विवेचन सारांश
শরীর ও শরীরী
দীপ প্রজ্জ্বলন, প্রার্থনা এবং সমস্ত দেবতাদের ও গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে আজকের বিবেচন সত্রের শুভারম্ভ হয়। আজ আহমেদাবাদে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝে বিশ্বকাপের ফাইনাল ক্রিকেট খেলা আর এই বিবেচন সত্রের আলোচ্য বিষয় কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে মহাভারতের ধর্মযুদ্ধ। বিশ্বকাপ ক্রিকেট-ফাইনালের খেলার মোহ ত্যাগ করে এই সত্রে উপস্থিত সমস্ত সাধকদের আজ বিশেষরূপে আন্তরিক অভিনন্দন।
গত সপ্তাহের বিবেচনা সত্রে আমরা দেখেছি যে অর্জুন বিষাদগ্রস্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবানকে জানিয়েছেন যে তিনি যুদ্ধ করবেন না। নিজের আত্মীয়স্বজন, পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য আদি নিজের প্রিয়জনদের হত্যা করে রাজ্যলাভের ইচ্ছা তাঁর নেই। প্রথম অধ্যায়ে অর্জুন বলেছেন–
না কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।।১.৩২।।
অর্থ হল – ”হে কৃষ্ণ, আমি বিজয় চাই না, রাজ্যও চাই না এবং সুখভোগও চাই না। আমাদের রাজ্যে কী লাভ? ভোগে কী লাভ এবং বেঁচে থেকেই বা কি লাভ?”
প্রিয়জনদের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেই অর্জুন মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধ করা যে ক্ষত্রিয়-ধর্ম, সেই বিচারও তাঁর লোপ পেয়েছিল। তামসিক ভাবগ্রস্থ অর্জুনের রাজসিক ভাব জাগৃত করার উদ্দেশ্যে ভগবান তাঁর প্রিয় সখাকে ক্ষত্রিয়োচিত তিরস্কার করার পর অর্জুন ভগবানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর শরণাগত হলেন এবং নিজের কল্যাণহেতু শিক্ষা প্রদানের অনুরোধ করলেন।
শিষ্যরূপে জিজ্ঞাসু না হলে সদ্গুরু তত্ত্বোপদেশ দেন না। প্রথম অধ্যায়ে ভগবান কোনো কথা বলেন নি। অর্জুন বলেছেন এবং তিনি শুনেছেন। অর্জুন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে,শরণাগত হয়ে উপদেশ চাইলে ভগবান মৃদু হেসে এই অধ্যায়ে তাঁর কথা শুরু করেছেন।
গীতার সাংখ্যযোগ অর্থাৎ এই অধ্যায় অতীব সুন্দর। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সার সূত্রাকারে এই অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে।
কিছু জ্ঞানীজনের মতে রণাঙ্গণে ভগবান অর্জুনকে কেবলমাত্র দ্বিতীয় অধ্যায় বলেছিলেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সার কথাসমূহ মহর্ষি বেদব্যাস গীতার অন্যান্য অধ্যায়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সেই ধারণা ভুল। যে কোন বিষয়ের সার কথাসমূহ প্রথমে সংক্ষেপে বলার পর বিশদভাবে সব কিছু আলোচনা করা এবং পরিশেষে সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তিই প্রকৃত শিক্ষাদানের নিয়ম। গীতায় সেটিই পরিলক্ষিত হয়েছে।
এই অধ্যায়ের দশম শ্লোকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন—
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ।।২.১০।।
অর্থাৎ “হে ভরত (ধৃতরাষ্ট্র)! দুই সেনার মধ্যস্থলে বিষাদমগ্ন সেই অর্জুনকে ভগবান হৃষিকেশ মৃদু হেসে এই কথা বললেন।”
যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের বিষাদগ্রস্থ ভাব এক প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, তথাপি ভগবান প্রসন্নচিত্তে মৃদু হেসে অর্জুনের সাথে কথা বলেছেন। এই পরিস্থিতিতে ভগবানের প্রসন্নভাব আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে জীবনের প্রতিকূল অবস্থাতেও মনের প্রসন্নতা যেন অটুট থাকে। গীতার মাধ্যমে আমরা এই শিক্ষা পাই যে জীবনে যতই কঠিন পরিস্থিতি আসুক না কেন, মুখের হাসি ও মনের প্রসন্নতা যেন কখনও হারিয়ে না যায়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ জেনেও যুদ্ধ নিবারণার্থে চেষ্টা করেছিলেন– তিনি স্বয়ং দূত হয়ে হস্তিনাপুর গিয়েছিলেন। পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দেবার প্রস্তাব তিনি দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন, এমনকি তিনি এই প্রস্তাবও দিয়েছিলেন যে পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দিলেও তিনি এই যুদ্ধকে হতে দেবেন না। এর জবাবে দাম্ভিক দুর্যোধন বলেছিলেন,”বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচ্যাগ্র মেদিনী”
এই প্রসঙ্গে শ্রী রামধারী সিং দিনকর হিন্দীতে একটি খুব সুন্দর কবিতা লিখেছেন–
বর্ষো তক বন মে ঘূম -ঘূম,
বাধা –বিঘ্নো কো চুম -চুম,
সহ ধূপ-ঘাম, পানী-পত্থর,
পাণ্ডব আয়ে কুছ ঔর নিখর।
সৌভাগ্য ন সব দিন সোতা হ্যায়,
দেখে আগে ক্যা হোতা হ্যায়।।
মৈত্রী কী রাহ বতানে কো,
সবকো সুমার্গ পর লানে কো,
দুর্যোধন কো সমঝানে কো,
ভীষণ বিধ্বংস বচানে কো,
ভগবান হস্তিনাপুর আয়ে,
পাণ্ডব কা সন্দেশা লায়ে।
‘দো ন্যায় অগর তো আধা দো,
পর,ইসমে ভী যদি বাধা হো,
তো দে দো কেবল পাঁচ গ্রাম,
রকখো অপনি ধরতী তমাম।
হম ওহী খুশী সে খায়েঙ্গে,
পরিজন পর অসি ন উঠায়েঙ্গে!’
দুর্যোধন ওহ ভী দে না সকা,
আশীষ সমাজ কী লে না সকা,
উল্টে, হরি কো বাঁধনে চলা,
জো থা অসাধ্য, সাধনে চলা।
জব নাশ মনুজ পর ছাতা হ্যায়,
পহলে বিবেক মর জাতা হ্যায়।।
হরি নে ভীষণ হুঙ্কার কিয়া,
অপনে স্বরূপ বিস্তার কিয়া,
ডগমগ-ডগমগ দিগ্গজ ডোলে,
ভগবান কুপিত হোকর বোলে-
‘জঞ্জীর বঢ়া কর সাধ মুঝে,
হাঁ, হাঁ দুর্যোধন বাঁধ মুঝে।
য়হ দেখ, গগন মুঝমে লয় হ্যায়,
য়হ দেখ, পবন মুঝমে লয় হ্যায়,
মুঝমে বিলীন ঝংকার সকল,
মুঝমে লয় হ্যায় সংসার সকল।
অমরত্ব ফুলতা হ্যায় মুঝমে,
সংহার ঝুলতা হ্যায় মুঝমে।।
‘উদয়াচল মেরা দীপ্ত ভাল,
ভুমণ্ডল বক্ষস্থল বিশাল,
ভুজ পরিধি-বন্ধ কো ঘেরে হ্যায়,
মৈনাক-মেরু পগ মেরে হ্যায়।
দিপতে জো গ্রহ নক্ষত্র নিকর,
সব হে মেরে মুখ কে অন্দর।
‘দৃগ হো তো দৃশ্য অকাণ্ড দেখ,
মুঝমে সারা ব্রহ্মাণ্ড দেখ,
চর -অচর জীব,জগ ,ক্ষর-অক্ষর,
নশ্বর মনুষ্য সুরজাতি অমর।
শত কোটি সূর্য, শত কোটি চন্দ্র,
শত কোটি সরিত, সর ,সিন্ধু মন্দ্র।
‘শত কোটি বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ
শত কোটি জিষ্ণু, জলপতি, ধনেশ,
শত কোটি রুদ্র, শত কোটি কাল,
শত কোটি দণ্ডধর লোকপাল।
জঞ্জীর বঢ়াকর সাধ ইন্হে,
হাঁ –হাঁ দুর্যোধন বাঁধ ইন্হে।
‘ভূলোক, অতল, পাতাল, দেখ,
গত ঔর অনাগত কাল দেখ,
য়ে দেখ জগৎ কে আদি-সৃজন,
য়ে দেখ, মহাভারত কা রণ,
মৃতকো সে পাটী হুই ভূ হ্যায়,
পেহচান, ইসমে কাহাঁ তু হ্যায়।
‘অম্বর মে কুন্তল-জাল দেখ,
পদ কে নীচে পাতাল দেখ,
মুট্ঠী মে তীনো কাল দেখ,
মেরে শরীর বিকরাল দেখ।
সব জন্ম মুঝী সে পাতে হ্যায়,
ফির লৌট মুঝী মে আতে হ্যায়।
‘জিহ্বা সে কঢ়তী জ্বাল সধন,
সাঁসো মে পাতা জন্ম পবন,
পড় জাতী মেরী দৃষ্টি জিধর,
হঁসনে লগতী হে সৃষ্টি উধর,
মে জভী মূঁদতা হূঁ লোচন,
ছা জাতা চারো ঔর মরণ।
‘বাঁধনে মুঝে তো আয়া হে,
জঞ্জীর বড়ী ক্যা লায়া হে,
যদি মুঝে বাঁধনা চাহে মন,
পহলে তো বাঁধ অনন্ত গগন।
সূনে কো সাধ ন সকতা হ্যায়,
ওহ মুঝে বাঁধ কব সকতা হে?’
হিত -বচন নহী তুনে মানা,
মৈত্রী কা মূল্য ন পহচানা,
তো লে , মে ভী অব জাতা হূঁ,
অন্তিম সঙ্কল্প সুনাতা হূঁ।
যাচনা নহী, অব রণ হোগা,
জীবন-জয় য়া কী মরণ হোগা
টকরায়েঙ্গে নক্ষত্র-নিকর,
বরসেগী ভূ পর বহ্নি প্রখর,
ফণ শেষনাগ কা ডালেগা,
বিকরাল কাল মুঁহ খোলেগা।
দুর্যোধন! রণ এইসা হোগা।
ফির কভী নহী জৈসা হোগা।
ভাই পর ভাই টুটেঙ্গে,
বিষ-বাণ বূঁদ সে ছুটেঙ্গে,
বায়স-শৃগাল সুখ লূটেঙ্গে।
সৌভাগ্য মনুজ কে ফুটেঙ্গে।
আখির তু ভূশায়ী হোগা,
হিংসা কা পর, দায়ী হোগা।
থী সভা সন্ন, সব লোক ডরে,
চুপ থে য়া থে বেহোশ পড়ে।
কেৱল দো নর না অধাতে হ্যায়,
ধৃতরাষ্ট্র-বিদুর সুখ পাতে হ্যায়।
কর জোড় খড়ে প্রমুদিত,
নির্ভয়, দোনো পুকারতে থে ‘জয়-জয়’
এই কবিতার তাৎপর্য্য হল— পাণ্ডবরা বনবাস ও অজ্ঞাতবাস শেষ করে ফিরে আসার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হস্তিনাপুর গিয়ে দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে দুর্যোধন যদি শুধু পাঁচটি গ্রামও পাণ্ডবদের দেয়, তাহলে পাণ্ডবরা এই যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবেন। দুর্যোধন দম্ভের বশবর্তী হয়ে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং সভায় সবার উপস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণকে বন্দী করার আদেশ দেয়। ক্রোধান্বিত ভগবান তখন দুর্যোধনকে তাঁর বিরাটরূপ দেখান এবং কৌরববংশের বিনাশের ঘোষণা করে আসেন।
মহাভারতের যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্জুন সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধার্থে উদ্যোগী ছিলেন, যুদ্ধের কর্তব্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সেই যুদ্ধ যখন আসন্ন, তখন সম্মুখ-সমরে স্বীয় আত্মীয়-প্রিয়জনদের দেখে অর্জুন বিষাদগ্রস্থ হয়েছিলেন এবং যুদ্ধের অকর্তব্যতা প্রতিবেদন করতে উন্মুখ হয়েছিলেন। তাই ভগবান মৃদু হেসে অর্জুনকে তাঁর অলৌকিক উপদেশ প্রদান করা আরম্ভ করলেন।
2.11
শ্রীভগবানুবাচ
অশোচ্য়ানন্বশোচস্ত্বং(ম্), প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে
গতাসূনগতাসূংশ্চ, নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ॥11॥
ভগবান অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে তাঁর এই মোহ কোথা হতে উৎপন্ন হয়েছে? যাদের জন্য শোক করা উচিত নয়, তাদের জন্য অর্জুন কেন শোকাগ্রস্থ ? ভগবান মৃদু হেসে বলেছেন যে অর্জুনের এই কথাগুলো জ্ঞানীর ভাষায় মূর্খের কথা। অর্জুন যদিও পন্ডিতদের মত কথা বলছেন কিন্তু পন্ডিত ব্যক্তিগণ মৃত বা জীবিত– কারও জন্য শোক করেন না।
অর্জুনের এই মোহ দূরীকরণের চেষ্টাতেই গীতশাস্ত্রের উদ্ভব। অর্জুনের মোহকে উপলক্ষ করে ভগবান সমগ্র মানবজাতিকে অশেষ কল্যাণকর এই অভূতপূর্ব ধর্মতত্ত্ব উপহার দিয়েছেন।
মানুষের মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে; শরীর এবং শরীরী। এই দুটি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কবর্জিত। দুইয়ের স্বভাবও পৃথক। একটি জড়, অপরটি চেতন। একটি বিনাশশীল, অন্যটি অবিনাশী। একটি বিকারশীল, অপরটি নির্বিকার।
গীতার উপদেশ আরম্ভ হয়েছে শরীর ও শরীরীর পার্থক্য নিয়ে। শরীর সর্বক্ষণ ক্ষয় হয়, সদাই পরিবর্তনশীল; তাই শরীরের জন্য শোক করা উচিত নয়। শরীরী বা দেহী অবিনশ্বর, অপরিবর্তনশীল। সাধক যদি তাঁর কল্যাণ কামনা করেন তাহলে সর্বপ্রথম জানতে হবে “আমি কে?” অর্জুনও তাঁর কল্যাণের উপায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন। দেহ এবং দেহীর পার্থক্য মেনে নিলেই কল্যাণ হওয়া সম্ভব।
যতক্ষণ পর্যন্ত “আমি দেহ”-- এই ধারণা থাকবে, ততক্ষণ যতই উপদেশ শোনা যাক, শোনানো যাক কোনো কল্যাণ হবে না।
ন ত্বেবাহং(ঞ্)জাতু নাসং(ন্),ন ত্বং(ন্)নেমে জনাধিপাঃ
ন চৈব ন ভবিষ্য়ামঃ(স্), সর্বে বয়মতঃ(ফ্) পরম্ ॥12॥
পূর্ববর্তী শ্লোকে ভগবান বলেছিলেন যে তত্ত্বজ্ঞানীরা মৃত বা জীবিত—কারও জন্য শোক করেন না। মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে —কেন করেন না? কারণ হল– দেহী অর্থাৎ আত্মা নিত্য,অবিনশ্বর। সেই অর্থে কারও মৃত্যু হয় না। শরীর অনিত্য এবং বিনাশশীল। নিত্য কিরূপ? যা আগে ছিল, এখন আছে এবং পরেও থাকবে।
শ্রদ্ধেয় জ্ঞানেশ্বর মহারাজ খুব সুন্দর ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। পুকুরে জলের ঢেউয়ের মত আমাদের জীবন। যখন বাতাস জোরে বইতে থাকে, তখন জলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। হাওয়ার সাথে সাথে ঢেউ কখনো উপরে উঠে আবার সেই ঢেউ নীচে নেমে জলের সাথে মিলিয়ে যায়। বাতাসের সাথে সাথে যদিও ঢেউয়ের উঠা-নামার খেলা চলতে থাকে এবং একসময় বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু জল অপরিবর্তিত থাকে। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জলের ঢেউকে দেহ এবং জলকে আত্মার সাথে তুলনা করেছেন। আমাদের শরীরও অনিত্য অর্থাৎ পরিবর্তনশীল। দেহ জীর্ণ হলে তার নাশ হয় এবং পঞ্চতত্ত্বে বিলীন হয়ে যায়। মৃত্যু অর্থ দেহের নাশ, আত্মা জন্মমৃত্যুরহিত। আত্মার পক্ষে জন্ম হল দেহ-গ্রহণ, মৃত্যু হল দেহান্তর-প্রাপ্তি। দেহান্তর-প্রাপ্তি মানে অবস্থার পরিবর্তন মাত্র, বিনাশ নহে।
দেহিনোऽস্মিন্য়থা দেহে, কৌমারং(য়্ঁ) যৌবনং(ঞ্) জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তি:(র্), ধীরস্তত্র ন মুহ্য়তি॥2.13॥
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিঃ — শরীরের যেমন বাল্য, যৌবনাদি অবস্থা প্রাপ্ত হয়, দেহান্তরপ্রাপ্তি বা দ্বিতীয় শরীরপ্রাপ্তিও তেমনই ঘটনা।শরীরের অবস্থার পরিবর্তনে যেমন কখনো কেউ শোক করে না, তেমনই শরীরী অর্থাৎ আত্মা যখন এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যায়, তখন সেই বিষয়েও শোক করা উচিত নয়।
ভগবান বলেছেন যে মৃত্যু অর্থ দেহান্তর-প্রাপ্তি। এই দেহান্তরপ্রাপ্তি অর্থাৎ আত্মার নতুন শরীর ধারণ করা নিয়ে ধীর ব্যক্তিগণ যাঁরা দেহ এবং আত্মার পার্থক্য জানেন, তাঁরা কখনও মোহগ্রস্থ হন না।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে অনেকেই হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আলাউদ্দিন খিলজি যখন রাজস্থান আক্রমণ করে এবং পদ্মিনীকে নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তখন রানী পদ্মিনী হাজার হাজার নারীর সাথে আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব ছত্রপতি সম্ভাজি মহারাজকে অনেক অত্যাচার করেছিলো এবং তাকে ধর্মান্তরিত করার অনেক চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সম্ভাজি মহারাজ মাথা নত করেননি এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। মৃত্যকে স্বেচ্ছায় বরণ করেছিলেন।গুরু গোবিন্দ সিংয়ের বড় দুই ছেলে অজিত সিং এবং জুজর সিং মুঘলদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর অপর দুই সন্তান জোরাবর সিং এবং ফতেহ সিং ঠাকুরমা গুজরি দেবীর সাথে বন্দী হন। গুজরি দেবীর নিকট এই দুই সাহসী বালক সদাই বীরত্বের গল্প শুনতেন। গুজরি দেবীর মৃত্যদণ্ড হয়েছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় এই দুই নাবালককে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল এবং হাসিমুখে তাঁরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয়,শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ
আগমাপায়িনোऽনিত্য়া:(স্), তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত॥14॥
‘মাত্রাস্পর্শাঃ’ — যার দ্বারা মাপজোপ করা হয় অর্থাৎ যার সাহায্যে মানুষের অনুভূতি হয়, সেই জানার যন্ত্র অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ এবং অন্তঃকরণের নাম হচ্ছে মাত্রা। মাত্রার দ্বারা অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ এবং অন্তঃকরণের দ্বারা বিষয়ের সাথে সংযোগকে বলা হয় স্পর্শ।
'শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ' — এখানে শীত ও উষ্ণ শব্দ দুটি অনুকূল ও প্রতিকূলের বাচক। যা আমরা চাই, এইরূপ অনুকূল বস্তু, ব্যক্তি, পরিস্থিতি, দেশ, কাল ইত্যাদি পাওয়া গেলে সুখ অনুভব হয় এবং যা আমরা চাই না, এইরূপ প্রতিকূল বস্তু, ব্যক্তি, পরিস্থিতি ইত্যাদি প্রাপ্ত হলে দুঃখ অনুভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই পদার্থগুলোর সুখ-দুঃখ দেবার সামর্থ নেই। মানুষ এসব পদার্থের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এতে অনুকূলতা ও প্রতিকূলতার চিন্তা করে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে , যার ফলে এই পদার্থগুলোকে সুখ ও দুঃখদায়ক বলে ভ্রম হয়।
'আগমাপায়িনঃ' – পদার্থমাত্রই আদি-অন্ত বিশিষ্ট, উৎপত্তি-বিনাশশীল এবং সংযোগ-বিয়োগশীল। এগুলোর স্থিতি নেই কারণ এগুলো উৎপত্তি হওয়ার পূর্বে ছিল না এবং বিনাশের পরেও থাকবে না।এরা প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তনশীল, বিনাশশীল এবং অনিত্য। শুধু এই পদার্থগুলোই অনিত্য ও পরিবর্তনশীল তা নয়, যার দ্বারা এই পদার্থগুলোকে জানা যায়, সেই ইন্দ্রিয়সমূহ এবং অন্তকরণও পরিবর্তনশীল এবং অনিত্য।
'তাংস্তিতিক্ষস্ব' — ইন্দ্রিয়াদি বিষয়ের সাথে সম্পর্ককালে যে অনুকূল বা প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটি দোষের নয়, কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য অন্তঃকরণে সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, শীতোষ্ণ আদি বিকার উৎপন্ন হওয়াই দোষের। সুতরাং অনুকূল-প্রতিকূলতার ধারণা হলেও এই ধরণের বিকার উৎপন্ন হতে না দেওয়া অর্থাৎ নির্বিকার থাকাই হচ্ছে সহ্য করা। এই সহ্য করাকেই বলা হয় তিতিক্ষা।
শরীরে ঠান্ডা জলের স্পর্শে শীতের অনুভূতি হয়, ইহা অনিত্য। এটি সহ্য করার অভ্যাস করলেই আর কষ্ট হয় না ।স্বজনাদি-বিয়োগজনিত দুঃখও তদ্রূপ অনিত্য। তাই এতে বিচলিত না হয়ে সহ্য করার উপদেশ ভগবান অর্জুনকে দিয়েছেন।
য়ং(ম্) হি ন ব্য়থয়ন্ত্য়েতে, পুরুষং(ম্) পুরুষর্ষভ
সমদুঃখসুখং(ন্) ধীরং(ম্), সোऽমৃতত্বায় কল্পতে॥15॥
‘সমদুঃখসুখং ধীরম’— জীবনে ধীর অর্থাৎ স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টা আমাদের করা উচিত, কারণ ধীর ব্যক্তিগণ সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন হন। যিনি সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন, তিনি অমৃতত্ত্ব লাভ করেন।
বাস্তবিক ক্ষেত্রে বিষয়ের স্পর্শে সুখদুঃখ ইত্যাদি দ্বন্দ্ব আসে। সংসারে বিষয়-আশয়ের মাঝে থেকে এই বর্জন করা খুব কঠিন। তাহলে মানুষের কর্তব্য কী ? আসক্তি ত্যাগ, কামনা-বাসনা ত্যাগই এর একমাত্র সমাধান যা ভগবদ্গীতা শিক্ষা দেয়। যিনি ভগবানের শরণাগত এবং গীতার উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন, তিনি জীবনের প্রতিটি অবস্থায় সমভাবে স্থির থাকেন।
‘য়ং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষম’ — স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মাত্রাস্পর্শ অর্থাৎ প্রকৃতির পদার্থ ব্যাথা দেয় না। সমতার দিকে দৃষ্টি থাকাতে তাঁকে এইসকল প্রকৃত পদার্থ সুখী বা দুঃখী করতে সক্ষম হয় না। সমতার প্রতি দৃষ্টি থাকায় অনুকূলতার জন্য সেই সুখ অনুভূত হলেও তার ভোগ না হওয়ায় অন্তঃকরণে সেই সুখের স্থায়ীভাবে কোন ছাপ পড়ে না। ঠিক সেরূপ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে সেই দুঃখ অনুভূত হলেও তার ভোগ না হওয়ায় অন্তঃকরণে সেই দুঃখ স্থায়ীভাবে কোনো ছাপ ফেলতে পারে না। এইভাবে সুখ ও দুঃখের কোনো ছাপ অন্তঃকরণে না পড়ায় সে ব্যথিত হয় না অর্থাৎ হৃদয়ে সুখ বা দুঃখের জ্ঞান হলেও সে স্বয়ং সুখী বা দুঃখী হয় না।
‘সোऽমৃতত্বায় কল্পতে’ — ভগবান বলেছেন যে এইরূপ ধীর ব্যক্তি অমৃতত্বলাভ অর্থাৎ অমরত্বপ্রাপ্তির যোগ্য হন। অমৃতত্ব অর্থে ভগবান কি বোঝাতে চেয়েছেন? এই স্থুল শরীর নিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকাকে অমৃতত্ব বা অমরত্ব বলে না, কারণ এটি সম্ভব নয়। ভৌতিক দেহ বিনাশশীল, মৃত্যুর অধীন। মৃত্যুর পর সূক্ষ্ম শরীরে বিদ্যমান থাকাও অমৃতত্ব নয়, কারণ মৃত্যুর পর সবাই সেইভাবে বিদ্যমান থাকে এবং পুনরায় নতুন দেহ ধারণ করে। জন্ম-মৃত্যুর চক্র হতে নিষ্কৃতি লাভই অমৃতত্ব যাকে মোক্ষ বলা হয়। শরীরী অর্থাৎ আত্মা এবং শরীর উভয়ই পৃথক , এই জ্ঞানলাভের নামই অমৃতত্ব লাভ।
নাসতো বিদ্য়তে ভাবো, নাভাবো বিদ্য়তে সতঃ
উভয়োরপি দৃষ্টোऽন্ত:(স্),ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ॥16॥
ভগবান এখানে অনিত্য বস্তুকে অসৎ এবং নিত্য বস্তুকে সৎ বলেছেন। তিনি বলেছেন যে তত্ত্বদর্শী মহাপুরুষগণ এই দুটিই অনুভব করেছেন। ভগবান এখানে দেহ এবং আত্মাকে ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেছেন।
‘নাসতো বিদ্যতে ভাবঃ’ — জন্মের আগে এই শরীর ছিল না, মৃত্যুর পরেও থাকবে না এবং বর্তমানেও প্রতি মুহূর্তে তা লয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এই কথার অর্থ হল যে অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান– এই তিন কালে দেহ কখনই স্থায়ীরূপে বা একরূপে থাকে না। সুতরাং এই দেহ অসৎ। একইভাবে এই জগৎসংসারের কোন স্থায়িত্ব নেই, তাই এটিও অসৎ। শরীর হল জগৎসংসারের একটি প্রতীক; সেইজন্য শরীরের পরিবর্তনের দ্বারা জগৎসংসারমাত্রই যে পরিবর্তনশীল সেটি বলা হয়েছে।
‘নাভাবো বিদ্যতে সতঃ’ — যেটি সৎ বস্তু, তার লয় হয় না অর্থাৎ দেহ যখন উৎপন্ন হয়নি, তখনও দেহী অর্থাৎ আত্মা ছিল এবং দেহ নাশ হলেও দেহী থাকবে। এমনকী বর্তমানে দেহ পরিবর্তিত হলেও দেহী একই ভাবে দেহতে বিরাজ করে। এই নিয়মেই জগৎসংসার যখন সৃষ্টি হয়নি, তখনও পরমাত্মতত্ত্ব ছিল, জগৎ লয়প্রাপ্ত হলেও পরমাত্মতত্ত্ব থাকবে এবং বর্তমানে পরিবর্তনশীল জগতে পরমাত্মতত্ত্ব যেমন, তেমনি রয়েছে।
‘উভয়োরপি দৃষ্টোऽন্তঃ(স্) ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ’ — অস্তিত্ব মাত্রেই ‘সৎ’ এবং অস্তিত্ব ব্যতীত যা কিছু প্রকৃতি এবং প্রকৃতির কার্যাদি আছে, সেগুলো সব ‘অসৎ’ অর্থাৎ পরিবর্তনশীল। এই দুটি অর্থাৎ সৎ-অসৎ, দেহী -দেহের তত্ত্ব অনুভবকারী মহাপুরুষগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে শুধুমাত্র সৎ-তত্ত্বই বিদ্যমান।
অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি, য়েন সর্বমিদং(ন্) ততম্
বিনাশমব্য়য়স্য়াস্য়, ন কশ্চিত্কর্তুমর্হতি॥17॥
ভগবান বলেছেন যে এই জগৎসংসার যদিও পরিবর্তনশীল কিন্তু যিনি এই জগৎ পরিব্যপ্ত করে আছেন তিনি অবিনাশী। যার বৃদ্ধি ও ক্ষয় নেই, যা সর্বদাই একরূপ, তাকেই অব্যয় বলা হয়। যিনি সত্তারূপে সর্বত্র পরিব্যপ্ত, যিনি সর্বব্যাপী, তিনি অবিনাশী ও অব্যয় কেননা তাঁর বিনাশ বা পরিবর্তন হলে (ক্ষয় বা বৃদ্ধি) সর্বব্যাপিত্ব থাকে না। ভগবান এখানে পরমাত্মাকেই অবিনাশী বলেছেন কারণ পরমাত্মা নিত্য এবং সমস্ত জগৎ ওই নিত্যতত্ত্ব দ্বারা পরিব্যপ্ত। পরমাত্মা অবিনাশী,অপরিবর্তনশীল। যেমন জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কিন্তু জলের উপচয়(বৃদ্ধি) বা অপচয়(ক্ষয়) হয় না, ঠিক তেমনই জগৎসংসার পরিবর্তন হলেও অবিনাশী পরমাত্মা বা আত্মা অপরিবর্তিত থাকে।
‘বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎকর্তুমর্হতি’ — আত্মা অবিনাশী, এই অবিনাশীর বিনাশ কেউ করতে পারে না। কিন্তু শরীর বিনাশশীল যা প্রতিক্ষণে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। সুতরাং এই বিনাশশীলের বিনাশ কেউ রোধ করতে পারবে না। অর্জুন যদিও ভেবেছিলেন যে তিনি যুদ্ধ না করলে তাঁর প্রিয়জনদের মৃত্যু হবে না কিন্তু ভগবান বলেছেন যে অর্জুনের যুদ্ধ করা বা না করায় এই অবিনাশী ও বিনাশী তত্ত্বের কোন পার্থক্য হবে না, অর্থাৎ অবিনাশী আত্মা চিরস্থায়ী থাকে এবং বিনাশশীল দেহ বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
অন্তবন্ত ইমে দেহা, নিত্য়স্য়োক্তাঃ(শ্) শরীরিণঃ
অনাশিনোऽপ্রমেয়স্য়, তস্মাদ্য়ুধ্য়স্ব ভারত॥18॥
ভগবান অর্জুনকে তাঁর স্বধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছেন যে মানুষের শরীর নশ্বর অর্থাৎ বিনাশশীল কিন্তু এই শরীরে স্থিত শরীরী অর্থাৎ জীবাত্মা অবিনাশী, অপ্রমেয় এবং নিত্য। শরীরী অর্থাৎ যে শরীর ধারণ করে। শরীর ধারণ করার জন্য আত্মাকে দেহি বা শরীরী অথবা ‘আত্মার এই দেহ’ এইরূপ বলা হয়। অর্জুন আত্মীয়-পরিজনদের দেহের প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে স্বধর্মকে ভুলে গেছেন। ভগবান বলছেন যে অর্জুন যদি যুদ্ধ নাও করেন তথাপি পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণাচার্য এবং সমস্ত রথী মহারথীদের এই শরীর বিনাশ হবে। অর্জুন একজন ক্ষত্রিয় এবং অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই ক্ষত্রিয়ধর্ম। সীমান্তে শত্রুকে নিধন করে দেশকে রক্ষা করা একজন সৈনিকের ধর্ম। আততায়ী কাসবকে ন্যায়াধীশ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন কারণ উপযুক্ত বিচার করা একজন ন্যায়াধীশের ধর্ম। স্বীয় ধর্ম পালনে যদি কারও মৃত্যু হয় তাহলে সেটি পাপ নয়।
অর্জুন যুদ্ধে বিরত থেকে সন্ন্যাস নেবার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু ভগবান তা হতে দেন নি। অর্জুনকে তিনি মনের এই দুর্বলতা ত্যাগ করে স্বধর্ম পালন করে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অর্জুনকে এবং পরোক্ষভাবে মানবসমাজকে স্বীয় কর্তব্য-কর্ম করার উপদেশ দেয়। গীতা শক্তি এবং ভক্তির বাণী শোনায়। গীতায় ভগবান মৃত এবং জীবিত — উভয়ের প্রতি শোক না করার উপদেশ দিয়েছেন।
য় এনং(ব্ঁ) বেত্তি হন্তারং(য়্ঁ), য়শ্চৈনং(ম্) মন্য়তে হতম্ ।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো, নায়ং(ম্) হন্তি ন হন্য়তে॥2.19॥
ভগবান জানতেন যে অর্জুন আত্মীয়-পরিজনদের দেহের প্রতি মোহগ্রস্থ। শরীরী অর্থাৎ আত্মার বিষয়ে তাঁর জ্ঞান মোহের দ্বারা ঢাকা পড়ে আছে। তাই ভগবান বলেছেন – যে ব্যক্তি এই অবিনাশী শরীরী অর্থাৎ আত্মাকে হন্তা বলে মনে করে এবং যে ব্যক্তি ইহাকে নিহত বলে জানে, তাদের উভয়েরই আত্মতত্ত্বের জ্ঞান নেই। আত্মা হত্যা করেন না এবং হত হন না।
অর্জুন ভাবছিলেন যে তিনি মারবেন এবং তাঁদের মৃত্যু হবে। এটি অর্জুনের ভুল ধারণা ছিল কারণ কবে, কোথায়, কিভাবে কার মৃত্যু হবে তা সুনিশ্চিত। এই বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে – কয়েকজন বন্ধু একসাথে দুটো গাড়ী নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল। ফিরে আসার পথে একজন প্রথম গাড়ী থেকে নেমে দ্বিতীয় গাড়ীতে উঠে। দুর্ভাগ্যবশতঃ দ্বিতীয় গাড়ীটি দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়। অন্যান্য সাথীরা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই ছেলেটির মৃত্যু হয়। প্রথম গাড়ীতে থাকলে হয়তো সে প্রাণে বেঁচে যেত।
একাদশ অধ্যায়ে ভগবানের বিরাটরূপ দর্শনের সময় অর্জুন সবাইকে ভগবানের মুখের ভিতর নিহতরূপে দেখেছিলেন। সেই অধ্যায়ে ভগবান অর্জুনকে বলেছেন—
দ্রোণং চ ভীষ্মং চ জয়দ্রথঞ্চ কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান্।
ময়া হন্তাংস্ত্বংজহি মা ব্যথিষ্ঠা যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান্।।১১.৩৪।।
অর্থ হল– ”দ্রোণ ,ভীষ্ম,জয়দ্রথ, কর্ণ এবং অন্যান্য শূরবীরদের আমি পূর্বেই বধ করে রেখেছি, তুমি নিহতদেরই বধ করো। ব্যথিত হয়ো না, যুদ্ধ কর ; তুমি যুদ্ধে জয়ী হবে।”
এই শরীরী কাউকে হত্যা করেন না এবং নিহত হন না অর্থাৎ শরীরী কোন ক্রিয়ার কর্তা নন, কর্মও নন এবং এর মধ্যে কোন বিকারও আসে না। ‘হত্যা করেন না’ অর্থাৎ ইনি অকর্তা, সাক্ষীস্বরূপ, ‘হত হন না’ অর্থাৎ অবিনাশী। যে ব্যক্তি শরীরের মত শরীরীকে বিনাশকারী বা বিনাশশীল ভাবে, সে প্রকৃতপক্ষে শরীর ও শরীরীর পার্থক্যের গুরুত্ব বোঝে না।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্,
নায়ং(ম্) ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ
অজো নিত্য়ঃ(শ্) শাশ্বতোऽয়ং(ম্) পুরাণো,
ন হন্য়তে হন্য়মানে শরীরে ॥20॥
অর্জুন রণক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর আশঙ্কায় বিশেষ শোকবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। অর্জুনকে ভগবান বলেছেন যে আত্মা কখনও জাত বা মৃত হন না। ইনি জন্ম নিয়ে অস্তিত্ব লাভ করেন না অর্থাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান। ইনি জন্মরহিত , নিত্য, শাশ্বত, এবং প্রাচীন (অনাদি)।
শাস্ত্রে ছয়প্রকার বিকারের উল্লেখ আছে – জন্ম, অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, পরিবর্তন, ক্ষয় এবং বিনাশ। এই বিকারসমূহ শরীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই ভগবান বলেছেন যে শরীর মৃত্যুপ্রাপ্ত হলেও আত্মা এই ষড়বিধ বিকাররহিত। সেইজন্য অর্জুনের শোক করা উচিত নয়।
বেদাবিনাশিনং(ন্) নিত্য়ং(য়্ঁ), য় এনমজমব্য়য়ম্।
কথং(ম্) স পুরুষঃ(ফ্) পার্থ, কং(ঙ্) ঘাতয়তি হন্তি কম্॥2.21॥
আত্মা যে ষড়বিধ বিকাররহিত অর্থাৎ ইনি যে অবিনাশী,নিত্য, জন্মরহিত এবং অব্যয়, এই জ্ঞান যে ব্যক্তির বোধগম্য হয়েছে, তিনি কখনও কাউকে হত্যা করতে বা করাতে পারেন না। প্রতিবিম্বের উপর শস্ত্রাঘাত করলে কাউকে বধ করা যায় না; জলপূর্ণ পাত্রে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু জল ফেলে দিলে সেই পাত্রে সূর্যকে আর দেখা যায় না, ছায়া বিলীন হয়ে যায় কিন্তু সূর্য স্থির থাকে। যে বস্তু উৎপন্ন হয়, তার বিনাশ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যা উৎপন্ন হয় না, তার বিনাশ নেই। সেইজন্য শরীরের বিনাশ হলেও শরীরী একইভাবে বিদ্যমান থাকে। আমরা জন্ম-মৃত্যুর আবর্তনে চুরাশি লক্ষ শরীর ধারণ করলেও কোন শরীরই আমাদের সাথে চিরকাল থাকে না এবং ‘আমি’ অর্থাৎ আত্মাও কোন বিশেষ শরীরকে ধরে থাকে না। অন্যান্য জীবের শরীরে এটি হৃদয়ঙ্গম করার মত বুদ্ধি থাকে না, শুধুমাত্র মনুষ্যদেহ দ্বারাই এটি বোধগম্য করা সম্ভব হয়।
বাসাংসি জীর্ণানি য়থা বিহায়,
নবানি গৃহ্ণাতি নরোऽপরাণি
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-
ন্য়ন্য়ানি সংয়াতি নবানি দেহী॥22॥
পূর্ববর্তী শ্লোকসমূহে জীবাত্মার নির্বিকারত্বের যে বর্ণনা করা হয়েছে, এই শ্লোকে দৃষ্টান্তরূপে তার বর্ণনা ভগবান করেছেন।
'বাসাংসি জীর্ণানি য়থা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোऽপরাণি' – পোশাক পুরাতন ও মলিন হয়ে গেলে মানুষ যেমন সেটি পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র ধারণ করে, তেমনি দেহী অর্থাৎ জীবাত্মাও জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর ধারণ করে। এই অধ্যায়ের ত্রয়োদশ শ্লোকে বলা হয়েছে যে ধীর অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তি দেহান্তর-প্রাপ্তি অর্থাৎ মৃত্যুর বিষয়ে শোক করেন না। ওই কথাটিই এখানে ভগবান উদাহরণ সহকারে স্পষ্টভাবে বলছেন যে জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করলে মানুষ যেমন শোকগ্রস্থ হয় না, ঠিক তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ অর্থাৎ মৃত্যুতেও শোক করা উচিত নয়।মানুষ কাপড় বদলায়, পশুপক্ষী নয়; সেইজন্য এখানে ‘নরঃ’ পদটি ব্যবহৃত হয়েছে।আত্মা অবিনাশী, তাই মৃত্যুতে শোক করা উচিত নয়; ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যে বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হলে শবযাত্রায় খোল-করতাল বাজিয়ে হরিনাম ও পুষ্পবৃষ্টি করতে করতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থ হল আনন্দের সাথে প্রিয়জনকে বিদায় দেওয়া হয় এই ভেবে যে তাঁর আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি যেন হয়।
নৈনং(ঞ্)ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি,নৈনং(ন্) দহতি পাবকঃ
ন চৈনং(ঙ্) ক্লেদয়ন্ত্য়াপো, ন শোষয়তি মারুতঃ॥23॥
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের এই কথোপকথন যুদ্ধক্ষেত্রে হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনদের মৃত্যুর কথা ভেবে অর্জুন শোক প্রকাশ করেছিলেন। তাই ভগবান বলেছেন যে, ওরা কী করে মারা যাবে? কারণ জীবাত্মা অবধি পৌঁছানো অস্ত্রশস্ত্রের সাধ্যের বাইরে অর্থাৎ শস্ত্রদ্বারা শরীরকে কাটতে পারা গেলেও জীবাত্মাকে ছেদন করা যায় না।; আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা শরীর দগ্ধ হলেও জীবাত্মা দগ্ধ হয় না। বরুণাস্ত্রের দ্বারা শরীর সিক্ত হলেও জীবাত্মা সিক্ত হয় না। পবনাস্ত্রের দ্বারা শরীর শুস্ক হলেও শরীরী শুস্ক হয় না। তাৎপর্য এই যে অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা শরীরের বিনাশ হলেও জীবাত্মার বিনাশ অসম্ভব । সুতরাং এটি নিয়ে শোক করা উচিত নয়।
অচ্ছেদ্য়োऽয়মদাহ্য়োऽয়ম্ , অক্লেদ্য়োऽশোষ্য় এব চ
নিত্য়ঃ(স্) সর্বগতঃ(স্) স্থাণু(র্),অচলোऽয়ং(ম্) সনাতনঃ॥24॥
পূর্ববর্তী শ্লোকে উল্লেখিত কথাগুলো এখানে পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
'অচ্ছেদ্যোহয়ম্' — শস্ত্রদ্বারা জীবাত্মাকে ভেদ করা যায় না অর্থাৎ ভেদরূপ প্রক্রিয়া শরীরীতে কার্য্যকরী হয় না। শস্ত্রাদি ভিন্ন কোনো মন্ত্র, অভিশাপ ইত্যাদি দ্বারাও জীবাত্মাকে আঘাত করা যায় না। কথিত আছে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় তাঁর অভিশাপে শাকল্যর মস্তক দেহচ্যুত হয়েছিল। এইভাবে মন্ত্র বা অভিশাপ দ্বারা দেহকে কাটা যেতে পারে কিন্তু দেহী অচ্ছেদ্য।
'অদাহ্যোহয়ম্' — শরীরী অদাহ্য। অগ্নি ব্যতিরেকে মন্ত্র বা অভিশাপ দ্বারাও করা যায় না। দময়ন্তীর অভিশাপে যেভাবে ব্যাধ অগ্নি ব্যতীতই ভস্ম হয়েছিল, এভাবেই যেগুলো দগ্ধ হওয়ার উপযুক্ত, সেগুলো অগ্নি বা অভিশাপে দগ্ধ হতে পারে। কিন্তু জীবাত্মায় এই দহনক্রিয়া কার্যকরী হয় না।
'অক্লেদ্যঃ'– জীবাত্মাকে জল ,মন্ত্র,অভিশাপ ওষুধ ইত্যাদির দ্বারা সিক্ত করা যায় না কারণ এটি সিক্ত হবার অবস্থার অতীত।শোনা যায় যে ‘মালকোষ’ রাগ সঠিকভাবে গাইলে পাথরও গলে যায় কিন্তু জীবাত্মা রাগ-রাগিণীর দ্বারাও সিক্ত হয় না।
'অশোষ্য' – জীবাত্মা অশোষ্য। বায়ু বা মন্ত্রাদি দ্বারা এটিতে শোষণক্রিয়া ঘটানো সম্ভব নয়। কথিত আছে যে অগস্ত মুনি নিজের আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা সমুদ্রকে শোষণ করেছিলেন কিন্তু জীবাত্মাকে কেউ নিজ শক্তি দ্বারা শোষণ করতে পারে না।
বিনাশের আশঙ্কাতে অর্জুন শোক প্রকাশ করেছিলেন। তাই ভগবান জীবাত্মাকে অচ্ছেদ্য,অদাহ্য,অক্লেদ্য ও অশোষ্য রূপে বিশেষিত করে বললেন যে কোনও ক্রিয়াই জীবাত্মায় প্রবেশ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং জীবাত্মার জন্য শোক করার প্রশ্নই উঠে না।
ভগবান আত্মার পাঁচটি বিশেষণ উল্লেখ করেছেন:
নিত্য – একই ভাবে সদাই বিরাজমান।
সর্বগত – সর্বকালে সর্বত্রই সমানরূপে অবস্থিত।
অচল – স্থিরস্বভাবসম্পন্ন।
স্থাণু – স্পন্দনহীন
সনাতন – অনাদি এবং সর্বকালে আছে।
আজকের বিবেচন সত্র এখানেই সমাপ্ত হয় এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়।
: : প্রশ্নোত্তর : :
প্রশ্নকর্ত্রী: কমলেশ শর্মা দিদি
প্রশ্ন: প্রাণ ও আত্মা কী আলাদা?
উত্তর: প্রাণ ও আত্মা আলাদা। আমরা যখন নিশ্বাস নিই তখন শুদ্ধ বায়ু আমাদের ভিতর প্রবেশ করে। এই গ্রহণ করা বায়ুকে প্রাণ বায়ু বলা হয়। এটি যদি কেবল বায়ু হতো, তাহলে অক্সিজেন নাক বা মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলে মানুষের মৃত্যু হতো না। এই প্রাণ বায়ু সেই শক্তি যা শরীরকে আত্মার সাথে জুড়ে রাখে। প্রাণ বায়ু শেষ হলেই দেহের বিনাশ হয় এবং আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে।
প্রশ্নকর্তা: সুমিত দাদা
প্রশ্ন: যদি আমরা কেবল নিমিত্ত মাত্র হই, তাহলে ভালো বা খারাপ কর্মের দোষ আমাদের কেন হয়?
উত্তর: মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে এই প্রশ্ন অর্জুনের ছিল। অর্জুন বলেছিলেন যে যুদ্ধে আত্মীয়-পরিজনদের বধ করলে তিনি পাপের ভাগী হবেন। খারাপ বা ভালো কাজ ভগবান করান না। নিজের মন ও বুদ্ধি দিয়ে খারাপ ভালোর বিচার নিজেকে করতে হয়। অংশরূপে পরমাত্মা জীবদেহে সাক্ষীরূপে স্থিত থাকেন। আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ প্রকৃতির অধীন। মন ও বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সব কর্ম করায়। আত্মা কোনো কর্মের কর্তা নয়। মৃত্যুর পর শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা কৃত কর্মের দোষ -গুণ সঙ্গে নিয়ে আত্মা শরীর ত্যাগ করে এবং কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ আত্মা পরজন্মে নতুন শরীর গ্রহণ করে এবং পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ করে।
প্রশ্নকর্তা : শিবরামদাস দাদা
প্রশ্ন: শ্রীকৃষ্ণের বিরাটরূপ দর্শন করার পরও দুর্যোধন নিজের বিনাশ কেন বুঝতে পারে নি? শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, এই জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য কেন দুর্যোধনকে সদুপদেশ দেন নি?
উত্তর: দুর্যোধনের অহঙ্কার ও দুর্বুদ্ধি এই সর্বনাশের কারণ। দুর্যোধনের বিবেক লোপ পেয়েছিলো। কথিত আছে:
জব নাশ মনুজ পর ছাতা হ্যায়,
পহলে বিবেক মর জাতা হ্যায়।
অর্থাৎ মানুষের বিনাশ নিকটে আসলে বিবেক লোপ পায়।
ভীষ্ম পিতামহ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি আজীবন হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের সেবক হয়ে থাকবেন। তাই তিনি বিবেককে গুরুত্ব না দিয়ে স্বীয় প্রতিজ্ঞাকে অধিক প্রাধান্যতা দিয়েছিলেন। সেটি মহান ভীষ্মের চরিত্রের একমাত্র দোষ। শ্রদ্ধেয় গোবিন্দদেব গিরিজী বলেন যে পিতামহ ভীষ্ম এক বিচিত্র চরিত্র। তিনি ভীষ্মকে চতুর্দশীর চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন, পূর্ণিমার চাঁদ নয়।
গুরু দ্রোণাচার্যের এই দোষ ছিল যে তিনি অর্থের অভাবে তাঁর বিদ্যা বিক্রি করেছিলেন। অর্থের অভাবে পুত্র অশ্বত্থমার জন্য দুধের জোগাড় করতে না পারায় তিনি হস্তিনাপুর রাজ্যের শরণাগত হয়েছিলেন। যে গুরু বিদ্যা বিক্রী করেন না, তাঁর বিবেক জাগ্রত থাকে।