প্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ এর পরিণাম অমৃত সম হয় । ছাব্বিশটি দৈবী গুণের মধ্যে ভগবান দমনকেও (সংযম, শাসন) দৈবী সম্পদ বলে বর্ণন করেছেন। শচীন তেন্ডুলকার তার কঠোর অনুশীলনের দ্বারা সকলের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন।
বিষয়েন্দ্রিয়সংয়োগাদ্ ,য়ত্তদগ্রেऽমৃতোপমম্
পরিণামে বিষমিব, তত্সুখং(ম্) রাজসং(ম্) স্মৃতম্॥38॥
যে-সুখ বিষয় ও ইন্দ্রিয়াদির সংযোগে হয়, যা ভোগকালের প্রারম্ভে অমৃতবৎ মনে হলেও পরিণামে বিষতুল্য(১) হয়—সেই সুখকে রাজস সুখ বলা হয়। ৩৮
যে সুখ ইন্দ্রিয় ও বিষয়সমূহের সংযোগে প্রাপ্ত হয়, শুরুতে সেটা অমৃত সদৃশ এবং পরে তা বিষ সদৃশ প্রতীত হয়। এইপ্রকার সুখকে বলা হয়েছে রাজসিক। প্রারম্ভে এর স্বাদ জিহ্বায় অমৃততুল্য মনে হয়। খাওয়ার সময়ও আমরা ঘেমে নেয়ে উঠছি আবার খাবার চার ঘণ্টা পর প্রচণ্ড অ্যাসিডিটি হয়ে গেছে, শরীরের অস্বস্তি বাড়তে থাকে, অর্থাৎ খাবারের পরিণাম বিষ তুল্য হয়ে যায়। এমন সুখকে রাজসিক সুখ বলা হয়েছে।
য়দগ্রে চানুবন্ধে চ, সুখং(ম্) মোহনমাত্মনঃ
নিদ্রালস্যপ্রমাদোত্থং(ন্) তত্তামসমুদাহৃতম্॥39॥
যে-সুখ ভোগকালে এবং পরিণামে আত্মাকে মোহগ্রস্ত করে—নিদ্রা, আলস্য এবং প্রমাদ হতে জাত সেই সুখকে তামস সুখ বলা হয়। ৩৯
যে সুখ প্রথমে ও শেষে নিজেকে মোহিত করে রাখে, যা নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ থেকে উৎপন্ন হয়, তাকে তামসিক সুখ বলে। উদাহরণস্বরূপ : মধুমেহ রোগে (ডাইবিটিস) শর্করার মাত্রা চারশো ছুঁয়েছে, কিন্তু তবুও সামনে জিলিপি দেখে অজ্ঞতাবশত, স্বাদের লোভে জিলিপি খেয়ে ফেললো। সে তার ইন্দ্রিয়কে সংযমে রাখেনি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেনি। এতে নিদ্রা, অলসতা ও প্রমাদ সৃষ্টি হয়, এ ধরনের সুখই হলো তামসিক সুখ। ভগবান সুখের যে সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করেছেন, সেই অনুযায়ী আমাদের নিজেকে যাচাই করা উচিত।
প্রতিদিন সকালে প্রথমেই আমাদের মন ও বুদ্ধির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। বুদ্ধি বলে উঠতে, কিন্তু মন বলে ঘুমাতে। বুদ্ধি বলে—আমাদের ওঠা উচিত, মন বলে—আমাদের ঘুমানো উচিত এবং উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাঝে মাঝে মন বিজয়ী হয়। তখন আমরা ভাবি পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুমিয়ে নিই এবং ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা পার করে যায়। এটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। সেই দিনের সুখকে তামসিক সুখ বলে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করে আমরা এটা বুঝেছি যে এই তামসিক সুখ জীবনকে বিনষ্ট করে দেবে। রাতে শুতে যাওয়ার সময় এই কথাটি মনে মনে বলে যদি ঘুমোতে যান, তবে প্রাতঃকালে ঘড়ির অ্যালার্ম বাজার পাঁচ মিনিট আগেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমাদের মনের ভেতরের ঘণ্টা আমাদের জাগ্রত করে তোলে। এটি হলো সাত্ত্বিক সুখের অবস্থা। অ্যালার্ম বাজলে যদি আপনি উঠে পড়েন, তবে সেটা রাজসিক সুখের অবস্থা। অ্যালার্ম বেজে ওঠার পরেও যদি ঘুম না ভাঙে, তবে সেটা তামসিক সুখের অবস্থা। এভাবে আমাদের নিজেই নিজেকে যাচাই করতে হবে। প্রাতঃকালে চা খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন। কারণ খালি পেটে চা খেলে অ্যাসিডিটি হয়ে যায়। চেষ্টা করলে আমরা অবশ্যই এই অভ্যাসটিকে তিন দিনেই দমন করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের ভেতর থেকে জাগ্রত করে তোলে। কিছু কিছু মানুষ এটা জানে, কিন্তু মন থেকে তা মেনে নেয় না, তাদের উপলব্ধি শূন্য থাকে। আমরা যখন উপলব্ধি করতে শুরু করি তখনই আমরা এর মাহাত্ম্য জানতে শুরু করি।
প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং তার থেকে উৎপন্ন আমাদের স্বভাব এবং স্বভাবের সাথে আমাদের বর্ণ কিভাবে সম্পর্কিত থাকে? বাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র ইত্যাদি বর্ণ কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? এদের স্বভাব কি প্রকারের হয়? ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এই সম্পর্কে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন যা আমরা পরবর্তী বিবেচন সত্রে শুনবো। এর সাথেই বিবেচন সত্ৰ শেষ হয়। এর পর সাধকদের শঙ্কা ও সংশয়ের সমাধান করা হয়।
উত্তর -
মুনি - যিনি চিন্তন করেন, মনন করেন, এমন চিন্তক যিনি মৌন হয়ে যান, তিনিই মুনি। চিন্তন করতে করতে যিনি গভীরে চলে যান, তিনি নিজের সাথেই কথা বলেন। এই মৌনী থেকেই মুনি। মৌন অর্থাৎ বাহ্যিক কথোপকথন বন্ধ হয়ে যাওয়া।
আচার্য - যিনি নিজের আচরণের দ্বারাই অন্যকে শিক্ষা প্রদান করেন, তাকে আচার্য বলা হয়। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আচার্যকে দেখেই জীবনযাপন করার শ্রেষ্ঠ মার্গ কি হওয়া উচিত, তা মানুষ শিখে নিতে পারে।
ঋষি - যিনি স্বয়ং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তিনিই হলেন ঋষি। আমাদের সকল ঋষিরা অন্বেষক। তারা সবাই বিজ্ঞানী। অগস্ত্য ঋষি অনেক ধরনের অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। ঋষি অগস্ত্য একজন অনন্য অন্বেষণকারী ছিলেন। প্রভু শ্রী রাম যখন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন ঋষি অগস্ত্য আকাশ মার্গ থেকে তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
আদিত্য হৃদয় স্তোত্র-
ততো যুধপরিশ্রান্তম্ সমরে চিন্তয়া স্থিতম্।
রাবণ চাগ্রতো দৃষ্টয়া যুদ্ধায় সমুপস্থিতম্ ॥১॥
অগস্ত্য মুনি শ্রী রামকে যে উপদেশ দিয়েছেন, সেই আদিত্য হৃদয় স্তোত্রের মন্ত্রগুলি সঙ্কটের সময়ে পাঠ করা হয়।
মহর্ষি - একজন ঋষির চেয়ে বেশি জ্ঞানবান ব্যক্তি হলেন মহর্ষি। যারা ঋষিদের চেয়ে বেশি গবেষণা-বিশ্লেষণ ও পরীক্ষণ করেছেন, যারা অনেক এবং শ্রেষ্ঠ অন্বেষণ করেছেন, তারা হলেন মহর্ষি। আমাদের শাস্ত্রে প্রত্যেকটি কথার গভীর অর্থ আছে। কথাগুলির অর্থ, তাদের উৎপত্তি প্রক্রিয়ার তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায়।
প্রশ্নকর্তা- মিতা দিদি
প্রশ্ন- ব্যভিচারিণী বুদ্ধি ও অব্যভিচারিণী বুদ্ধি কাকে বলে?
উত্তরঃ স্বার্থ সহিত বুদ্ধি হলো ব্যভিচারিণী বুদ্ধি। স্বার্থ রহিত বুদ্ধি হলো অব্যভিচারিণী বুদ্ধি। সহজ ভাবে বোঝাতে হলে, যে বুদ্ধিতে স্বার্থ আছে তা ব্যভিচারিণী। যে বুদ্ধিতে নিঃস্বার্থ ভাব আছে তা অব্যভিচারিণী।
প্রশ্নকর্তা- মিতা দিদি
প্রশ্নঃ সাত্ত্বিক বুদ্ধি কিভাবে বজায় রাখা যায়?
উত্তর: বুদ্ধিকে স্থির করার জন্য দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে তার সমাধান দেওয়া হয়েছে। এর জন্য নিয়মিত অনুশীলন করে যাওয়া আবশ্যক। আমরা নিজের জীবনে কি প্রকার আচরণ করি ? কেউ আমাদের সাথে দেখা করতে এলে আমরা নিজের সমস্যার কথা বলতে শুরু করি। আমরা কি সুখে থাকি? নাকি থাকি না?? আমাদের চেহারায় কি ভাব ফুটে ওঠে ? এই সবই শুধুমাত্র অনুশীলনের মাধ্যমে করা যেতে পারে। এই সংসারে এমন কে আছে যার সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকে? খোঁজ করলে আমরা দেখতে পাই যে একমাত্র ভগবান শ্রী কৃষ্ণই আছেন, যাঁর মুখে সবসময় হাসি। আর কাউকে আমরা সবসময় হাসিমুখে থাকতে দেখিনি। অর্জুনের ওপর রাগ করার সময়ও কিন্তু ভগবান হাসছেন-
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত ॥
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ॥২.১০॥
আমাদের কি সবসময় কাঁদতে থাকার স্বভাব? নাকি হাসতে থাকার ? ভগবান বলেছেন, যে অনুশীলন করে যায়, সেই আমাকে প্রাপ্ত করতে পারবে -
অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্নোষি ময়ি স্থিরম্ ।
অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয় ॥১২.৯॥
অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন, মন তো সর্বদা চঞ্চল থাকে। কখনই স্থির হয় না। মনকে কিভাবে স্থির করা যাবে ?
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৬.৩৪॥
মন হলো বাতাসের মতো। একে কিভাবে ধরে রাখা যায়। ভগবান বললেন-
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৬.৩৫॥
ভগবান বলেন, হে অর্জুন তুমি অনুশীলন করে যাও। তুমি অনুশীলনের দ্বারা বৈরাগ্যও প্রাপ্ত করতে পারো। আমরা যদি অনুশীলন করতে থাকি, তাহলে আমাদের বুদ্ধিতে সাত্ত্বিকভাব থাকবে। যদি প্রথমে আমরা নিজের সাথেই হাসতে শিখি, তাহলে অন্যদের সাথেও হাসতে শিখে যাব। কেউ যদি আপনার সাথে কটু কথাও বলে, তবুও আপনি হাসিমুখেই তার সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাবেন। নিজের মুখের হাসি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করে দিন, যেন ভগবানের ন্যায় আমাদেরও মুখও সদাহাস্যময় থাকে।
মীরা হাসিমুখে বিষের পেয়ালা পান করেছিল, কারণ সে ভগবানের কথা বুঝতে পেরেছিল।
যত্তদগ্রে বিষমিব পরিণামেহমৃতোপমম্ ।
তৎসুখং সাত্ত্বিকং প্রোক্তমাত্মবুদ্ধিপ্রসাদজম্ ॥১৮.৩৭॥
মীরা বিষকে ভগবানের প্রসাদ ভেবে পান করেছিলেন। মীরার এই ভাবনা ও উপলব্ধিই বিষকে অমৃতে পরিণত করেছিল। মীরার অটল ভক্তির কারণেই ভগবান সেই বিষকে অমৃতে রূপান্তরিত করেছিলেন। আসুন, আমরা মীরার মতো অনুশীলন করি। আসুন শবরীর মত অনুশীলন করি। এত কিছু যদি করা সম্ভব না হয়, অন্তত একটু একটু করে অনুশীলন করা শুরু করুন। পরিবারের সবার সাথে হাসিখুশি থাকুন। অনুশীলনের মাধ্যমে এটি নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।
প্রশ্নকর্তা- সুশীলা দিদি
প্রশ্ন- বুদ্ধি ও ধৃতির মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তরঃ বুদ্ধি থাকে মস্তিষ্কে আর ধৃতি থাকে মনের মধ্যে। মন সিদ্ধান্ত নেয়। ধৃতি হলো উপলব্ধি করা। বাচ্চা লেখা-পড়া করে। লেখা-পড়া জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন। মন সিদ্ধান্ত নেয় যে এক জায়গায় বসে পড়াশুনো করতে হবে। কিন্তু মন স্থির হয়ে বসতে চায় না। এক ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বসে পড়তে হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া, এই হলো ধৃতি।
প্রশ্নকর্তা- শ্রী জক্কা শিবরাম দাস ভাইয়া
প্রশ্ন- ত্যাগ ও দানের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তরঃ দান করতে হলে, কোনো পার্থিব (জাগতিক) বস্তু দিতে হয়। ত্যাগ করতে হলে পার্থিব বস্তু না দিলেও হবে, মনের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। যেমন, চা খাওয়া ছেড়ে দেওয়া। এতে কোনো জাগতিক বস্তুর আদান-প্রদান হয়নি, শুধুমাত্র মন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে চা খাওয়া উচিত নয়। দান কাউকে না কাউকে দিতে হয়। দানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে-
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে ।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্ ॥১৭.২০॥
আপনার কাছে আছে, তাই আপনি দিয়েছেন। এটা হলো দান। আপনি কাউকে যেটা দেন নি, কিন্তু আপনি নিজেই সেটা ছেড়ে দিয়েছেন, এটি হলো ত্যাগ।
প্রশ্নকর্তা- কুমুদ দিদি
প্রশ্ন- দেহে আত্মা কোথায় স্থিত থাকে ?
উত্তর: দেহে আত্মার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। প্রদীপের জ্বালানার সাথে সাথে তার শিখা উপরে নীচে হতে থাকে। এইভাবেই আলো চারিদিকে ছাড়িয়ে পড়ে। একইভাবে শরীরের মধ্যে আত্মা উপরে নিচে নাড়াচাড়া করে শরীরকে জীবিত রাখে। যোগ সাধনার মাধ্যমে, আত্মাকে মুলাধর থেকে সহস্রার পর্যন্ত এনে কপালে ভ্রুযুগলের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। সাত্ত্বিকভাবের কারণে
আত্মা উপরের দিকে ওঠে এবং তামসিকতার কারণে নীচের দিকে নেমে যায়। কখনও কখনও এটি মল এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
প্রতিদিন সকালে প্রথমেই আমাদের মন ও বুদ্ধির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। বুদ্ধি বলে উঠতে, কিন্তু মন বলে ঘুমাতে। বুদ্ধি বলে—আমাদের ওঠা উচিত, মন বলে—আমাদের ঘুমানো উচিত এবং উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাঝে মাঝে মন বিজয়ী হয়। তখন আমরা ভাবি পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুমিয়ে নিই এবং ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা পার করে যায়। এটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। সেই দিনের সুখকে তামসিক সুখ বলে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করে আমরা এটা বুঝেছি যে এই তামসিক সুখ জীবনকে বিনষ্ট করে দেবে। রাতে শুতে যাওয়ার সময় এই কথাটি মনে মনে বলে যদি ঘুমোতে যান, তবে প্রাতঃকালে ঘড়ির অ্যালার্ম বাজার পাঁচ মিনিট আগেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমাদের মনের ভেতরের ঘণ্টা আমাদের জাগ্রত করে তোলে। এটি হলো সাত্ত্বিক সুখের অবস্থা। অ্যালার্ম বাজলে যদি আপনি উঠে পড়েন, তবে সেটা রাজসিক সুখের অবস্থা। অ্যালার্ম বেজে ওঠার পরেও যদি ঘুম না ভাঙে, তবে সেটা তামসিক সুখের অবস্থা। এভাবে আমাদের নিজেই নিজেকে যাচাই করতে হবে। প্রাতঃকালে চা খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন। কারণ খালি পেটে চা খেলে অ্যাসিডিটি হয়ে যায়। চেষ্টা করলে আমরা অবশ্যই এই অভ্যাসটিকে তিন দিনেই দমন করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের ভেতর থেকে জাগ্রত করে তোলে। কিছু কিছু মানুষ এটা জানে, কিন্তু মন থেকে তা মেনে নেয় না, তাদের উপলব্ধি শূন্য থাকে। আমরা যখন উপলব্ধি করতে শুরু করি তখনই আমরা এর মাহাত্ম্য জানতে শুরু করি।
প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং তার থেকে উৎপন্ন আমাদের স্বভাব এবং স্বভাবের সাথে আমাদের বর্ণ কিভাবে সম্পর্কিত থাকে? বাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র ইত্যাদি বর্ণ কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? এদের স্বভাব কি প্রকারের হয়? ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এই সম্পর্কে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন যা আমরা পরবর্তী বিবেচন সত্রে শুনবো। এর সাথেই বিবেচন সত্ৰ শেষ হয়। এর পর সাধকদের শঙ্কা ও সংশয়ের সমাধান করা হয়।
প্রশ্নোত্তর
প্রশ্নকর্তা- নমিতা যাদব দিদি
প্রশ্ন- ঋষি, মুনি, মহর্ষি ও আচার্যের মধ্যে পার্থক্য কী?উত্তর -
মুনি - যিনি চিন্তন করেন, মনন করেন, এমন চিন্তক যিনি মৌন হয়ে যান, তিনিই মুনি। চিন্তন করতে করতে যিনি গভীরে চলে যান, তিনি নিজের সাথেই কথা বলেন। এই মৌনী থেকেই মুনি। মৌন অর্থাৎ বাহ্যিক কথোপকথন বন্ধ হয়ে যাওয়া।
আচার্য - যিনি নিজের আচরণের দ্বারাই অন্যকে শিক্ষা প্রদান করেন, তাকে আচার্য বলা হয়। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আচার্যকে দেখেই জীবনযাপন করার শ্রেষ্ঠ মার্গ কি হওয়া উচিত, তা মানুষ শিখে নিতে পারে।
ঋষি - যিনি স্বয়ং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তিনিই হলেন ঋষি। আমাদের সকল ঋষিরা অন্বেষক। তারা সবাই বিজ্ঞানী। অগস্ত্য ঋষি অনেক ধরনের অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। ঋষি অগস্ত্য একজন অনন্য অন্বেষণকারী ছিলেন। প্রভু শ্রী রাম যখন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন ঋষি অগস্ত্য আকাশ মার্গ থেকে তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
আদিত্য হৃদয় স্তোত্র-
ততো যুধপরিশ্রান্তম্ সমরে চিন্তয়া স্থিতম্।
রাবণ চাগ্রতো দৃষ্টয়া যুদ্ধায় সমুপস্থিতম্ ॥১॥
অগস্ত্য মুনি শ্রী রামকে যে উপদেশ দিয়েছেন, সেই আদিত্য হৃদয় স্তোত্রের মন্ত্রগুলি সঙ্কটের সময়ে পাঠ করা হয়।
মহর্ষি - একজন ঋষির চেয়ে বেশি জ্ঞানবান ব্যক্তি হলেন মহর্ষি। যারা ঋষিদের চেয়ে বেশি গবেষণা-বিশ্লেষণ ও পরীক্ষণ করেছেন, যারা অনেক এবং শ্রেষ্ঠ অন্বেষণ করেছেন, তারা হলেন মহর্ষি। আমাদের শাস্ত্রে প্রত্যেকটি কথার গভীর অর্থ আছে। কথাগুলির অর্থ, তাদের উৎপত্তি প্রক্রিয়ার তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায়।
প্রশ্নকর্তা- মিতা দিদি
প্রশ্ন- ব্যভিচারিণী বুদ্ধি ও অব্যভিচারিণী বুদ্ধি কাকে বলে?
উত্তরঃ স্বার্থ সহিত বুদ্ধি হলো ব্যভিচারিণী বুদ্ধি। স্বার্থ রহিত বুদ্ধি হলো অব্যভিচারিণী বুদ্ধি। সহজ ভাবে বোঝাতে হলে, যে বুদ্ধিতে স্বার্থ আছে তা ব্যভিচারিণী। যে বুদ্ধিতে নিঃস্বার্থ ভাব আছে তা অব্যভিচারিণী।
প্রশ্নকর্তা- মিতা দিদি
প্রশ্নঃ সাত্ত্বিক বুদ্ধি কিভাবে বজায় রাখা যায়?
উত্তর: বুদ্ধিকে স্থির করার জন্য দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে তার সমাধান দেওয়া হয়েছে। এর জন্য নিয়মিত অনুশীলন করে যাওয়া আবশ্যক। আমরা নিজের জীবনে কি প্রকার আচরণ করি ? কেউ আমাদের সাথে দেখা করতে এলে আমরা নিজের সমস্যার কথা বলতে শুরু করি। আমরা কি সুখে থাকি? নাকি থাকি না?? আমাদের চেহারায় কি ভাব ফুটে ওঠে ? এই সবই শুধুমাত্র অনুশীলনের মাধ্যমে করা যেতে পারে। এই সংসারে এমন কে আছে যার সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকে? খোঁজ করলে আমরা দেখতে পাই যে একমাত্র ভগবান শ্রী কৃষ্ণই আছেন, যাঁর মুখে সবসময় হাসি। আর কাউকে আমরা সবসময় হাসিমুখে থাকতে দেখিনি। অর্জুনের ওপর রাগ করার সময়ও কিন্তু ভগবান হাসছেন-
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত ॥
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ॥২.১০॥
আমাদের কি সবসময় কাঁদতে থাকার স্বভাব? নাকি হাসতে থাকার ? ভগবান বলেছেন, যে অনুশীলন করে যায়, সেই আমাকে প্রাপ্ত করতে পারবে -
অথ চিত্তং সমাধাতুং ন শক্নোষি ময়ি স্থিরম্ ।
অভ্যাসযোগেন ততো মামিচ্ছাপ্তুং ধনঞ্জয় ॥১২.৯॥
অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন, মন তো সর্বদা চঞ্চল থাকে। কখনই স্থির হয় না। মনকে কিভাবে স্থির করা যাবে ?
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ ৷
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৬.৩৪॥
মন হলো বাতাসের মতো। একে কিভাবে ধরে রাখা যায়। ভগবান বললেন-
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ৷
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে ॥৬.৩৫॥
ভগবান বলেন, হে অর্জুন তুমি অনুশীলন করে যাও। তুমি অনুশীলনের দ্বারা বৈরাগ্যও প্রাপ্ত করতে পারো। আমরা যদি অনুশীলন করতে থাকি, তাহলে আমাদের বুদ্ধিতে সাত্ত্বিকভাব থাকবে। যদি প্রথমে আমরা নিজের সাথেই হাসতে শিখি, তাহলে অন্যদের সাথেও হাসতে শিখে যাব। কেউ যদি আপনার সাথে কটু কথাও বলে, তবুও আপনি হাসিমুখেই তার সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাবেন। নিজের মুখের হাসি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করে দিন, যেন ভগবানের ন্যায় আমাদেরও মুখও সদাহাস্যময় থাকে।
विष को प्यालो राणा भेज्यो,
पीवत मीरा हाँसी रे।
মীরা হাসিমুখে বিষের পেয়ালা পান করেছিল, কারণ সে ভগবানের কথা বুঝতে পেরেছিল।
যত্তদগ্রে বিষমিব পরিণামেহমৃতোপমম্ ।
তৎসুখং সাত্ত্বিকং প্রোক্তমাত্মবুদ্ধিপ্রসাদজম্ ॥১৮.৩৭॥
মীরা বিষকে ভগবানের প্রসাদ ভেবে পান করেছিলেন। মীরার এই ভাবনা ও উপলব্ধিই বিষকে অমৃতে পরিণত করেছিল। মীরার অটল ভক্তির কারণেই ভগবান সেই বিষকে অমৃতে রূপান্তরিত করেছিলেন। আসুন, আমরা মীরার মতো অনুশীলন করি। আসুন শবরীর মত অনুশীলন করি। এত কিছু যদি করা সম্ভব না হয়, অন্তত একটু একটু করে অনুশীলন করা শুরু করুন। পরিবারের সবার সাথে হাসিখুশি থাকুন। অনুশীলনের মাধ্যমে এটি নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।
প্রশ্ন- বুদ্ধি ও ধৃতির মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তরঃ বুদ্ধি থাকে মস্তিষ্কে আর ধৃতি থাকে মনের মধ্যে। মন সিদ্ধান্ত নেয়। ধৃতি হলো উপলব্ধি করা। বাচ্চা লেখা-পড়া করে। লেখা-পড়া জন্য বুদ্ধির প্রয়োজন। মন সিদ্ধান্ত নেয় যে এক জায়গায় বসে পড়াশুনো করতে হবে। কিন্তু মন স্থির হয়ে বসতে চায় না। এক ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বসে পড়তে হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া, এই হলো ধৃতি।
প্রশ্নকর্তা- শ্রী জক্কা শিবরাম দাস ভাইয়া
প্রশ্ন- ত্যাগ ও দানের মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তরঃ দান করতে হলে, কোনো পার্থিব (জাগতিক) বস্তু দিতে হয়। ত্যাগ করতে হলে পার্থিব বস্তু না দিলেও হবে, মনের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। যেমন, চা খাওয়া ছেড়ে দেওয়া। এতে কোনো জাগতিক বস্তুর আদান-প্রদান হয়নি, শুধুমাত্র মন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে চা খাওয়া উচিত নয়। দান কাউকে না কাউকে দিতে হয়। দানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে-
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে ।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্ ॥১৭.২০॥
আপনার কাছে আছে, তাই আপনি দিয়েছেন। এটা হলো দান। আপনি কাউকে যেটা দেন নি, কিন্তু আপনি নিজেই সেটা ছেড়ে দিয়েছেন, এটি হলো ত্যাগ।
প্রশ্নকর্তা- কুমুদ দিদি
প্রশ্ন- দেহে আত্মা কোথায় স্থিত থাকে ?
উত্তর: দেহে আত্মার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। প্রদীপের জ্বালানার সাথে সাথে তার শিখা উপরে নীচে হতে থাকে। এইভাবেই আলো চারিদিকে ছাড়িয়ে পড়ে। একইভাবে শরীরের মধ্যে আত্মা উপরে নিচে নাড়াচাড়া করে শরীরকে জীবিত রাখে। যোগ সাধনার মাধ্যমে, আত্মাকে মুলাধর থেকে সহস্রার পর্যন্ত এনে কপালে ভ্রুযুগলের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। সাত্ত্বিকভাবের কারণে
আত্মা উপরের দিকে ওঠে এবং তামসিকতার কারণে নীচের দিকে নেমে যায়। কখনও কখনও এটি মল এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।