विवेचन सारांश
আসুরী গুণ - ক্রোধ, লালসা এবং লোভ
প্রথামাফিক দীপ প্রজ্জ্বলন, গুরু বন্দনা দ্বারা ষোড়শ অধ্যায়ের দ্বিতীয় ভাগ বিবেচন সত্র শুরু হলো । শ্রী গুরুর কৃপায় আমাদের অন্ত:করণ গীতা জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।
ব্যাসেন গ্রথিতাং(ম্) পুরাণমুনিনা মধ্যেমহাভারতম্।
অদ্বৈতামৃতবার্ষিণীং(ম্) ভগবতীমষ্টাদশাধ্যায়িনীম্
অম্ব ত্বামনুসন্দধামি ভগবদ্গীতে ভবদ্বেষিণীম্ ॥1॥
ভাবার্থ - হে ভগবদগীতা! নারায়ণ যাঁর মাধ্যমে পার্থ ( অর্জুন) কে জ্ঞানালোকিত করেছিলেন -- এবং যা মহাভারতের একদম মধ্যখানে অবস্থিত, প্রাচীন ঋষি ব্যাসদেব দ্বারা সংকলিত। হে গীতা, হে মোক্ষদায়িনী... যাঁর উপরে অদ্বৈত অমৃত বর্ষিছে, যিনি অষ্টাদশ অধ্যায় ধারিনী হে গীতা মা! আমি ধ্যানমগ্ন হই।
আগের বিবেচন সত্রে প্রথম তিনটি শ্লোকের বিশ্লেষণ হয়েছে। এই অধ্যায় হলো 'দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ ' যা বিভাজন করে পাওয়া যায় দৈব ( দেবতা সম্বন্ধীয়) এবং আসুরী ( অসুর সম্বন্ধীয়) । সুতরাং, এই অধ্যায়ে শ্রী ভগবান দৈবী ও আসুরিক গুণের কথা বলেছেন।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে -- কেন শ্রীকৃষ্ণ এই দুই গুণের তুলনা করেছেন। আসলে এটা দ্বারা একটা সংবেদনশীলতা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যাতে মানুষ দৈবী গুণের প্রতি প্রভাবিত হয়ে নিজের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করে ও এক পবিত্র পথে জীবনকে চালিত করে। আর আসুরী গুণের সম্পর্কে জেনে মানুষ যেন খারাপ গুণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে সেগুলো থেকে দূরে থাকে।
সিনেমা বা সিরিয়ালের ভালো চরিত্রের মানুষ দের ই আমরা পছন্দ করি। খল চরিত্রে অভিনয় করা মানুষ দের অপছন্দ করে থাকি। অভিনয় করার জন্য তারা খারাপ চরিত্র ফুটিয়ে তোলে, বাস্তবে কিন্তু কেউই খারাপ হতে চায় না। রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি সিরিয়ালেও নায়ক হিসাবে রাম বা বিভীষণ, অর্জুন বা যুধিষ্ঠিরের মতো হতে চায় -- রাবণ, শূর্পনখা, দুর্যোধন বা দু:শাসনের মতো হতে চায় না কেউই। সবাই রামের চরিত্র ও গুণাবলী অনুসরণ করতে চায়। যদিও এসব মানুষের উপর নির্ভর করে... সে ভালো হতে চাইবে কি না ।
এখন আমরা আসুরিক গুণের কথা জানবো, যা কখনো অনুসরণ করা উচিৎ নয়।
আজকের সত্র আসুরী গুণাবলী নিয়ে। ভগবান বলেছেন -
16.4
দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ, ক্রোধঃ(ফ্) পারুষ্যমেব চ৷
অজ্ঞানং(ঞ) চাভিজাতস্য, পার্থ সম্পদমাসুরীম্৷৷4৷৷
▪️এই ধরনের মানুষরা মন্দিরে যায় এবং শুধু লোক দেখানোর জন্য পূজা অর্চনা করলেও এদের মন মন্দিরের বাইরে থাকতেই স্বচ্ছন্দ্য।
▪️আরেক ধরনের মানুষ আছে যারা বাড়িতে অতিথিদের অপেক্ষা করিয়ে অনেক সময় ধরে পূজা করে -- তারা দেখায় যে অন্য কাজে পূণ্য হয় না।
▪️ দম্ভের আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যায় ছাত্রদের নিয়ে -- কিছু ছাত্র আছে যারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যায় জেনেও প্রভাবশালী দলে যুক্ত হয়... তাদের চোখে ভালো সাজার জন্য। এটাও এক ধরনের দম্ভ প্রকাশ।
এরপরে ভগবান আরও দুটি আসুরী গুণের কথা বলেছেন --
মানুষের মন "আমি " ও " আমার" ভাব তৈরী করে ( অহংকার ও মমত্ব)। যখন এই আমির সাথে গর্ব যুক্ত হয় -- যেমন, আমি ব্রাহ্মণ সন্তান, আমি সুন্দর, আমি ধনী ইত্যাদি। এগুলোই হলো অহংকার। "আমার" ভাবের সাথেও গর্ব জুড়ে -- আমার বাড়ি, আমার সম্পদ , আমার বুদ্ধিমত্তা --- এ হলো দর্প। কোন কিছু নিয়েই গর্ব করা উচিৎ নয়। কারণ, এ সবের কোন স্থায়িত্ব নেই। এইসময় যার কাছে ধন-দৌলত আছে, রূপ আছে... ভবিষ্যতে তার তা নাও থাকতে পারে। তখন এগুলো অর্জন করা তার পক্ষে কঠিন হবে। বিশেষত এগুলোর প্রতি আসক্তি থাকলে... বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে খুবই বেদনাদায়ক হবে। এজন্যই ভগবান বলেছেন -- দম্ভ-দর্প এবং অভিমান ভালো গুণ নয়।আর এসব গুণের অধিকারীরা আসুরী প্রকৃতির।
এরপর ভগবান যোগ করেছেন -- ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতা( পারুষ্যম)ও আসুরী গুণের অন্তর্ভুক্ত। এই অধ্যায়ের ২১ নম্বর শ্লোকে ভগবান নির্দিষ্ট করেছেন যে -- কাম, ক্রোধ এবং লোভ হলো নরকের প্রবেশ দ্বার। কেউ যদি এই তিনটি গুণের বিশ্লেষণ ও করে, তাহলেও এগুলোর মুখোমুখি হওয়া কঠিন। এগুলো মানুষ ভিতরে রাখে ঠিকই, কিন্তু একবার অভিব্যক্ত বা প্রকাশিত হয়ে গেলে তা আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না ( ঠিক নয় জেনেও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না) ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৬৩ নম্বর শ্লোকে শ্রী ভগবান ব্যাখ্যা করেছেন ---
স্মৃতিভ্রংশাদ্বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ||
অর্থাৎ - ক্রোধ থেকে মূঢ়ভাব উৎপন্ন হয়, মূঢ়ভাব থেকে স্মৃতিবিভ্রম হয়, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ হয় এবং তা থেকে পতন হয়।
ভগবান উপরিউক্ত শ্লোক দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে ক্রোধ মানুষ কে শেষ করে দেয়। কারণ, মানুষের মন, বুদ্ধি এবং স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়, উন্মত্তের মতো আচরণ করে -- দামী জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দেয় ইত্যাদি ।
এমনকি ভগবান ষষ্ঠ অধ্যায়ে দেখিয়েছেন কিভাবে সেই পরমেশ্বরের উপর শুধু ভরসা রাখতে হয়। এরপর ভগবান সপ্তদশ অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেছেন সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক... এই তিন গুণের। কেউ যদি সাত্ত্বিক ক্রিয়ায় নিজেকে নিবদ্ধ রাখে এবং নিয়মিত প্রাণায়াম ইত্যাদি করে, তবে তার মধ্যে দৈবিক গুণাবলী উন্নত হবে এবং সে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হবে না। চতুর্দশ ও সপ্তদশ অধ্যায়ে দেখিয়েছেন কিভাবে দৈব গুণ বাড়াতে হয়।
পঞ্চম আসুরী গুণ হিসাবে ভগবান বলেছেন "অজ্ঞানতা"। কখনো কখনো বিবেক জাগ্রত হয় না -- যার ফল হলো অধার্মিক ক্রিয়া । যা বেশিরভাগই অজান্তে হয়।
দৈবী সম্পদ্বিমোক্ষায়, নিবন্ধায়াসুরী মতা৷
মা শুচঃ(স্) সম্পদং(ন্) দৈবীম, অভিজাতোসি পাণ্ডব৷৷5৷৷
উল্টো দিকে আসুরী গুণের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষ বন্ধনে জড়িয়ে থাকে এবং প্রকৃত আনন্দের অভাবে জীবনে বেদনা, দুঃখ ও উদ্বেগ পূর্ণ থাকে।
অর্জুন কে ভগবান আশ্বাস দিয়েছেন -- যে অর্জুনের উদ্বেগের কারণ নেই, কারণ সে(অর্জুন) ইতিমধ্যেই সকল দৈব গুণ সমন্বিত। এই আশ্বাসের কারণে অর্জুন মহাভারতের নায়ক হতে পেরেছেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের চোখেও তিনিই নায়ক। সকলের অর্জুনের মতো গুণ প্রাপ্ত করা উচিৎ। কারণ, ভগবান নিজে অর্জুনের প্রশংসা করে নিশ্চিত করেছেন যে তিনি সত্যিই একজন দৈবী গুণসম্পন্ন।
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেস্মিন্, দৈব আসুর এব চ৷
দৈবো বিস্তরশঃ(ফ্) প্রোক্ত, আসুরং(ম্) পার্থ মে শৃণু৷৷6৷৷
ধরা যাক, একজন রোগী কে ডাক্তার নির্দিষ্ট কিছু মিষ্টি খেতে নিষেধ করেছেন। এক্ষেত্রে ঠিক কোন মিষ্টিগুলো খাওয়া উচিত নয় সেটা বিশেষভাবে জানতে হবে। এই জ্ঞান ছাড়া কোন ব্যক্তি সেই মিষ্টি চিনতে পারবে না বা পরামর্শ মেনে চলতে পারবে না। সুতরাং প্রবৃত্তি( কিছু অভ্যাস তৈরি করা) এবং নিবৃত্তি ( কিছু অভ্যাস ত্যাগ করা) ... দুইয়ের জন্যই জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
শ্রী ভগবান বুঝিয়েছেন যে , জীবনে নায়ক হতে গেলে কিছু ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে হবে। আত্ম- উন্নতির জন্য কি ত্যাগ করতে হবে সেটা বুঝতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী শ্লোকে তিনি সেগুলোর কথা বলেছেন ।
পার্থ (অর্জুন কে) সম্বোধন করে তিনি শ্লোক টি শেষ করেছেন ।
প্রবৃত্তিং(ঞ) চ নিবৃত্তিং(ঞ) চ, জনা ন বিদুরাসুরাঃ৷
ন শৌচং(ন্) নাপি চাচারো, ন সত্যং(ন্) তেষু বিদ্যতে৷৷7৷৷
তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না। বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ শুচিতা (শৌচম্) তাদের নেই। তাদের মন বিভিন্ন ধরনের চিন্তায় ভরে থাকে। তারা কারও সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না এবং তাদের মধ্যে সত্যবাদীতার ও (সত্যম্) অভাব আছে। তারা উদ্ধত ও অবাধ্য।
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং(ন্) তে, জগদাহুরনীশ্বরম্৷
অপরস্পরসম্ভূতং(ঙ), কিমন্যৎ কামহৈতুকম্৷৷8৷৷
আস্তিক : যারা আত্মা বা ব্রহ্মে বিশ্বাস করে। তাদের তিন প্রকারে সংজ্ঞায়িত করা যায় --
- যারা বেদের জ্ঞান কে নিশ্চিতভাবে মান্য করে।
- যারা আত্মন বা ব্রহ্মের অস্তিত্ব মান্য করে।
- যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী।
নাস্তিক : বিপরীতে, যারা আস্তিকতার কোন কিছু মানে না -- যারা আত্মার অস্তিত্বে ও বিশ্বাসী নয়।
অসত্যম্ : সত্য বলে কিছু নেই ।
অপ্রতিষ্ঠন্তে : আধারহীন
জগদাহুরনীশ্বরম্ : ঈশ্বরহীন
অপরস্পরসম্ভূতং : কারণ হীন ( কিভাবে এই জগৎ সৃষ্টি হলো)
কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ : যেন শুধু নারী ও পুরুষের মিলনে জীবের সৃষ্টি এবং যৌন পরিতৃপ্তি ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই -- এরূপ দৃষ্টিভঙ্গী যাদের, তাদের চিন্তা ভাবনা স্বচ্ছ হয় না -- যা তারা ঘটতে দেখে, তাই বিশ্বাস করে। বস্তুত, দৃশ্যমান সবকিছুই সত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ -- দূরত্বের কারণে চাঁদ কে ছোট দেখায়। কিন্তু এর সত্যিকার আকার আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা পরম সত্য কে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এজন্যই আমাদের বেদ বা শ্রুতির সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। কেউ প্রশ্ন করতে পারে এই জগতের বিশাল বৈচিত্র্য নিয়ে। যেমন, বুদ্ধিমত্তার তারতম্য, চেহারার তারতম্য, সম্পদের অসাম্যতা এবং ক্ষমতার পার্থক্য। কর্ম-তত্ত্বে এর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে.... পূর্ব জন্মের কর্ম পরের জন্মে ও প্রবাহিত হয় ও তার প্রভাব পড়ে এ জন্মের পরিস্থিতিতে । আসুরী মনোভাবের মানুষ রা এই তত্ত্ব কে গ্রাহ্য করে না ।
এতাং(ন্) দৃষ্টিমবষ্টভ্য, নষ্টাত্মানোল্পবুদ্ধয়ঃ৷
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মাণঃ, ক্ষয়ায় জগতোহিতাঃ৷৷9৷৷
কামমাশ্রিত্য দুষ্পূরং(ন্), দম্ভমানমদান্বিতাঃ৷
মোহাদ্গৃহীত্বাসদ্গ্ৰাহান্ প্রবর্তন্তেশুচিব্রতাঃ৷৷10৷৷
- বাসনা (কাম): যা হলো আগুনের মতো। যা অতৃপ্ত ( দুষ্পূরম্) অর্থাৎ, যতই পূর্ণ হবে, চাওয়া তত বেশি হবে ।
- কপটতা ( দম্ভ) :
- গর্ব ( মদান্বিতা) :
- ঔদ্ধত্য (মান) :
চিন্তামপরিমেয়াং(ঞ) চ, প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ৷
কামোপভোগপরমা, এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ ৷৷11৷৷
আশাপাশশতৈর্বদ্ধাঃ(খ্), কামক্রোধপরায়ণাঃ৷
ঈহন্তে কামভোগার্থম্ , অন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্৷৷12৷৷
সঙ্গাৎসংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোऽভিজায়তে।।
ভাবার্থ : বিষয় চিন্তা করতে করতে মানুষের ঐ বিষয়ে আসক্তি জন্মে। আসক্তি থেকে কামনা উৎপন্ন হয় এবং কামনায় বাধা পড়লে তা থেকে ক্রোধের উৎপত্তি হয়।
ইদমদ্য ময়া লব্ধম্ , ইমং(ম্) প্রাপ্স্যে মনোরথম্৷
ইদমস্তীদমপি মে, ভবিষ্যতি পুনর্ধনম্৷৷13৷৷
এই অধ্যায়ের লক্ষ্য হলো আত্ম সচেতন হওয়া ওঠা যাতে প্রত্যেকেই নিজের জীবনের নায়ক হয়ে উঠতে পারে। শুধু অন্যের ত্রুটি দেখা নয়, বরং এটাই বুঝতে হবে সকলেই দৈব ও আসুরী গুণের মিশ্রণে তৈরি। তবে মানুষ ভেদে এই গুণের মাত্রার তারতম্য হয়।
অসৌ ময়া হতঃ(শ্) শত্রুঃ(র্) , হর্নিষ্যে চাপরানপি৷
ঈশ্বরোহমহং(ম্) ভোগী, সিদ্ধোহং(ম্) বলবান্ সুখী ৷৷14৷৷
এই ধরনের মানুষরা -
- ক্ষমতায় বিশ্বাস করে এবং আমি ই সঠিক এই মনোভাব পোষণ করে। এমনকি এদের ইচ্ছা পূরণে বাধা দিলে তাকে আহত বা নিহত করতে ও পিছপা হয় না ।
- তারা ভাবে, তারাই সর্বময় কর্তা
- শুধু জীবন উপভোগ করার জন্যই জন্ম নেওয়া।
- নিজেকে নিখুঁত ভাবে
- নিজেকে শক্তিশালী ভাবে
এরা ভাবে মানুষ খুন করে খুশি থাকবে। কিন্তু, বাস্তবে তা নয়। আসল আনন্দ কি তা তারা উপলব্ধি করতে পারে না এবং যা তাদের উপলব্ধি হয় না, সেটা তারা জানতে চায় না। শৈশব থেকে তারা কাম, ক্রোধ এবং লোভে নিয়োজিত থাকে। তাদের জন্য এগুলোই হলো এগিয়ে যাওয়ার উপাদান ।
আঢ্যোভিজনবানস্মি, কোন্যোস্তি সদৃশো ময়া ৷
যক্ষ্যে দাস্যামি মোদিষ্য, ইত্যজ্ঞানবিমোহিতাঃ৷৷15৷৷
- তারা ধনশালী
- তাদের প্রচুর লোকবল, আত্মীয় পরিজন রয়েছে।
- তাদের সমকক্ষ কেউ নেই।
- তারাই সঠিক
- তারা এটাও ভাবে যে, তারা এক নৈতিক জীবন যাপন করে এবং ত্যাগ স্বীকার করে ও অর্থ দান ও করে ।
অহংকারে অন্ধ হয়ে তারা মনে মনে ভেবে নেয় -- আমি তো বিত্তশালী পরিবারে জন্মেছি -- আমি ধনী ও ক্ষমতাবান। এজন্য আমি যা ইচ্ছা তাই করবো -- আমি কেন ভগবানের সামনে নত হতে যাবো ? আমি নিজে ভগবানের চেয়ে কম কিসে ?
অনেকচিত্তবিভ্রান্তা, মোহজালসমাবৃতাঃ৷
প্রসক্তাঃ(খ্) কামভোগেষু, পতন্তি নরকেশুচৌ৷৷16৷৷
- চঞ্চল /অস্থির
- তাদের মন তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
- পার্থিব বস্তুর সাথে গভীর বন্ধন
- অনৈতিক কর্মের দিকে চলে যায় এবং জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
আত্মসম্ভাবিতাঃ(স্) স্তব্ধা, ধনমানমদান্বিতাঃ৷
যজন্তে নামযজ্ঞৈস্তে, দম্ভেনাবিধিপূর্বকম্৷৷17৷৷
উদাহরণস্বরূপ -
▪️ সুবিধাজনক ভাবমূর্তি রাখার জন্য তারা পূজা অর্চনা, দান, যজ্ঞ ইত্যাদি করে -- এই ক্রিয়াগুলি যদি নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী না ও হয়.... তাহলেও তারা নিরুৎসাহিত হয় না।
▪️নির্ঘণ্টের মূহুর্ত যদি মন্ত্রীর আসতে দেরী হওয়ায় পেরিয়ে ও যায়... তবু্ও চিন্তা নেই। যজ্ঞের সূচনাও দেরীতে হবে ।
▪️পুরোহিতের নির্ভুল মন্ত্র উচ্চারণের প্রতি ও আগ্রহ থাকে না।
অহঙ্কারং(ম্) বলং(ন্) দর্পং(ঙ), কামং(ঙ) ক্রোধং(ঞ) চ সংশ্রিতাঃ৷
মামাত্মপরদেহেষু, প্রদ্বিষন্তোভ্যসূয়কাঃ৷৷18৷৷
- গর্ব (অহংকারং)
- ক্ষমতা ( বলং)
- ঔদ্ধত্য ( দর্পং)
- আকাঙ্খা ( কামং)
- ও রাগ (ক্রোধং)
পরের শ্লোকে শ্রী ভগবান এই প্রকৃতির মানুষের ভাগ্য কেমন হয় তা বলেছেন ---
তানহং(ন্) দ্বিষতঃ(খ্) ক্রূরান্, সংসারেষু নরাধমান্৷
ক্ষিপাম্যজস্রমশুভান্ , আসুরীষ্বেব যোনিষু৷৷19৷৷
আসুরীং(য়্ঁ) য়োনিমাপন্না, মূঢ়া জন্মনি জন্মনি৷
মামপ্রাপ্যৈব কৌন্তেয়, ততো য়ান্ত্যধমাং(ঙ্) গতিম্৷৷16.20৷৷
তারা সুখ বা আনন্দ ও পায় না এবং পরমধাম ও প্রাপ্ত করতে পারে না।
সুতরাং এখন যে ব্যক্তি সচেতন হয়েছে সে কিভাবে আসুরী গুণের মোকাবিলা করবে ?
তাকে প্রথম যা করতে হবে -- তাকে নিজের গুণাবলী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সঠিক পথে যাওয়ার জন্য দৈব গুণাবলীর পথ ধরতে হবে। এটা তাৎক্ষণিক কোন পরিবর্তন নয়... এর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে।
ত্রিবিধং(ন্) নরকস্যেদং(ন্), দ্বারং(ন্) নাশনমাত্মনঃ৷
কামঃ(খ্) ক্রোধস্তথা লোভঃ(স্), তস্মাদেতত্ত্রয়ং(ন্) ত্যজেৎ৷৷21৷৷
এই পরমধাম প্রাপ্ত করতে হলে নিজেকে সর্বোচ্চ সাত্ত্বিক গুণে উন্নীত করতে হবে। শ্রী ভগবান সপ্তদশ অধ্যায়ে এই সাত্ত্বিক গুণে কিভাবে উন্নীত হওয়া যায় তা বিস্তারিত বলেছেন ।
এতৈর্বিমুক্তঃ(খ্) কৌন্তেয়, তমোদ্বারৈস্ত্রিভির্নরঃ৷
আচরত্যাত্মনঃ(শ্) শ্রেয়ঃ(স্), ততো যাতি পরাং(ঙ) গতিম্৷22৷৷
- যে ব্যক্তি ওই তিন বিকার থেকে মুক্ত হতে পারে -- সে আর অন্ধকারের পথে, অধর্মের পথে ফিরে যায় না।
- সে তার যাত্রা ভগবানের দিকে (ধর্ম পথে) শুরু করতে পারে ।
- এমনকি সে ভগবানের পরমধাম ও প্রাপ্ত করতে পারে।
যঃ(শ্) শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য, বর্ততে কামকারতঃ৷
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি, ন সুখং(ন্) ন পরাং(ঙ) গতিম্৷৷23৷৷
তারা সুখ বা আনন্দ ও পায় না এবং পরমধাম ও প্রাপ্ত করতে পারে না।
সুতরাং এখন যে ব্যক্তি সচেতন হয়েছে সে কিভাবে আসুরী গুণের মোকাবিলা করবে ?
তাকে প্রথম যা করতে হবে -- তাকে নিজের গুণাবলী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সঠিক পথে যাওয়ার জন্য দৈব গুণাবলীর পথ ধরতে হবে। এটা তাৎক্ষণিক কোন পরিবর্তন নয়... এর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করতে হবে।
তস্মাচ্ছাস্ত্রং(ম্) প্রমাণং(ন্) তে, কার্যাকার্যব্যবস্থিতৌ৷
জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং(ঙ), কর্ম কর্তুমিহার্হসি৷৷24৷৷
শাস্ত্র - শিক্ষার জন্য একজন সঠিক গুরু ও তাঁর শিক্ষার উপর আস্থা রাখতে হবে। আবার কেউ নিজে নিজেও অধ্যয়ন করতে পারে।
পরের অধ্যায়ে অর্জুন প্রশ্ন তুলেছেন -- কাদের শাস্ত্রে প্রবেশাধিকার নেই ? ভগবান শ্রদ্ধা (বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি) সহ একজন জ্ঞানী শিক্ষকের থেকে শিক্ষা পাওয়ার তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করেছেন ।
প্রশ্নকর্তা : অজিথা কুমার জী
প্রশ্ন : সকলের মধ্যেই দৈবী ও আসুরী গুণ বর্তমান। মানুষের মধ্যে এই দুই গুণের আসা যাওয়ার কারণ কি?
উত্তর : সব মানুষ তিন গুণের ( সাত্ত্বিক -রাজসিক- তামসিক) মধ্যে ই থাকে। যদি কেউ নিজেকে সাত্ত্বিক গুণে ধরে রাখতে পারে, তাহলে তার মধ্যে দৈবী গুণের প্রভাব বাড়ে। ফলে বাকি দুই গুণের প্রভাব কমে যায়। আবার যদি রাজসিক বা তামসিক গুণের প্রভাব বেড়ে যায়... তখন তা আসুরী গুণে পরিণত হয়ে যায়। এই তিন গুণের চলাচল কিভাবে হয়... তা জানা যাবে চতুর্দশ অধ্যায়ে ।
প্রশ্নকর্তা : মহেশবাবু জী
প্রশ্ন : মন্ত্রের মানে না জেনেও কি মন্ত্রোচ্চারণ করা উচিৎ ?
উত্তর : হ্যাঁ । করা যায়। এর ফলেও পুণ্যার্জন হয়। স্বামী গোবিন্দ গিরি মহারাজ জী বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন -- যদি কেউ ভগবদগীতার ব্যাখ্যা না জেনেও শুধু পড়ে -- সেটাতেও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৭১ তম শ্লোকে ভগবান নিজে বলেছেন ___
সোऽপি মুক্তঃ শুভাঁল্লোকান্ প্রাপ্নুয়াৎ পুণ্যকর্মণাম্ ।।
এখানে দৈবাসুরসম্পদ্বিভাগযোগ নামক ষোড়শ অধ্যায় সমাপ্ত হলো ।