विवेचन सारांश
দৈবী ও আসুরী গুণ সমূহের লক্ষণ

ID: 4017
बंगाली - বাংলা
শনিবার, 04 নভেম্বর 2023
অধ্যায় 16: দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ
1/2 (শ্লোক 1-1)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিশারদ ড: আশু গোয়েল মহাশয়


নাম সংকীর্তন, হনুমান চালিসা পাঠ, দীপ প্রজ্জ্বলন প্রার্থনা ও গুরু বন্দনার সাথে আজকের বিবেচন সত্র শুরু হলো। ভগবানের অতিশয় কৃপায় আমরা শ্রীমদভগবদগীতা অধ্যয়ণ শুরু করতে পেরেছি। সাধু-সন্ত রা বারংবার বলেছেন -- গীতা তুল্য আর কোন গ্রন্থ নেই। আমরা দ্বিতীয় স্তরে পৌঁচেছি। মানে, আমরা প্লেগ্রুপ ছেড়ে স্কুল স্তরে পৌঁছাতে পেরেছি। পঞ্চদশ অধ্যায়ে ভগবান নিজের পুরুষোত্তম রূপের বর্ণনা করেছেন। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ এই অধ্যায় কে গীতা জি'র পূর্ণ আহুতি বলেছেন। ষোড়শ ও সপ্তদশ অধ্যায় কে পরিশিষ্ট বলেছেন। অর্জুনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে নবম অধ্যায়ে ভগবান দৈব ও আসুরী নিয়ে শুরু করেছিলেন কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ হয়নি -- ষোড়শ অধ্যায়ে ভগবান নিজেই আবার এই দৈব ও আসুরী গুণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এ আমাদের এই জন্ম বা পূর্ব জন্মের পূণ্যফল যে আমরা গীতা পড়তে সমর্থ হয়েছি। কারণ, এই সৌভাগ্য নিজে পছন্দ করা সম্ভব নয়। গীতা পাঠ করার জন্য ভগবান নিজে ভক্ত খুঁজে নেন। আঠারো অধ্যায়ে ভগবান নিজে বলেছেন ---
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত ।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্ ॥18.62॥

ভগবান বলেছেন -- তুমি সর্বপ্রকারে আমার স্মরণে এসো। এতে তুমি শান্তির সাথে সেই শ্বাশত পরমাত্মা কে ও প্রাপ্ত করবে।

আদি গুরু শঙ্করাচার্য নবম শতাব্দীতে সমস্ত শাস্ত্রের সংশোধন করেছিলেন। তিনি নিজের রচিত " ভজ গোবিন্দম" এ বলেছেন --
ভগবদ্গীতা কিঞ্চিদধীতা
গঙ্গা জললব কণিকা পীতা |
সকৃদপি য়েন মুরারী সমর্চা
ক্রিয়তে তস্য় য়মেন ন চর্চা || 21 ||

যদি আমরা গীতা কে জীবনে ধারণ করে নিই তাহলে আমরা ভগবানের ই হয়ে যাবো। আমাদের উপর যমরাজের শাসন চলবে না। বেদ যেমন শ্রী বিষ্ণুর শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি থেকে সৃষ্টি হয়েছে.... গীতা তেমন ভগবানের মুখনিঃসৃত। গীতার তুল্য দ্বিতীয় কোন গ্রন্থ নেই।
সনাতন ধর্মে পঞ্চ "" এর কথা আছে - গাভী, গঙ্গা, গায়ত্রী, গীতা ও গোবিন্দ

সকল উপনিষদের সার হলো গীতা। দশম অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন -- নদীর মধ্যে আমি গঙ্গা, আবার বলেছেন আমি গায়ত্রী নামক ছন্দ। ভগবান বলেছেন... হে অর্জুন,
য ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি ।
ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ॥18.68॥

ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মে প্রিয়কৃত্তমঃ ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভুবি ॥18.69॥
অর্থাৎ, আমার এই পরম গুহ্য জ্ঞান যে আপন জীবনে ধারণ করে -- সেই আমার খুব প্রিয় এবং সে আমাকে প্রাপ্ত করবে এতে কোন সন্দেহ নেই ।

ষোড়শ অধ্যায়ের নাম " দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ"। এখানে ভগবান বলেছেন -- কোন গুণ ধারণ করলে তাকে দৈবীয় বা আসুরী বলা যায়। তবে এটাও নয় যে তুমি কেবল দৈবী অথবা আসুরী গুণই সবসময় ধারণ করে থাকবে। যে ক্ষণে তুমি যেমন লক্ষণ ধারণ করবে, তুমি তেমনই হয়ে যাবে। আমরা সকলে সত্ত্ব, রজো ও তমোগুণের মিশ্রনে তৈরি। এই ত্রিগুণের তারতম্য আমাদের ব্যবহার, পছন্দ অপছন্দ, স্বভাবের পার্থক্য ঘটায়।

"সংতন্ কে সঙ্গ্ লাগ্ রে "-- কবীর দাস জী'র সুন্দর একটা ভজন আছে -- এতে বলা হয়েছে.... জীবনের সবচেয়ে প্রভাব পূর্ণ কথা হলো এই সৎসঙ্গ। চল্লিশ মিনিট সময় ধরে আমরা যে গীতার ক্লাস করি -- এই সময় টা তে আমরা সৎ মানুষের সঙ্গ লাভ করি। আমাদের শিক্ষক, আমাদের সহপাঠীরা... সকলেই সদগুণের অধিকারী। এদের সুন্দর সঙ্গ আমাদের চিন্তাধারা বদলে দিতে পারে। ক্লাস করে, বিবেচন সত্র শুনে নিজেরই অনুভব হবে যে জীবনে সাত্ত্বিকতা বাড়ছে।

এটা রাস্তা নয়, বরং গন্তব্য। দ্বাদশ অধ্যায়ে ভগবান ভক্তের লক্ষণ সমূহ বর্ণনা করেছেন তো স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়ার সূচনা দিয়েছেন। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে জ্ঞানী হওয়ার সূচনা দিয়েছেন এবং চতুর্দশ অধ্যায়ে গুণাতীত করেছেন। ষোড়শ অধ্যায়ে দৈব তথা আসুরী গুণের সূচনা করেছেন। প্রথম তিন শ্লোকে শ্রী ভগবান ছাব্বিশ টি দৈব গুণ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন... যদি তুমি ভগবান কে মানো, ভগবান কে ভয় পাও, তাঁর ভক্ত হও তাহলে নিচের তালিকায় খুঁজে দেখো তোমার কি কি গুণ আছে । গীতা আসলেই এক ব্যবহারিক গ্রন্থ । যত গীতা নিয়ে চর্চা করা হবে, জীবনের সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া তত সহজ হবে। এই ছাব্বিশ টি গুণ ছাব্বিশ রকমের ফুলের মতো ফুটে উঠে আমাদের জীবন কে সুরভিত করবে। সমস্ত কর্ম তথা কর্তব্য সঠিকভাবে করতে পারবো ।

16.1

শ্রীভগবানুবাচ

অভয়ং (ম্) সত্ত্বসংশুদ্ধিঃ (র্), জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ৷
দানং(ন্) দমশ্চ যজ্ঞশ্চ, স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্৷৷1৷৷

শ্রী ভগবান বললেন- ভয়ের পরম অনুপস্থিতি; বিবেকের পরম পরিশোধন; জ্ঞানের জন্য যোগব্যায়ামে দৃঢ় অবস্থান; সাত্ত্বিক দান; ইন্দ্রিয় দমন; যজ্ঞ; নিজ পাঠ; দায়িত্ব পালনের জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় শরীর-মন-কথার সরলতা।

ভগবান ছাব্বিশ টি গুণের আরম্ভ "অভয়" দিয়ে করেছেন।
অভয় : সাধারণ ভাবে অভয় কে শারীরিক গুণ বলে মনে হয়। অভয় কথার অর্থ যে ভয় পায় না। মাফিয়ারা তো ভয় পায় না... তারা কি দৈবী গুণসম্পন্ন ? প্রথম লক্ষণই ভগবান খুব অদ্ভুত বলেছেন। হিতোপদেশ এর একটি শ্লোক আছে...

आहार निद्रा भय मैथुनं च सामान्यमेतत् पशुभिर्नराणाम् ।
धर्मो हि तेषामधिको विशेष: धर्मेण हीनाः पशुभिः समानाः ॥

আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন এই সব কিছু ভগবান পশু মানুষ নির্বিশেষে সব প্রাণী কে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ বিবেকের সাথে এসবের ব্যবহার করে। পশুর বিবেক নেই। মানুষ তার বুদ্ধি দ্বারা এগুলো ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারে আবার খারাপ কাজেও ব্যবহার করতে পারে। ভয় মানুষ কে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু, ধর্ম পালন থেকে অভয়তা আসে। যে যত ধর্মশীল, তার জীবন তত নির্ভয়।

অর্থাৎ, আহার, নিদ্রা ইত্যাদি ছাড়াও মানুষের ধর্ম আছে -- যা পশুদের নেই। ধর্ম পালন দ্বারাই মানুষ এগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারে -- এর মানে হলো ভয়ের দুই রকম ব্যবহার হয়-- প্রত্যাশিত ভয় এবং অপ্রত্যাশিত ভয়। অর্থাৎ, এক অভয় হলো নির্ভীকতা এবং অপরটি হলো নির্ভীক স্বৈরাচারীতা। মাফিয়ারা স্বৈরাচারী কিন্তু সৈনিকরা নির্ভীক। সৈনিকরা নিয়ম, অনুশাসন এবং আদেশে বাঁধা থাকে। তারা জানে যে পুরো সিস্টেম তাদের পিছনে আছে -- তাই তারা নির্ভয়ে সীমান্তে পাহারায় থাকতে পারে। অন্যদিকে মাফিয়ারা দিশাহীন -- তারা দুর্বলদের ভয় পায়।

যার জীবন ভগবানে নিবেদিত, সে নির্ভয়। নির্ভয়তা ছাড়া অন্যান্য ভালো গুণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভগবান ও গুরুর আশ্রয়ে জীবনে নির্ভয়তা ও সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি হয়।
রাবণের মনে ভয় ছিল, কারণ তিনি খুব গর্হিত কাজ করেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন নির্ভীক।

সত্ত্বসংশুদ্ধি : প্রসিদ্ধ এক উক্তি আছে... মন চাঙ্গা তো কাটোতি মে গঙ্গা। যারা পূজা পাঠ করে না, তারা এটা বলে ফেলে.. কিন্তু, ভুলে যায় যে প্রাথমিক শর্ত হলো মন কে চাঙ্গা করা। অনেকে বলে... পূজা তো করি, মালা ও জপি কিন্তু মন তো বসে না... মনের ভিতর থেকে মলিনতা দূর না করলে মন তো বসবে না। অন্তঃকরণ নির্মল, কারণ তা বিশুদ্ধ আত্মতত্ত্বের অংশ। ভগবান স্বয়ং আমাদের হৃদয়ে বাস করেন, কিন্তু মধ্যে ময়লার আস্তরণ থাকায় নজরে আসে না। অন্তরের অসুখ, পাপ, বাসনা রূপ ময়লা সরিয়ে দিতে পারলে আমরা ভগবানের দর্শন পাবো। কোটি কোটি জন্ম এই চেষ্টা চলে... দৈবী গুণ লাভের জন্য মন থেকে কপটতা ঈর্ষা, দ্বেষ ইত্যাদি দূর করতে হবে, অজ্ঞানতা ও নেতিবাচকতা দূর করা আবশ্যক।

জ্ঞানযোগ ব্যবস্থিতি : কখনো কখনো আমাদের খুব ভালো ধ্যান হয়। বিবেচন শুনতে, গীতা বা রামায়ণ, মহাভারত পড়াতে মন লাগে খুব। কিন্তু এটা স্থায়ীভাবে থাকে না। যতক্ষণ না এটা স্থায়ী হয় ততক্ষণ দৈবী গুণ অধরা থেকে যায়। স্থায়ী হলে এটা দৈবী গুণে পরিণত হয় ।

দান : বলা হয় ধন দান। দান করার সময় যতক্ষণ " আমি" দিচ্ছি বা দিতে পারি -- এরকম ভাব থাকবে -- ততক্ষণ সেই দানে নিম্নতা থাকে। তবে, শাস্ত্রকারেরা বলেন... কর্তব্য ভেবে দেওয়া দানই শ্রেষ্ঠ। ভগবান দুটো শ্রেনী করেছেন -- দাতা ও গ্রহীতা। ভগবান যাকে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন সে এর সদুপযোগ করবে অবশ্য। শুধুমাত্র ধন দানই দান নয়, জ্ঞানও দান করা হয়। দান করার প্রবৃত্তি তৈরি করতে হবে। গীতা পরিবার থেকে আমরা জ্ঞান গ্রহণ করছি তো সেবা রূপে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া উচিত -- এরকমই ভাবনা হওয়া উচিত। এখানে ধন খরচ হচ্ছে না, বরং আমাদের উর্জা, সময়, আমাদের প্রতিভা নিয়োগ করছি।
অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথির চেয়ে বেশি ভালো হলো সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি। কেউ কষ্টে আছে, দুঃখে আছে -- তার পাশে থেকে তার মনে আশা জোগানো অনেক বড়ো ঔষধ। নিজের পরিবার, প্রতিবেশী কে বা অজ্ঞান - অনাথ কে কিছু না কিছু দানের প্রবৃত্তি তৈরি করতে হবে।

প্রজ্ঞাচক্ষু স্বামী শরণানন্দের কথায় -- "सबके काम आ जाओ और बदले में कुछ मत चाहो।" ভালো জীবন কাটাতে হলে এই মনোভাব রাখা উচিৎ.... কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই যেন অন্যের প্রয়োজনে লাগতে পারি। তিনি আরও বলেছেন --- অনেক ডিগ্রি থাকুক বা ধন... যদি তা কাজে না আসে, তাহলে সব ব্যর্থ।

দম : এর অর্থ ইন্দ্রিয়ের সংযম। আমি কি দেখবো, কি শুনবো, কি বলবো বা কি স্পর্শ করবো...
যাদের ইন্দ্রিয়ের একদমই নিয়ন্ত্রণ নেই -- তাদের পক্ষে সোজা হয়ে বসাও কঠিন হয়ে যায়। সবচেয়ে চঞ্চল ইন্দ্রিয় হলো চক্ষু ।

যজ্ঞ : চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান বারো প্রকার যজ্ঞের কথা বলেছেন এবং দশম অধ্যায়ে বলেছেন -- "যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোস্মি".. অর্থাৎ যজ্ঞের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ। সমষ্টি ভাবে সবের কল্যাণের জন্য উত্তম কার্য করা,আপন কর্তব্য পালন করা, অগ্নিহোত্র কর্ম করা, নিত্য পূজন- অর্চন করা --- নিজের পরম্পরা পালন করা -- এসবই যজ্ঞ। বলা হয় শ্রীমদভগবদগীতা কথা এক জ্ঞান - যজ্ঞ।

স্বাধ্যায় : সাধারণ ভাবে স্বাধ্যায়ের অর্থ ভালো কিছু পড়া। কিন্তু, শাস্ত্রকারদের মতে স্বাধ্যায় হলো নিজেকে পড়া বা নিজেকে চিন্তন করা -- "আমি কে"-- এই খোঁজ করা। শরীর তো প্রতিনিয়ত বদলায়... নইলে আমাদের ছোটবেলার ছবি হুবহু এখনকার মতো হতো। আধুনিক বিজ্ঞান বলে শরীরের সব কোষ সাড়ে তিন বছরের মধ্যে পুরো বদলে যায়। এর মানে প্রতি ক্ষণে শরীরের মৃত্যু হচ্ছে। আমাদের ঘুম ভালো হয়েছে বা ঘুম হয়নি -- এই ব্যাপার টা আমার মধ্যের কে বুঝতে পারে... বা হিসাব রাখে... তাকে শরীরের থেকে আলাদা করে খোঁজা --- সেখান থেকেই আধ্যাত্মিকতার শুরু ।

তপ : এই তপে শরীর শুকায় না -- এ হলো গৃহস্থের স্বধর্ম পালন হেতু হাসিমুখে কষ্ট সহ্য করা । যেমন, করোয়া চৌথ ব্রত মায়েরা, বোনেরা প্রসন্নতার সঙ্গে হাসিমুখে পালন করে। যদি প্রসন্নতার অভাব হয় তাহলে সেই তপ সফল হয় না। স্বধর্ম পালন প্রসন্ন ভাবে করা উচিৎ ।

আর্জব (সরলতা) : শবরী মায়ের কথা শোনা যাক...

শবরী ভীল সর্দারের কন্যা ছিল। তার আসল নাম ছিল শ্রমনা। তিনি অত্যন্ত মৃদুভাষী, কোমল ও সাত্ত্বিক স্বভাবের ছিল। একটা ছোট্ট মেষশাবককে সে খুব ভালবাসতেন। সারাদিন সেই শাবক টিকে নিয়েই থাকতেন। বারো বছর বয়সে তার বিবাহ স্থির হয়। বিয়ের দু'দিন আগে ঘুম থেকে উঠে শবরী সেই মেষশাবকটি কে দেখতে না পেয়ে খুব অস্থির হয়ে যান এবং খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলে চলে যান। সেখানে ও খুঁজে না পেয়ে একটা গাছের নীচে বসে কাঁদতে লাগলেন। সেখানে ওনার এক সখি এসে জানালো যে তার বিয়ের ভোজে মাংস খাওয়ানোর জন্য গ্রামের সব পরিবার থেকে একটা করে ভেড়া নিয়ে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। এটা শুনে শবরী ভীষণ আঘাত পেলেন। ভাবতে লাগলেন  কিভাবে এই নিরীহ পশুগুলো কে বাঁচানো যায়। বিয়ে না হলে ভোজ খাওয়ানো হবে না -- তাহলে পশুগুলো বেঁচে যাবে এই ভেবে তিনি পালিয়ে গেলেন। তিনদিন কোন খাবার ও জল না খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় এক জঙ্গলের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কাছেই ছিল মতঙ্গ ঋষির আশ্রম। ঋষি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন পথে এক বালিকা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। ঋষি ও তাঁর শিষ্যরা শবরীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। জ্ঞান ফিরে পেয়ে শবরী তাঁদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন, কারণ এর আগে কোন মুনি-ঋষিদের শবরী দেখেনি। একটু সুস্থ হয়ে শবরী মাতঙ্গ মুনি কে সব বলল... তাঁর হৃদয় ও দ্রব হয়ে গেল -- তিনি শবরীকে তাঁর আশ্রমে স্থান দিলেন।

কিছুদিন পরে শবরী লক্ষ্য করলেন আশ্রমিক ঋষি কুমারেরা শবরীর সেই আশ্রমে থাকা পছন্দ করছিলেন না। সেটা জানতে পেরে শবরী মতঙ্গ মুনির অগোচরে আশ্রম ছেড়ে আরও গভীর জঙ্গলে চলে গেল ও সেখানেই থাকতে লাগলেন, কিন্তু তার গুরু মতঙ্গের যাওয়া আসার পথ পরিষ্কার করে রাখতেন, কাঠ আনতে যাতে গভীর জঙ্গলে না যেতে হয়, সেই পরিশ্রম কমাতে মাঝ রাত্রে কাঠের টুকরো আশ্রমের কাছাকাছি ছড়িয়ে রেখে আসতেন। গুরু মতঙ্গ একদিন সেটা লক্ষ্য করলেন ও শবরী কে আবার আশ্রমে ফিরিয়ে আনলেন। শবরী প্রসন্নতার সঙ্গে গুরুর সেবা করতে লাগলো।

এর ও কিছুদিন পরে ঋষি কুমারেরা আশ্রমিক জীবন শেষ করে ফিরে গেলেন। একদিন গুরুদেব ও শবরী কে বললেন --- পুত্রী, আমি জীবনের শেষ সময়টা হিমালয়ে কাটাতে চাই, আমি সেখানে যাচ্ছি। তুমি এই আশ্রমে থাকো। তুমি আমার অনেক সেবা করেছ। আমি আশীর্বাদ করছি ভগবান শ্রী রামচন্দ্র তোমায় দর্শন দিতে আসবেন এই আশ্রমে। এই বলে তিনি চলে গেলেন। শবরী খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন .. গুরুদেব তো বলে গেলেন না, ভগবান কোন পথে আসবেন... তাঁকে কোথায় বসাতে হবে, কি খাওয়াবো তাঁকে.... এরপর থেকে প্রতিদিন শবরী আশ্রমের সবদিকের পথ পরিষ্কার করেন, প্রতিদিন নদী থেকে স্বচ্ছ জল ভরে এনে রাখেন, গাছ থেকে সুন্দর সুন্দর ফল পেড়ে এনে রাখেন , আসন তৈরি করেন। গুরুদেবের কথায় তার প্রগাঢ় বিশ্বাস যে ভগবান অবশ্যই সেই আশ্রমে আসবেন। তার প্রতীক্ষা শুরু হলো ... শবরী অত্যন্ত সহনশীল এক সাত্ত্বিক প্রকৃতির মেয়ে।
ষোলো বছরের শবরী প্রতীক্ষা করতে করতে ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধায় পরিণত হলেন। শ্রী রামচন্দ্র সুতীক্ষ্ণ ঋষি কে দর্শন দিয়ে শবরীর আশ্রমে এসে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন।
ভগবান রামচন্দ্র কে দেখে প্রথমেই শবরীর আনন্দ হলো যে গুরুদেবের বচন সত্য হলো।
শবরী ভগবানের চরণ আঁকড়ে ধরে রইলেন... চোখের জলে ধুয়ে গেল প্রভু রামের চরণ।
শবরী রামচন্দ্র কে বললেন --- আমি নীচুজাতির অল্পবুদ্ধি নারী। আমি কিছু শিখিনি প্রভু, আমি কিভাবে আপনার স্তুতি করবো?? বারবার এই আক্ষেপ শুনে রামচন্দ্র বললেন ---

जाति पाँति कुल धर्म बड़ाई।
धन बल परिजन गुन चतुराई॥
कह रघुपति सुनु भामिनि बाता।
मानउँ एक भगति कर नाता॥

অর্থাৎ, আমি তো জাত-পাত, কুল-ধর্ম, স্ত্রী -পুরুষ কিছু মানি না। আমি কেবল একটা সম্পর্ক মানি... ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক। যে আমার ভক্ত, সে আমারই।

এখানেও একটা বিশেষ কথা আছে.. তা শাস্ত্রের কথা ও বটে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন কে তখনই জ্ঞান দিয়েছিলেন, যখন অর্জুন তা পেতে আগ্রহ দেখিয়েছেন -

কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসংমূঢ়চেতাঃ ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ।।২.৭।।

কিন্তু শবরী কিছুই চাননি। ভগবান নিজেই শবরীকে নবধা ভক্তির জ্ঞান প্রদান করলেন।
ভগবানের কৃপায় মা শবরী উত্তম গতি প্রাপ্ত হলেন। একজন যোগী পুরুষ যা প্রাপ্ত করতে জন্ম জন্ম পার করেন, শবরী মা ভক্তি দ্বারা তা লাভ করলেন। ভগবান চতুর, তার্কিক বা অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি চান না, শ্রদ্ধাবান ভক্ত তাঁর বেশি প্রিয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে শবরী তাঁর গুরুর কথায় ভরসা রেখে প্রতীক্ষা করেছিলেন। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ ভক্ত ।
শবরী মা কে ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিয়ে বিবেচন সত্র শেষ হলো। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব।

::প্রশ্নোত্তর পর্ব::
প্রশ্নকর্তা : যোগেশ গোয়েল
প্রশ্ন : ভগবানের কি কি নাম? আর দেবতাদের কি কি নাম?
উত্তর : নামে কিছু হয় না। ভগবান চতুর্থ অধ্যায়ে বলেছেন -
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ ।

যে যেই নামে বা যেইভাবে আমার উপাসনা করবে, সেই রূপে, সেই ভাবে পরব্রহ্ম রূপে আমাকে প্রাপ্ত করবে। কেউ শ্রী বিষ্ণুর উপাসক, কেউ বা গণেশ জী কে পরব্রহ্ম রূপে উপাসনা করে -- দেবতার উপাসনাতেও সে আমাকে প্রাপ্ত করবে। পরব্রহ্ম তো সর্বত্র ব্যাপৃত। আমাকে দেবতা, গুরু বা ভগবান রূপে আরাধনা করেই প্রাপ্ত হবে। ভক্তিতে পাথরেও ভগবানের প্রকাশ ঘটে।

প্রশ্নকর্তা : শিবাঙ্গী দিদি
প্রশ্ন : যাহা উত্তম, তাহাই পুরুষোত্তম। আমরা পুরুষ ও প্রকৃতি কে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবো ?
উত্তর : আমাদের শরীর তো প্রকৃতি এবং শরীরের ভিতর যা চৈতন্য স্বরূপ তাই হলো পুরুষ। প্রকৃতিতে বিকার আসে, কারণ তা নিরন্তর পরিবর্তন হয়। কিন্তু পুরুষ বা আত্মার কোন বিকার নেই, বৃদ্ধি নেই, মৃত্যু ও নেই।

প্রশ্ন - বাচ্চারা কিভাবে শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করবে ?
উত্তর- বাচ্চাদের নিয়মিত গীতা প্রেস থেকে সংগ্রহীত বিভিন্ন কাহিনী যেমন - বীর বালক বালিকা দের কাহিনী, রামায়ণ- মহাভারতের কাহিনী শোনান। এতে ঘরের আবহাওয়া ও সাত্ত্বিক হয়ে উঠবে।

প্রশ্নকর্তা : কীর্তি গুপ্তা
প্রশ্ন - মনের বিকার কিভাবে হয়?
উত্তর - কোটি কোটি জন্ম সংস্কার রয়েছে। কোন জন্মে হয়তো হিংস্র জানোয়ার, কোন জন্মে গোরুর মতো সাত্ত্বিক পশু, কোন জন্মে পাখি, কোন জন্মে মানুষ বা বৃক্ষ যোনিতে জন্ম হয়েছে। তবে, মানুষ কে সমস্ত বিকার  নির্মল করে তোলার ক্ষমতা দিয়েছেন।

ভগবান বলেছেন ---
बड़े भाग मानुष तन पावा। सुर दुर्लभ सब ग्रन्थनि दावा।।

দেবতা ও বলেছেন যে মনুষ্য যোনিতে জন্ম নেওয়ার ফলে কোটি জন্মের পাপ ধুয়ে যায়। কিন্তু নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে।

প্রশ্নকর্তা : গিরিজা দিদি
প্রশ্ন : যারা সবার ভালো করে, অন্যেরা তাদের ও খারাপ কেন করে ? এসময় কি করা উচিৎ?
উত্তর : ভগবান অন্যের ব্যবহার বদলানোর অধিকার আমাদের দেননি। এই অবস্থায় আমরা নিজেদের নির্বিকার রাখবো। আমরা শুধু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।