विवेचन सारांश
।। জ্ঞানের মাহাত্ম্য।।

ID: 4121
Bangla - বাংলা
রবিবার, 19 নভেম্বর 2023
অধ্যায় 4: জ্ঞানকর্মসন্ন্যাসযোগ
4/4 (শ্লোক 32-42)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিদুষী মাননীয়া বন্দনা বর্ণেকর মহাশয়া


পরম্পরা অনুযায়ী ঈশ্বরের বন্দনা, দীপ প্রজ্জ্বলন এবং গুরু -চরণ বন্দনার সাথে আজকের বিবেচন সত্র শুরু হলো। এটা ভগবদগীতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কর্মযাত্রায় আমরা সকলে জয়ই চাই। ( যেমন আজ ভারত -অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল খেলা এবং প্রতিটি ভারতীয় চায় যেন ভারত এই খেলায় জিতুক) । আমরা যশ চাই, অপযশ চাই না । আমরা সবসময়ই সিদ্ধি লাভ করতে চাই। আমাদের জীবন ও তেমনই একটা খেলা। অর্জুন ও এই খেলায়, যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ জিততেই চেয়েছিলেন। কিন্তু এক ভীষণ মানসিক চাপে পড়েছিলেন অর্জুন। তাঁর সারথী শ্রীকৃষ্ণ মোহপাশে বন্দী তাঁর জ্ঞানের অভাব থেকে তাঁকে বার করে এনেছেন এবং বিজয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। জীবনেও আমরা যখন পরিণামের অপেক্ষা করি, তখন আমরা আমাদের কর্মকে বোঝা বানিয়ে ফেলি। কিভাবে অনুকূল বা প্রতিকূল পরিবেশে আমরা কর্মের সমত্ব রাখতে পারি এবং কিভাবে আমাদের এই কর্মযাত্রাকে মধুর সঙ্গীতে পরিবর্তিত করতে পারি --- তা আমাদের শেখায় শ্রী গীতা। সমরাঙ্গনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর উপদেশ গীতার মাধ্যমে আমাদের সকলের জন্য দিয়েছেন। শিবমঙ্গল কবিতায় কয়েকটি সুন্দর পংক্তি আছে----

क्‍या हार में क्‍या जीत में किंचित नहीं भयभीत मैं संधर्ष पथ पर जो मिले यह भी सही वह भी सही

 এটাই আমাদের মানসিকতা যে আমরা হারতে চাই না। কিন্তু গীতা থেকে আমরা সমত্বের ভাবনা শিখি। কিভাবে কর্ম করলে তা বোঝা হয়ে উঠবে না, বরং তা অকর্মে পরিণত হবে --- গীতা অভ্যাসের দ্বারা আমরা তা জানতে পারি, জানতে পারি কিভাবে আমাদের জীবনযাত্রা মধুর হয়ে ওঠে। এসবের জন্য মনুষ্য জীবনে কিছু কাজ করার ও প্রয়োজন আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলেছেন... সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনে ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভগবান স্বয়ং পৃথিবীতে এসেছেন এবং চতু্র্বর্ণের সৃষ্টি করেছেন।।

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টম্

 গীতাতে যজ্ঞের কথা ও বলা হয়েছে। সমর্পণ দ্বারা করা কর্ম -- যা অকর্মে পরিণত হয় -- তাহাই যজ্ঞ।
 আমরা সপ্তদশ অধ্যায়ে দেখেছি, এই যজ্ঞ অনেক প্রকারের হয় -- যজ্ঞ দ্বারা আমাদের অশুদ্ধতা দূর হয়, মহান ব্যক্তিদের জীবন যজ্ঞময় হয়ে থাকে ।

4.32

এবং(ম্) বহুবিধা য়জ্ঞা, বিততা ব্রহ্মণো মুখে।
কর্মজান্বিদ্ধি তান্সর্বান্, এবং(ঞ্) জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে ꠱32꠱

এইরূপ আরও বহুপ্রকার যজ্ঞের কথা বেদে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এ সবই মন, ইন্দ্রিয়াদি ও কায়িক ক্রিয়ার দ্বারা সম্পন্ন হয় বলে জানবে, এইরূপ তত্ত্বতঃ জেনে এগুলির অনুষ্ঠান করলে তুমি কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হবে।

শ্রী ভগবান অর্জুন কে বললেন... যেমন যজ্ঞের শিখা উপর দিকে ওঠে এবং আলোকিত করে, তেমনই ব্যক্তির জীবনও উজ্জ্বলতর হয় ও উন্নতির পথে যায়। যজ্ঞ অনেক প্রকার হয়। পরমপিতা পরমাত্মা কে অর্পণ করে যে যজ্ঞ করা হয় সেই জ্ঞানযজ্ঞই সর্বোত্তম। জ্ঞান দুই প্রকার -- লৌকিক জ্ঞান ও অলৌকিক জ্ঞান ।

লৌকিক জ্ঞান -- যেমন সঙ্গীতের জ্ঞান, যন্ত্রের জ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান ইত্যাদি হলো লৌকিক জ্ঞান । এবং দ্বিতীয় টি হলো --
অলৌকিক জ্ঞান -- আত্মজ্ঞান, আত্ম স্বরূপের জ্ঞান, পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়ার জ্ঞান -- তত্ত্বজ্ঞান। এই হলো জ্ঞানযজ্ঞ, তাতে যা কিছু আহুতি দেওয়া হয় তা বেড়ে যায়। পদার্থের জ্ঞান এমনই, যা দান করলে বাড়ে। এটা শুধু কথার কথা নয়। জ্ঞানের এমনই গুণ যা কখনো নিঃশেষ হয়ে যায় না। গুরু তাঁর শিষ্য কে জ্ঞান প্রদান করেন এবং তা শিষ্যের আত্মজ্ঞান বর্ধিত করে, কিন্তু তাতে গুরুর জ্ঞান কমে যায় না, বরং বেড়ে যায়। জ্ঞানের এটাই মহিমা -- যত পরিমাণে আহুতি দেবে, ততই তা বাড়বে । কিন্তু অন্যান্য লৌকিক দ্রব্য আহুতি দিলে তা কমে যায়। গীতার প্রবচন কক্ষে যত মানুষ যুক্ত হয় -- ততজনেরই জ্ঞান বাড়ে এবং এই জ্ঞান অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে জ্ঞানের বৃদ্ধি হয় ।

4.33

শ্রেয়ান্দ্রব্যময়দ্যজ্ঞাজ্, জ্ঞানয়জ্ঞঃ(ফ্) পরন্তপ।
সর্বং(ঙ্) কর্মাখিলং(ম্)পার্থ , জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ꠱33꠱

হে পরন্তপ অর্জুন ! দ্রব্যময় যজ্ঞ হতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, কারণ সমস্ত কর্ম জ্ঞানেই সমাপ্ত হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন.... যজ্ঞের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো জ্ঞানযজ্ঞ।এই যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার মতো দ্রব্যের ঘাটতি কখনো হয় না। অবশিষ্ট যজ্ঞাদিতে দ্রব্য আহুতি দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞান যজ্ঞে দেওয়া আহুতি জ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কর্মের সমস্ত গতি এই জ্ঞানে এসে সমাপ্ত হয়। আমাদের অন্তিম গন্তব্য হলো জ্ঞান এবং এই জ্ঞান প্রাপ্ত করেই মুক্তি লাভ হয়। অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ ....

অন্নময় কোষ -- যা পাথরে রয়েছে।

প্রাণময় কোষ - যা বনস্পতিতে রয়েছে। গাছপালাতেও প্রাণের স্পন্দন আছে এবং তারাও শ্বাস নেয়।

মনোময় কোষ -- যা পশুপাখির মধ্যে আছে। পশুপাখি ও প্রেমের ভাষা বোঝে। তাদেরও মন কখনো প্রসন্ন থাকে, কখনো বা হতাশ। মানুষ তাদের ভালবাসা দিলে তারাও ভালবাসে, এবং আঘাত করলে উল্টো আঘাত করে।

বিজ্ঞানময় কোষ -- এ কেবল মানুষের মধ্যেই থাকে। বিচার বিবেচনা ও ভাবের আদান-প্রদান শুধু মানুষের দ্বারাই সম্ভব। অন্যান্য পশুরা ও তাদের বুদ্ধি ব্যবহার করে খাদ্য সংগ্রহ করতে। কিন্তু মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞান কে অনেক বেশি করে বুঝতে চেষ্টা করেছে। অধিকতর জ্ঞান- বিজ্ঞানের খোঁজে দলবদ্ধ হয়েছে। এই বুদ্ধিমান মানুষ ই অ্যাটম বম্বের মতো মারনাস্ত্র তৈরি করে নিজেদের জীবনে সংশয় ডেকে এনেছে। এই ভ্রম সংশোধন করেছে যাতে জীবন সুখময় হয়ে ওঠে। আজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষ সংযুক্ত হতে পেরেছে। এজন্য ভগবান বলেছেন... মানুষের যে বুদ্ধি আছে, তার সঠিক প্রয়োগে আত্মজ্ঞান প্রাপ্তির পথে যেতে পারে। কেবলমাত্র মানুষের সেই বুদ্ধি আছে যা দ্বারা পরমাত্মার সাথে একাত্ম হতে পারে। আমাদের মহানুভব সন্তরা, যাঁরা সেখানে পৌঁচেছেন তাঁরা চান মানুষ জ্ঞানের পথ ধরে চলুক... এবং এই পথে যাওয়ার বিধান ও তাঁরা দিয়েছেন। জ্ঞান প্রাপ্তির জন্য কোন বস্তুর প্রয়োজন নেই, কোন ক্রিয়ার ও প্রয়োজন নেই। জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন --- এমনকি বৈরাগ্যের ও আবশ্যিকতা নেই । কি করা উচিৎ বা উচিৎ নয়, বিবেকের এইসব সমস্যা ও শেষ হয়ে যায় -- তথা সহজে মূল স্বরূপ চিনে নেওয়া যায় এবং *আনন্দময় কোষ*এ পৌঁছে যাওয়া যায়। কর্ম তখন অকর্মে পরিণত হয় এবং কর্মের ফল পাওয়ার ভয় ও শেষ হয়ে যায়। এর পরে হার-জিৎ, সুখ-দুঃখ এসব ভাবনার উপরে গিয়ে সমত্বের ভাবনা আসবে। ভগবান অর্জুনকে বলেছেন -- এই ভাবনা অর্জন করার জন্য তোমাকে তাঁর কাছে যেতে হবে যিনি নিজে এগুলো জানেন।

ভগবান অর্জুনের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন যে জ্ঞানমার্গে যাওয়ার জন্য আমাদের সদ্গুরুর প্রয়োজন। এই জ্ঞান বই পড়ে বা ইন্টারনেট ভিডিও দেখে প্রাপ্ত করা যায় না। সেই ব্যক্তি, যিনি এই জ্ঞান অর্জন করেছেন, তাঁর কাছেই পৌঁছাতে হবে ।

4.34

তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন, পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং (ঞ্), জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ ꠱34꠱

সেই জ্ঞান তুমি তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে জেনে নাও ; তাঁদের বিনয়পূর্বক প্রণাম ও সেবা তথা কপটতা ত্যাগ করে সরলভাবে প্রশ্ন করলে সেই তত্ত্বদর্শী জ্ঞানিগণ তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে উপদেশ দেবেন।

শ্রী ভগবান অর্জুন কে বললেন -- তুমি সেই আত্মজ্ঞান লাভ কর', যাতে তোমার সমস্ত সমস্যা দূর হয়ে তুমি এক আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারো এবং এই জ্ঞান প্রাপ্ত করার জন্য তোমাকে তাঁর কাছে যেতে হবে যিনি ইতিমধ্যেই এই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন। কিন্তু, সেই গুরুর কাছে গিয়ে তাঁর কথা মেনে চলতে হবে। যেমন, কোন কোর্সে ভর্তি হতে গেলে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়, সেভাবেই সেই গুরুর কাছে জ্ঞান নিতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। সর্বপ্রথম হলো -- নম্রতা । প্রথমেই সাষ্টাঙ্গপ্রণাম কর' শ্রদ্ধা সহকারে এবং গুরুর সেবায় সমর্পিত হয়ে যাও। গুরুর সেবা করা ভগবান কে সেবা করার চেয়ে অনেক কঠিন । কারণ, আমরা ঘরে যে খাবার তৈরি করি, তা দিয়েই ভগবানের সেবা করি, তাও নিজের সময় অনুযায়ী । কিন্তু, গুরুর সেবা করতে হবে তাঁর সময় অনুসারে, স্থান অনুসারে। গুরুর সেবার জন্য তাঁর দিনচর্চা অনুসরণ করতে হয়। তাঁর জন্য যেটা আনন্দদায়ক সেভাবে তাঁর ভোগ প্রস্তুত করতে হবে । যিনি নিষ্কপট ভাবে গুরুর সেবা করেন, তিনি গুরুর কৃপা লাভ করেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন... যদি তুমি অকপট ভাবে নিজের জিজ্ঞাসু মন কে শান্ত করতে গুরুর থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত কর' তাহলে সেই জ্ঞান দ্বারা তোমার সমস্যার সমাপ্তি হবে ।

 ভগবান বলেছেন... এরূপ তত্ত্বজ্ঞানী গুরুর সান্নিধ্যে থেকে এবং সেবা করে তাঁর কৃপা পাওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের। গুরু কেমন হবেন তাও বলা আছে। গুরু তিনি -- যাঁর শাস্ত্রজ্ঞান আছে, শব্দের জ্ঞান আছে -- যাঁর লৌকিক এবং অলৌকিক জ্ঞান আছে। যিনি তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধিত যে কোন সমস্যার বিধান দিতে পারবেন। গুরু তিনি, যাঁর তত্ত্বজ্ঞানের সাথে সাথে দর্শন অর্থাৎ উপলব্ধির আনন্দ প্রাপ্তি হয়েছে। সেই গুরুর কাছেই তুমি জ্ঞান প্রাপ্ত করবে যিনি জ্ঞানের স্বাদ পেয়েছেন, একমাত্র তিনিই তা বলতে পারবেন, স্বাদ বোঝাতে পারবেন। কোন লৌকিক বিদ্যা যেমন -- ধনুর্বিদ্যা শেখার জন্য কোন প্রমুখ ধনুর্বিদের কাছে যেতে হতো, তার জন্য কোন পরীক্ষা ও দিতে হতো । আসলে গুরু জানতে চাইতেন ওই ধনুর্বিদ্যার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ কতটা। গুরুর প্রতি সমর্পিত হয়ে, তাঁর সঙ্গে থাকতে থাকতে সেই বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠতো। শিষ্য তো অনেক। কিন্তু, কেউ কেউ বিশেষ পারদর্শী হন, সকলে সমান ভাবে হন না। গুরুজী বলেন এই ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তর নির্ভর করে গুরুর প্রতি সমর্পণের মাত্রা অনুযায়ী।

  স্বামী বিবেকানন্দ নিজের গুরু শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ও পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি ভগবান কে কোন রূপে দেখেন... রামকৃষ্ণ উত্তরে বললেন তিনি ভগবান কে বিভিন্ন রূপে দেখেন... কখনো জগদম্বা রূপে তো কখনো কৃষ্ণ রূপে, কখনো রাম রূপে --- যে রূপে তিনি ভাবেন, সেই রূপেই দেখেন । এবার অন্য একটা পরীক্ষা করতে চাইলেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস সর্বদা বলতেন যে তিনি কামিনী কাঞ্চন থেকে শতহস্ত দূরে থাকেন । তাই তাঁর অগোচরে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা রামকৃষ্ণের বিছানার নীচে রেখে দিলেন । অজান্তে সেই বিছানা স্পর্শ মাত্রই তাঁর সারা শরীর জ্বালা করে উঠলো । তিনি স্থির থাকতে পারলেন না । সবাই কে ডাকলেন ও জিজ্ঞাসা করলেন কেউ কিছু করেছে কিনা । স্বামী বিবেকানন্দ স্বীকার করে নিলেন যে তিনি এরকম করেছেন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য । তাঁর এই জিজ্ঞাসায় গুরুদেব অতি প্রসন্ন হলেন ।

 জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন ---

विषयांचा विसरु पडे, इंद्रियांची कसमस मोडे।
मनाची घडी घडे, हृदयामाजीं ॥ १८८ ॥

 গুরু এমনই হবেন যাঁকে স্মরণ মাত্রই মনের অস্থিরতা শান্ত হয়ে যাবে, অহংকার বিমুক্ত হয়ে মনে সাত্ত্বিকতার অনুভূতি আসবে --- আরও ভালো কিছু শেখার ইচ্ছা জাগ্রত হবে মনে... এমনই মহিমা থাকবে গুরুর। গুরু সান্নিধ্যে চোখ আরও ভালো কিছু দেখতে চাইবে, কান ভালো কথা শুনতে চাইবে । সমস্ত ইন্দ্রিয় চাইবে আরও ভালো কিছু জানতে বা বুঝতে।

4.35

য়জ্জ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহম্,এবং(ম্) য়াস্যসি পান্ডব।
য়েন ভূতান্যশেষেণ,দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি ꠱35꠱

যা জানলে তুমি আর এইরূপ মোহগ্রস্ত হবে না এবং হে অর্জুন ! যে জ্ঞানের দ্বারা তুমি সমস্ত ভূতাদি নিরবশেষ প্রথমে নিজের মধ্যে এবং পরে সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মারূপী আমাতে দেখতে সক্ষম হবে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বললেন... গুরুদেবের কাছে যখন আত্মজ্ঞানের শিক্ষা নেবে , তারপর তুমি গুরুদেবের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে।

 অর্জুন নিজের কর্তব্য জানতেন। কিন্তু, নিজের পরিজনদের মোহে আপন কর্তব্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন । একজন ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়া কখনও শ্রেয়স্কর নয়। শ্রীকৃষ্ণ বললেন.. যদি তুমি আমার ভিতরে নিজেকে দেখো এবং আমার সাথে একাত্ম হয়ে যাও,তাহলে আমার মধ্যেই সবাই কে পাবে। আত্মজ্ঞান সম্পন্ন মহাত্মার সান্নিধ্যে তুমি পরমাত্মার সাথে ও একাত্মতা অনুভব করতে পারবে। এজন্যই যাঁরা সেইখানে পৌঁছাতে পেরেছেন, তুমি তাদের কাছে যাও। যাঁরা আমাদের সেই পথের দিশা দেখিয়েছেন, সেই পথে চলাই লাভ দায়ক হবে। মহাভারতে পাণ্ডবরা একে একে বনের মধ্যে জলের সন্ধানে গিয়ে যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে মৃত্যু বরণ করেছিলেন এবং অবশেষে জ্ঞানী ও অনুশাসন প্রিয় যুধিষ্ঠির যক্ষের প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিয়ে ভাইদের প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন যে তিনি কোন দিশায় যেতে চান...?? উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন.... সন্তের পথে যেতে চান...

    জ্ঞানেশ্বর মহারাজ বলেছেন....
    আত্মজ্ঞান হলো নিজের ভিতরে দেখা তত্ত্বজ্ঞান। এই জ্ঞান প্রাপ্ত হলে সবকিছু জ্ঞানচক্ষু দ্বারা দেখবে আর এ কেবলমাত্র গুরুর কৃপায় হতে পারে । গুরু যখন পরীক্ষা নেন তার বিশেষ কোন কারণ থাকে । না চাইতেও কাউকে খাদ্য বা পানীয় দেওয়া যায় কিন্তু, না চাইলে জ্ঞান কখনো দিতে নেই। আত্মজ্ঞান তো কিছুতেই বিনা চাওয়ায় দিতে হয় না ।

ऐसें ज्ञानप्रकाशें पाहेल, तैं मोहांधकारू जाईल।
जैं गुरुकृपा होईल, पार्था गा ॥ १७१ ॥

গুরু শিষ্যের পরীক্ষা নেন এবং গুরুর কৃপায় মোহ রূপ অন্ধকার দূর হয়ে যায়।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব গলায় ক্যান্সারের কারণে কিছু খেতে পারতেন না। এই দেখে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে প্রায়ই বলতেন যেন তিনি মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেন তাঁকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য । কিন্তু রামকৃষ্ণদেব হাসিমুখে বলতেন যে তিনি তো মায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন, তাহলে আর আলাদা করে কি চাইবেন ...
গুরু - শিষ্যের সম্বন্ধ হলো -- জ্ঞান রূপী নৌকায় সহযাত্রী হয়ে পাপ - পুণ্যের ভার থেকে মুক্ত হওয়া ।

4.36

অপি চেদসি পাপেভ্যঃ(স্), সর্বেভ্যঃ(ফ্) পাপকৃত্তমঃ।
সর্বং(ঞ্)জ্ঞানপ্লবেনৈব ,বৃজিনং(ম্) সন্তরিষ্যসি ꠱36꠱

যদি তুমি সমস্ত পাপীর থেকেও অধিক পাপী হও তা হলেও তুমি জ্ঞানরূপ নৌকার সাহায্যে নিঃসন্দেহে সমগ্র পাপসাগর উত্তীর্ণ হয়ে যাবে।

জ্ঞান রূপী নৌকায় যদি একবার সওয়ার হতে পার', তাহলে তুমি পাপ- পুণ্যের কল্পনা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে এবং আনন্দ সাগরে ভাসবে। এই পাপ ও পুণ্যের পরিভাষা স্পষ্ট হওয়া উচিত ।

পাপ কি??
  যদি আরাধ্য দেবতা কে ভোগ দিতে দেরি হয়ে যায়, যদি শিবের মাথায় বেলপাতা দেওয়া না হয় বা, সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো না হয়ে থাকে ... এগুলো পাপ নয়। পাপ হলো, কাউকে শোষণ করা, মন থেকে কারো খারাপ চাওয়া কিংবা কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলা। এই পাপ রূপী সাগর ও জ্ঞান রূপ নৌকায় পার করা যায়। অন্তরঙ্গ শুদ্ধ হওয়া শুরু হলে পাপ থেকে মুক্তির পথ ও খুলে যায় ।

  শুকদেব জী শিব ভাগবত এ বলেছেন...
  অন্তঃকরণ দোষ মুক্ত তিন প্রকারে হয় --
১) জ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়া
২) নিয়ম পালন করা
৩) প্রায়শ্চিত্ত করা

  আজকাল মানুষ জ্ঞানের পথ ধরে এগোবে তো সেটাও সবাই কে জানিয়ে দেয় । একটু কিছু করেই স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেকে প্রচার করে। কিন্তু নিজের দোষ কখনো প্রকাশ করে না ।

4.37

যথৈধাংসি সমিদ্বোऽগ্নিঃ(র্), ভস্মসাৎকুরুতেsর্জুন ।
জ্ঞানাগ্নিঃ(স্) সর্বকর্মাণি ,ভস্মসাৎকুরুতে তথা ꠱37꠱

কারণ হে অর্জুন ! প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন ইন্ধনকে ভস্মীভূত করে, জ্ঞানরূপ অগ্নিও তেমনই সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে।

আমাদের ভিতর তিন প্রকার অগ্নি আছে...
কামাগ্নি, জঠরাগ্নি ও জ্ঞানাগ্নি

কামাগ্নি:- যার কারণে আমরা কামনা ও ক্রিয়ার মোহে বদ্ধ হয়ে থাকি

জঠরাগ্নি :- উদরের বা পাচন তন্ত্রের ক্রিয়া ।

জ্ঞানাগ্নি:- এই অগ্নিই হলো সর্বোত্তম কারণ, যখন এই অগ্নির জন্ম হয়, তখন শুধুমাত্র কামনা পূরণের ইচ্ছা বা উদর পুর্তি করার ইচ্ছা নয়, বরং আমাদের কিছু না কিছু পড়ার ইচ্ছা জাগে, কিছু ভালো কাজ করতে ইচ্ছা হয়। আমাদের বিবেক জাগ্রত হয়। ভগবদগীতা আমাদের ভিতর এই জ্ঞান রূপ অগ্নির জন্ম দেয়। গীতাব্রতী থেকে শুরু হয়ে পাঠক, পথিক ইত্যাদি পরীক্ষায় কিছু না কিছু আহূতি দিতে দিতে শেষ চরণ অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে কর্মের চলাচল শান্ত হয়ে যায় এবং ফলাফলের লালসা থেমে যায় । আম গাছ ছয় থেকে সাত বছর সময় নেয় ফল দিতে। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হতেও বেশ সময় লাগে। যখন এই ফল আসে তাকে প্রারব্ধ বলা হয়। যখন সমস্ত কর্ম ফলীভূত হয়ে যায় বা হয় না, তখন সবকিছুর সঞ্চিত ভাণ্ডার ভস্মীভূত হয়ে যায়। এজন্যই ভগবান অর্জুন কে বলেছেন যে এই সমস্ত কর্ম ফল জ্ঞানাগ্নি তে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

4.38

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং(ম্) ,পবিত্রমিহ বিদ্যতে।
তৎস্বয়ং(ম্) যোগসংসিদ্ধঃ(খ্) কালেনাত্মনি বিন্দতি ꠱38꠱

নিঃসন্দেহে এই জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্রকারী আর কিছুই নেই। দীর্ঘকাল প্রযত্ন দ্বারা কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হলে সাধক স্বয়ংই নিজের মধ্যে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন।

সোনাতেও যা অশুদ্ধি আছে তা আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করা হয়। এইভাবে গীতার প্রবচন ও পাঠে সংসারের অশুদ্ধতা, মলিনতা দূর হয়ে যায়। যেমন জল দিয়ে আমরা বাইরের ময়লা পরিষ্কার করি, তেমনই গীতার প্রবচন দ্বারা অন্তরের ময়লা ধুয়ে যায় এবং মন শুদ্ধ হয়ে যায়। এ হলো ব্রহ্মবিদ্যা ও যোগশাস্ত্রের এক সম্পূর্ণ জ্ঞান । মানা হয়, ব্রহ্মবিদ্যা বিজ্ঞানসম্মত এবং যোগশাস্ত্র এক প্রায়োগিক শাস্ত্র। গীতার জ্ঞান সর্বোচ্চ জ্ঞান। কাম বা ক্রোধ রূপী দানব জীবন কে টলিয়ে দেয়, গীতার প্রবচন ও পাঠ অন্তরঙ্গ পরিষ্কার করে দেয় , তাই এর প্রয়োজন আছে। রসগোল্লার আকার ও রঙ দেখে বোঝা যায় এটা রসগোল্লা। কিন্তু না খেলে বোঝা যাবে না এর স্বাদ কিরকম সেরকম ভাবে কোন বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত করে তবে তার অনুভূতি লাভ করা যায়। কর্ম যোগ দ্বারা ফলের আশা ত্যাগ করে অনুভূতি লাভ হয়। গুরু মার্গ দর্শন করান, কিন্তু তা অভ্যাস করতে সময় লাগে । এবং এই সময় নির্ভর করে অভ্যাসের উপর।

  দেবর্ষি নারদের কাছে একজন শিষ্য এসে জিজ্ঞাসা করল... তত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্ত করতে কতদিন লাগতে পারে ? দেবর্ষি একটি গাছের দিকে দেখিয়ে বললেন... ওই গাছে যতগুলো পাতা আছে তত বছর লাগবে এই জ্ঞান প্রাপ্ত করতে । সেই শিষ্য নিরাশ হয়ে চলে গেল । পরে অন্য একজন এসে একই প্রশ্ন করল... এবং নারদ জী একই উত্তর দিলেন । কিন্তু এই শিষ্য ভাবল... সময় অনেক লাগবে, কিন্তু অসম্ভব তো নয়। সে গুরুর শরণে থেকে গেল। দৃষ্টিকোণের তফাৎ শুধু । ক্ষেতে বীজ বপন করে প্রতিদিন দেখলেই ফল তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না । ঠিক সময় ফল ফলবে ।

  ভগবান বলেছেন যে কর্ম কে কর্ম যোগে পরিণত করলে ফল প্রাপ্ত হবে ।

4.39

শ্রদ্ধাবাঁল্লভতে জ্ঞানং(ন্), তৎপরঃ(স্) সংয়তেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং(ম্) লব্ধ্বা পরাং(ম)শান্তিম্ , অচিরেণাধিগচ্ছতি ꠱39꠱

জিতেন্দ্রিয়, সাধনপরায়ণ, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই ভগবৎ প্রাপ্তিরূপ পরমশান্তি লাভ করেন।

ভগবান বলেছেন যে শ্রদ্ধা বিহীন হয়ে কর্মযোগের ফল পাওয়া যায় না । জ্ঞান যেমন গীতার এক গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, শ্রদ্ধা ও তেমনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। কোন বস্তু পাওয়ার জন্যও তিনটি কথা মনে রাখতে হয় --- শ্রদ্ধা, তৎপরতা ও নিয়ম। শ্রদ্ধা থাকলেই অন্তরে তা অনুভব করা যায় । যেমন, জ্যামিতি শেখানোর জন্য বিন্দুর ব্যাখ্যা দেওয়া হয় --- বিন্দু, যার কোন দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, উচ্চতা নেই । পদার্থবিদ্যা শেখার সময় ও পরমাণুর অস্তিত্ব অনুমান করে নেওয়া হয়। যদি কেউ বলে আগে পরমাণু দেখবো তবে বিশ্বাস করবো , তাহলে তো তার পড়া হবেই না। প্রথমে এই যে আকার মেনে নেওয়া, এটাই হলো শ্রদ্ধা । শ্রদ্ধা দ্বারা ই সব মান্য করতে হবে। ভগবান খুব সুন্দর বাক্যে বলেছেন ---

-- শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্ ।

4.40

অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ , সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।
নায়ং(ম্) লোকোsস্তি ন পরো ,ন সুখং(ম্) সংশয়াত্মনঃ ꠱40꠱

বিবেকরহিত ও শ্রদ্ধাহীন সংশয়াকুল ব্যক্তি পারমার্থিক পথ হতে অবশ্যই ভ্রষ্ট হয়। এইরূপ সংশয়াত্মার ইহলোকও নেই, পরলোকও নেই এবং সুখও নেই।

ভগবান বলেছেন হে অর্জুন, কিছু মানুষ এমন হয় যারা কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা রাখে না এবং তাদের জীবন ভঙ্গুর হয়ে যায়। ছোট বাচ্চা যখন বড়োদের সাথে মন্দিরে যায়, তখন বড়োদের দেখে সে ও ভগবানের সামনে মাথা ঠেকায়। শ্রদ্ধা সেখান থেকে শুরু হয়। এই শ্রদ্ধা বড়োর প্রতি । কিন্তু কিছু মানুষ বিভ্রান্ত থাকে। তার বুদ্ধি ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় ।

  ভগবান বলেছেন... এইসব মানুষের মনে কখনো শ্রদ্ধা থাকে না এবং সর্বক্ষণ তারা সংশয়ে থাকে। কোন বস্তুর সম্বন্ধে জানতে গেলে প্রথমে মানতে হবে। ভগবান বলেছেন এই ধরনের মানুষ সংশয় পূর্ণ থেকে নিজের জীবন নষ্ট করে ফেলে। ইহ জীবনে এরা সুখ পায় না এবং পরলোকে ও এরা অসুখী থাকে । এদের পরমাত্মিক শান্তি প্রাপ্ত হয় না ।

  नमामीशमीशान निर्वाणरूपं विभुं व्यापकं ब्रह्मवेदस्वरूपम्

তুলসীদাস জী রুদ্রাষ্টকমে খুব সুন্দর শব্দে বলেছেন ... যে শ্রী রামের সাকার রূপে ভক্তি রাখে সে তাঁর নির্গুণ রূপের ও অতি সুন্দর বিবরণ দেয়। শ্রী রামচন্দ্রের রূপ মূর্তিতে অবতীর্ণ হোক এবং আমাদের মার্গ দর্শন করান । ভগবান বলেছেন... যে সংশয়ে থাকে সে শান্তি প্রাপ্ত হয় না, এই লোকে ও না, পরলোকেও না।

4.41

যোগসন্ন্যস্তকর্মাণং(ঞ্),জ্ঞানসঞ্ছিন্নসংশয়ম্ ।
আত্মবন্ত (ন্) ন কর্মাণি, নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় ꠱41꠱

হে ধনঞ্জয় ! যিনি কর্মযোগের দ্বারা সমস্ত কর্ম পরমাত্মায় অর্পণ করেছেন এবং বিবেকের দ্বারা সমস্ত সংশয় নাশ করেছেন এইরকম বশীভূত-চিত্ত ব্যক্তিকে কর্ম কখনও বদ্ধ করতে পারে না।

ভগবান বলেছেন যে যোগ পথে চলে, সে ভক্তি মার্গ বোঝে না এবং যে ব্যক্তি ভক্তি পথে চলে সে যোগের পথ বোঝে না । তারা বলে আমরা যোগ, প্রাণায়ামাদি করবো, কিন্তু গ্রন্থ পাঠ করার কোন প্রয়োজন নেই । কিন্তু, ভগবান বলেন তিন যোগ ই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের সামগ্রিক কর্ম ভক্তিপূর্বক পরমাত্মা কে অর্পণ করে এবং আর কিছু সংশয় না থাকলে অন্ত:করণ শুদ্ধ হয় ও জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে।

  কর্মের সাথে সাথে আমরা পরমাত্মার অনুসন্ধান করবো এবং তাঁর সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করবো। যদি পরমাত্মার জ্ঞান আমরা পাই তাহলে আত্মজ্ঞানের পথে অগ্রসর হবো।কর্ম এবং কর্মফল থেকে অন্ত:করণ মুক্ত হবে ও কর্ম যাত্রা আনন্দময় হয়ে উঠবে।

4.42

তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং(ম্), হৃৎস্থং(ঞ্) জ্ঞানাসিনাত্মনঃ।
ছিত্ত্বৈনং(ম্) সংশয়ং(ম্)যোগম্ , আতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত ꠱42꠱

অতএব হে ভরতবংশীয় অর্জুন ! তুমি হৃদয়স্থিত এই অজ্ঞানজাত সংশয়কে বিবেকজ্ঞানরূপ তরবারির সাহায্যে ছেদন করে সমত্বরূপ যোগে স্থিত হও এবং যুদ্ধের জন্য উত্থিত হও।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন যে তুমি জ্ঞানের পথে অগ্রসর হয়ে যাও, কিন্তু কর্মের পথ ত্যাগ কর' না। যদি তুমি জ্ঞানের পথে চলতে থাকো এবং তাতেই মগ্ন হয়ে যাও তাহলে যুদ্ধের ময়দানে আপন কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে । নিজের অন্ত:করণ থেকে সংশয় দূর করে নিজের কর্মে প্রবৃত্ত হও।

এখানে বিবেচন সত্র সমাপ্ত হলো । এরপর প্রশ্নোত্তর সত্র শুরু হবে ।
::প্রশ্নোত্তর পর্ব::

প্রশ্নকর্তা : নীতা দিদি
প্রশ্ন : জুহ্বতি শব্দের অর্থ কি ?
উত্তর : জুহ্বতি শব্দের অর্থ হলো হবন করা |

প্রশ্নকর্তা : শীলা শর্মা দিদি
প্রশ্ন : আমরা যখন জ্ঞান অর্জন করি,তখন কর্ম মুক্ত হয়ে যায়। যদি আমরা এরকম পূজা করি যাতে প্রচুর বিধি - বিধান সহ কর্ম করতে হয়... তাহলে কি আমরা কর্মকাণ্ডের ফাঁসে আটকে যাবো ? আমাদের কি করা উচিৎ? দয়া করে মার্গ দর্শন করান।
উত্তর: জ্ঞানার্জন এবং কর্মকাণ্ড দুয়ের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। কিছুটা সময় ধরে দৈনিক পূজা, অনুষ্ঠান করা উচিৎ। এর ফলে আমাদের পরের প্রজন্মের মধ্যেও নিজ ধর্মের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। নাহলে তারা এ থেকে দূরে চলে যাবে। সৃষ্টির পরিচালিকা দেবী মায়ের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যও পূজা পাঠ করার প্রয়োজন আছে। আমাদের জাগতিক উন্নতির জন্য দেবীর আশীর্বাদ অবশ্য চাই । স্বামীজি বলেন... মানুষের জন্য জাগতিক উন্নতির ও প্রয়োজন এবং মহানতার ও প্রয়োজন । অতএব দুয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকুক ।

প্রশ্নকর্তা: অর্চনা দিদি
প্রশ্ন : চৈতন্য মহাপ্রভুর সম্বন্ধে বলুন । তিনি কার উপাসক ছিলেন ?
উত্তর : চৈতন্য মহাপ্রভু বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী এবং শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের অনন্য ভক্তিতে লীন হয়ে থাকতেন ।
হরি ওঁ তৎসৎ