विवेचन सारांश
সগুণ ও নির্গুণ ভক্তি

ID: 4313
बंगाली - বাংলা
রবিবার, 14 জানুয়ারি 2024
অধ্যায় 12: ভক্তিযোগ
1/2 (শ্লোক 1-11)
ব্যাখ্যাকার: গীতা বিশারদ ড: আশু গোয়েল মহাশয়


শ্রীকৃষ্ণের পূজা, দীপ প্রজ্জ্বলন ও গুরুর চরণে পূজার মধ্য দিয়ে আজকের আলোচনা পর্ব শুরু হয়। ভগবানের পরম মঙ্গলময় কৃপায় আমরা এমন সৌভাগ্য লাভ করেছি যে আমাদের মানবজীবনকে সফল করার জন্য এবং এর সদ্ব্যবহার করার জন্য আমরা ভগবদ্গীতার আত্ম-অধ্যয়ন ও মননে মগ্ন হয়েছি। জানিনা এটা আমাদের বর্তমান জন্মের পুণ্য নাকি আমাদের পূর্বজন্মের পুণ্য নাকি আমাদের পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ নাকি কোন জন্মে আমরা কোন কোন সাধু মহাত্মার আশীর্বাদ পেয়েছিলাম, যার কারণে আমরা এমন সৌভাগ্য পেয়েছি যে গীতা শিখতে শুরু করলাম। আমরা যখন এই বিষয়ে কথা বলি, তখন হয়তো কেউ ভাবতেই পারেন যে এতে বড় কথা কী? ভগবদ্গীতা একটি গ্রন্থ। আমরা জীবনে অনেক কিছু শিখেছি এবং গীতা শেখার জন্য ফর্মও পূরণ করেছি। এখানে বলা প্রয়োজন যে গীতা পাঠ শুরু করা এবং আমাদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভগবানের কৃপা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে ভগবান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে যে ভগবদ্গীতা পাঠ করে সে আমাকে লাভ করে-

মামেবৈষয়ত্যসংশয়ঃ। 


যারা গীতা পাঠ করে তারা সকলেই যদি ভগবানকে প্রাপ্ত করে নিতে পারে, তবে নিশ্চয়ই তা এত সুগম বা সহজলভ্য হবে না যে কেউ চাইলেই স্বেচ্ছায় গীতা পাঠ করে নিতে পারবে। পূর্ববর্তী বহু জন্মে ভালো কাজের কারণেই একজন মানুষ ভগবদ্গীতা পাঠের জন্য ভগবানের কৃপা অর্জন করে । অতএব, আমাদের কখনই এটা ভাবা উচিত নয় যে আমরা গীতা পড়ার জন্য গীতা ক্লাস বেছে নিয়েছি, বরং এটাই সত্যি যে আমাদের গীতা পড়ার জন্য, বেছে নেওয়া হয়েছে।

বিগত পাঁচ হাজার তিন শত বছরে পৃথিবীর সকল সংস্কৃতির বিভিন্ন মহাপুরুষ ভগবদ্গীতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন এবং এর প্রশংসা করেছেন। অধিকাংশ জায়গায় দেখা গেছে ভগবদ্গীতার মত আর কোন গ্রন্থ নেই। গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা পরম শ্রদ্ধেয় শেঠজী শ্রী জয়দয়াল গোয়ান্দকা গীতার মুখবন্ধে লিখেছেন যে সমস্ত ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে গীতা ছাড়া আর কোন গ্রন্থ নেই যা মানুষের জন্য উপকারী। গীতা কোন ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি একটি মানব গ্রন্থ। কিভাবে তিলক লাগাতে হবে, কিভাবে পূজা করতে হবে, কি পূজা করতে হবে সে সম্পর্কে সমগ্র ভগবদ্গীতায় কোনো উল্লেখ নেই। যে কোন সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি সমান স্বাচ্ছন্দ্যে ভগবদ্গীতা পাঠ করতে পারেন, কারণ ভগবান এতে কোনো সম্প্রদায়কে সমর্থন করেননি বা বহিষ্কারও করেননি। ভগবান এতে এমন কথা বলেছেন যা গীতা ছাড়া অন্য কোন ধর্ম গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

য়ে য়থা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। 

ভগবান বলেছেন, "যে আমাকে যে রূপে পূজা করে, আমি সেই রূপেই তাকে প্রাপ্ত হই।"

দুর্যোধন পাণ্ডবদের তেরো বছরের বনবাসে পাঠালেন। তেরো বছর পর যখন পাণ্ডবরা ফিরে আসেন, তখনও দুর্যোধন রাজ্য দিতে অস্বীকার করেন। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, শান্তির দূত হয়ে পাণ্ডবদের জন্য পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্যোধন এই বলে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে তিনি পাণ্ডবদের একটি সূঁচের ডগা সমান জমিও দেবেন না। যুধিষ্ঠির এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই চাননি কোনো যুদ্ধ হোক এবং শেষ অবধি যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, অবশেষে মা কুন্তী রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে একজন দূত পাঠিয়ে তাকে জানিয়েছিলেন যে দুর্যোধন তার প্রজাদের প্রতি অনেক অবিচার করছে এবং একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে এর প্রতিকারের জন্য যুধিষ্টির নিজের দায় এড়াতে  পারেন না। মা কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে আদেশ করলেন যে একজন ক্ষত্রিয় নারী যে দিনের জন্য এক ক্ষত্রিয়ের জন্ম দেন, সেই দিন এসে গেছে। যুধিষ্ঠিরের উচিত একজন ক্ষত্রিয়র দায়িত্ব পালন করা এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া। মা কুন্তীর আদেশের পরই যুধিষ্ঠির যুদ্ধে রাজি হন।

যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কয়েক মাস লেগেছিল। একটি যুদ্ধক্ষেত্রের অনুসন্ধান করা হয়েছিল যেখানে এত বড় সৈন্যের সমাবেশ সম্ভবপর হতে পারে, হাতিদের জন্য একটি হাতিশালা তৈরি করা যেতে পারে, যজ্ঞের জন্য একটি যজ্ঞস্থল তৈরি করা যেতে পারে এবং সেই স্থানটি যেন একটি তীর্থস্থান হয় যেখানে যুদ্ধে সৈন্যরা মৃত্যুবরণ করলে স্বর্গলোক প্রাপ্ত করতে পারে। শিবির এবং শস্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছিল, আস্তাবল তৈরি করা হয়েছিল, কূপ খনন করা হয়েছিল এবং কয়েক মাস পরে এই স্থানে একটি বিশাল সেনাবাহিনী একত্রিত হয়েছিল। সৈন্যদল প্রথমবার মুখোমুখি হলে ভগবান ও অর্জুনের মধ্যে কিছু কথাবার্তা শুরু হয়। অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার রথটিকে দুই পক্ষের সেনাবাহিনীর মাঝখানে নিয়ে যেতে বললেন। অর্জুন বললেন,আমি উভয় সেনাবাহিনীকে দেখতে চাই। রথটি দুই সৈন্যের মাঝখানে অবস্থান করার সাথে সাথে অর্জুন দুঃখিত হয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলেন যে প্রভু আমি যুদ্ধ করতে চাই না। সাধু-মহাত্মাগণ বিশ্বাস করেন যে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তাঁদের মধ্যে কথোপকথন চলে। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ভগবান অর্জুনকে এমন অমর জ্ঞান দান করেছিলেন যা বহুযুগ ধরে মনুষ্য জীবনের পাথেয় ছিল। ভগবান অর্জুনকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেননি, বরং তিনি ভেবেছিলেন যে এই পরিস্থিতির মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণের জন্য তিনি এমন একটি উপদেশ প্রদান করবেন যা সমগ্র মানবজাতির জন্য পাথেয় হবে এবং তাই ভগবান অর্জুনকে  নিমিত্ত বানিয়ে আমাদের সকলকে ভগবদ্গীতার অমৃত দান করেছেন।

আমাদের অনেকেরই এই কথা মনে আসে যে কেন গীতা পাঠ দ্বাদশ অধ্যায় থেকে শুরু করা হয় ? প্রথম অধ্যায় থেকে কেন শুরু হয় না? এর পিছনে একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে তাই আপনি  যদি গীতাপাঠ আরম্ভ করতে চান তবে আপনার দ্বাদশ অধ্যায় থেকেই শুরু করতে হবে। ভারতে "Gateway of India" এবং "India Gate" দুটোই আছে। ব্রিটিশরা 1913 সালে মুম্বাইতে "Gateway of India" তৈরি করেছিল কারণ ব্রিটিশরা সেখান থেকে জাহাজে করে ভারতে প্রবেশ করত। কিন্তু পরে, যখন দিল্লিকে ভারতের রাজধানী করা হয় এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম দিল্লি থেকেই করা শুরু হলো, তখন ব্রিটিশরা 1921 সালে দিল্লিতে "India Gate" তৈরি করে। "India Gate" ভারতের সীমান্তে নির্মিত নয় বা এটি ভারতের প্রবেশদ্বারও নয়, তবে এটিকে "India Gate" বলা হয়। এর কারণ হল আপনি যদি ভারতকে সঠিকভাবে জানতে চান তবে আপনাকে ভারতের হৃদয়স্থল অর্থাৎ "India Gate" থেকে প্রবেশ করতে হবে এবং আপনি যদি ভারতে প্রবেশ করতে চান তবে আপনাকে "Gateway of India" দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। একইভাবে, আপনি যদি ভগবদ্গীতাকে শুধুমাত্র ক্রমানুসারে পাঠ করতে চান তবে আপনি প্রথম অধ্যায় থেকে ভগবদ্গীতা শুরু করতে পারেন অর্থাৎ "Gateway of India" থেকে, কিন্তু আপনি যদি ভগবদ্গীতার সারমর্ম জানতে চান তবে ভগবদ্গীতার দ্বাদশ অধ্যায়টি হল "India Gate"। দ্বাদশ অধ্যায় থেকে ভগবদ্গীতার অধ্যয়ন শুরু করে আমরা সরাসরি ভগবদ্গীতার অন্তরে প্রবেশ করি। দ্বাদশ অধ্যায়টি বিশটি শ্লোকের সংক্ষিপ্ততম অধ্যায় এবং এই অধ্যায়টির বিষয়টিও হলো গুরুত্বপূর্ণ "ভক্তিযোগ"। এমনকি যদি কেউ, কোনো কারণে, ভগবদ্গীতার শুধুমাত্র দ্বাদশ অধ্যায়টিও অধ্যয়ন করতে সক্ষম হয়, তবে সে অন্ততপক্ষে ভক্তিযোগ প্রাপ্ত করে নিতে পারবে। এর চেয়ে উপকারী অধ্যায় আর কিছু নেই। তাই দ্বাদশ অধ্যায় থেকে ভগবদ্গীতা শুরু করার রীতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে।

গীতার সমস্ত অধ্যায়কে যোগ বলা হয়েছে। যোগ মানে "যুক্ত করা"। যে পথ দিয়ে ভগবানের সাথে সাক্ষাৎ হয়, তা হল যোগ। ভগবদ্গীতা হল ভগবান কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে একটি কথোপকথন, কিন্তু ভগবান বেদব্যাস এটিকে আমাদের জন্য সুগম করার জন্য বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন যাতে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে কোন বিষয়টি কোথা থেকে শুরু হয়। আর তা শেষই বা কোথায় হলো? এইভাবে সমগ্র ভগবদ্গীতা বিভিন্ন যোগের আকারে আঠারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অর্থ কি? ভাগবৎ মহাপুরাণ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মধ্যে পার্থক্য কী? শ্রীমদ্ভাগবৎ মহাপুরাণ হল আঠারোটি পুরাণের মধ্যে একটি, যাতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের লীলা চরিত্র রয়েছে যা আমরা প্রায়ই সাত দিনের গল্প বা নয় দিনের গল্প আকারে শুনি এবং দেখি। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কোনো পৃথক গ্রন্থ নয়। মহাভারত হলো এক লক্ষ শ্লোকের বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থ এবং মহাভারতে আঠারটি পর্ব রয়েছে। তার মধ্যে ভীষ্মপর্বের পঁচিশতম অধ্যায় থেকে চল্লিশতম অধ্যায় পর্যন্ত আঠারোটি অধ্যায়কে ভগবদ্গীতা বলা হয়। সুতরাং, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অর্থ হল – শ্রীর সাথে যুক্ত ভগবানের গাওয়া গ্রন্থ। এই আঠারোটি অধ্যায়ে সাতশত শ্লোক আছে। প্রথম শ্লোকটি ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন, সঞ্জয় একচল্লিশটি শ্লোক বলেছেন, চুরাশিটি শ্লোক অর্জুন বলেছেন এবং পাঁচশ চুয়াত্তরটি শ্লোক  শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে।

ভগবান বেদব্যাস কখন গীতা রচনা করেছিলেন? মহাভারত কখন রচিত হয়? এটা জানার প্রশ্ন নয়, কারণ ভগবান বেদব্যাস ছিলেন ত্রিকালদর্শী। তিঁনি অতীত, ভবিষ্যত, বর্তমান দেখতে পেতেন। তাঁর এই দিব্য দৃষ্টি ছিল এবং তিনি সঞ্জয়কে এই দিব্য দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আমাদের জানতে হবে মহাভারতে কখন ভগবদ্গীতার উল্লেখ করা হয়েছে ? মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিনের পর্যন্ত্য চলেছিলো, যার দশম দিনে ভীষ্ম পিতামহ শরশয্যায় শায়িত হন। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে এই দুঃসংবাদ দিতে হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে পিতামহ ভীষ্মের সংবাদ জানান। তখন ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে সমস্ত ঘটনার বর্ণনা করতে বলেন। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন-
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুয়ুৎসবঃ ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয় ।। ১.১ ।। 

তখন সঞ্জয় বেদব্যাস প্রদত্ত দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা বলেন। কারো কারো মনে এই প্রশ্নও জাগে যে আমি রামের ভক্ত, শিবের ভক্ত, অথচ গীতা তো শ্রী কৃষ্ণ বলেছিলেন, তাহলে আমার তা শুনে কি লাভ? একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হল মহাভারতের এক লক্ষ শ্লোকে যেখানেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কিছু বলেছেন, সেখানে ভগবান বেদব্যাস তাঁকে "শ্রীকৃষ্ণ উবাচ, কেশব উবাচ, বাসুদেব উবাচ" ইত্যাদি নামে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মহাভারতের পঁচিশতম অধ্যায় থেকে চল্লিশতম অধ্যায়কে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বলা হয়েছে, সেখানে ভগবান বেদব্যাস ভগবান কৃষ্ণকে উপরোক্ত নামে সম্বোধন করেননি বরং তাঁকে শুধু "শ্রীভগবানুবাচ" বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরব্রহ্মরূপে কথা বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণের রূপে কথা বলেননি। যাদের ইষ্ট রাম, তাদের জন্য তিনি রাম হয়ে কথা বলেছেন, যাদের ইষ্ট শিব, তাদের জন্য তিনি শিব হয়ে কথা বলেছেন, যাদের প্রিয় দুর্গা তাদের জন্য তিনি দুর্গা হয়ে কথা বলেছেন। ভগবান বলেছেন "মামেকাং শরণং ব্রজ" অর্থাৎ নিজের আরাধ্যের শরণাগত হও।

এই প্রসঙ্গে নারায়ণ স্বামী ও শ্রবণের একটি গল্প আছে। দুজনেই খুব জ্ঞানী ছিলেন। নারায়ণ স্বামী ছিলেন ভক্তিমার্গী আর শ্রবণ জ্ঞানমার্গী ছিলেন। শ্রবণ দীর্ঘ সময় কোন সমাধান না পেয়ে একদিন নারায়ণ স্বামীজীর কাছে এসে বললেন, আপনাকে দেখে আমারও আপনার ভক্তি শিখতে ইচ্ছে করছে, দয়া করে আমাকে ভক্তি শিখিয়ে দিন। নারায়ণ স্বামী বললেন আপনি মুখ-হাত ধুয়ে জলখাবার খেয়ে আসুন, তারপর আমি আপনার তার সাথে কথা বলব। শ্রবণ বললেন “এর প্রয়োজন নেই”। কিন্তু নারায়ণ স্বামীজীর অনড় মনোভাব দেখে শ্রবণ তাঁর কথা এড়াতে পারলেন না, তাই হাত মুখ ধুয়ে এসে বসলেন। নারায়ণ স্বামী তার জন্য জল আনলেন। যদিও শ্রবণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন না, তবুও নারায়ণ স্বামী সম্মানার্থে, তিনি এক বা দুই চুমুক জল পান করে পাত্রটি সেখানেই রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ পর নারায়ণ স্বামী তার জন্য শরবত এনে সেই একই পাত্রে ঢালতে লাগলেন। শ্রবণের খুব আশ্চর্য লাগলো যে যখন পাত্রে আগে থেকেই জল রয়েছে, তখন  তাতে শরবত ঢেলে দেওয়ার কি দরকার? শুধু তাই নয়, পাত্রটি ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরও নারায়ণ স্বামী থামলেন না এবং আরও শরবত ঢালতেই থাকলেন, শরবত পাত্র থেকে উপছে পড়ে মাটিতে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। আর সামলাতে না পেরে শ্রবণ বললেন, "স্বামীজী, আপনি কি করছেন? পাত্রটি ভর্তি, এতে আরও শরবত কীভাবে ঢালা যাবে ?" নারায়ণ স্বামী বললেন "শ্রবণ তোমার প্রথম ধর্মোপদেশ শেষ হয়েছে।" শ্রবণ বলল এ কেমন কথা? স্বামীজী বললেন, যে পাত্রটি ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে আছে, তার মধ্যে যেমন আর কোনো দ্রব্য ঢালা যায় না, তেমনি আপনার মন যতক্ষণ পূর্বে শোনা ধারণা এবং পূর্বে শোনা জ্ঞান দিয়ে পূর্ণ থাকবে, আমি আপনাকে আর জ্ঞান প্রদান করতে পারব না। আমি আপনাকে কিছু জ্ঞান দিতে চাইলেও, এই শরবত যেমন পাত্র থেকে উপছে বাইরে পড়ে গেলো, তেমনি সেই জ্ঞানও বাইরেই থেকে যাবে এবং আপনার কোন কাজে আসবে না। অতএব, শ্রবণ, আপনি যদি জ্ঞান অর্জন করতে চান, তবে সর্বপ্রথম আপনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত করুন এবং নিজের মনকে শূন্য করে আমার কাছে আসুন। যতক্ষণ আপনার এই ভাবনা থাকবে যে আমি সব জানি, ততক্ষণ আপনি নতুন কিছুই শিখতে পারবেন না। যত বেশি পরিপূর্ণ থাকবে, গ্রহণের সম্ভাবনা তত কামে যাবে, এবং যত বেশি শূন্যতা থাকবে, গ্রহণের ক্ষমতা তত বেশি হবে।

আজকাল, আমরা যখন কোনও উৎসবে বা কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রথমে সাজসজ্জা করতে যাই, মেকআপ আর্টিস্ট প্রথমে পুরো মুখ পরিষ্কার করেন, অর্থাৎ পুরানো প্রসাধনটি সরিয়ে ফেলেন। আমরা প্রতিদিন ঈশ্বরের পুরানো সাজসজ্জা মুছে ফেলি এবং তবেই তাঁকে নতুন সাজে সাজাই। তাই নতুন সাজে সাজাতে হলে পুরনো সাজ তুলে ফেলতে হবে। আমরা যখন ভগবদ্গীতা পড়ি, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কে এর বক্তা এবং কে শ্রোতা, তখন অবিলম্বে আমরা উত্তরে বলব যে শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন। তখন অর্জুনের বয়স ছিল চুরাশি বছর এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল সাতাশি থেকে উন্নব্বই বছরের মধ্যে। অর্জুন একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং তিনি তার জীবনে কোনো যুদ্ধে হারেননি। মল্লিকার্জুন পর্বতে যুদ্ধ করে অর্জুন ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন, ভগবান কৃষ্ণের সাথে একাই খাণ্ডব বনে ইন্দ্রের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন, সমস্ত গন্ধর্বদের পরাজিত করে দুর্যোধন ও কর্ণকে উদ্ধার করেছিলেন, বিরাট নগরে বৃহন্নলা রূপে উত্তরকে তার সারথি বানিয়ে অর্জুন একাই দুর্যোধন, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, ভীষ্মাচার্য এবং কর্ণকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি এত শক্তিশালী। তিনি নীতিবান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে "অসূয়" অর্থাৎ যিনি কোনো পাপ করেননি বলে অভিহিত করেছেন। অর্জুন ইন্দ্রের পুত্র এবং তিনি সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি যখন স্বর্গে পৌঁছলেন, তখন উর্বশী নৃত্য পরিবেশন করছিলেন। উর্বশী পূর্বজন্মে  কুরু বংশের বধূ ছিলেন। অর্জুন তা অবগত ছিলেন, তাই তিনি উর্বশীর দিকে তাকাতে লাগলেন। ভগবান ইন্দ্র ভাবলেন করলেন যে অর্জুন উর্বশীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন, তাই তিনি রাতে উর্বশীকে অর্জুনের সেবা করতে পাঠান। অর্জুন রাতে উর্বশীর সাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন এবং অর্জুন তার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি কৌরব বংশের মাতা (তিনি পুররাভাসের স্ত্রী ছিলেন), তাই আপনি আমার কাছে মায়ের মতো। উর্বশী বললেন আমি অপ্সরা। তোমার এই অপমান আমি সহ্য করব না। আমি তোমাকে অভিশাপ দেব। অর্জুন বললেন, আপনি আমাকে অভিশাপ দিতে পারেন, কিন্তু আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করব না। উর্বশী খুব রেগে গিয়ে বললেন, তুমি নপুংসকের মতো কথা বলেছো, তাই তোমাকে আমি এক বছরের জন্য নপুংসক হওয়ার অভিশাপ দিলাম। অর্জুন কোন অপরাধ না করেই নপুংসক হওয়ার অভিশাপ পেয়েছিলেন। অর্জুন সানন্দে অভিশাপ গ্রহণ করলেন এবং ভগবান ইন্দ্রকে গিয়ে সব বললেন। ইন্দ্রদেব বললেন, অর্জুন, এই অভিশাপও তোমার জন্য বর হবে। অজ্ঞাতবাসের সময় সেই অভিশাপের কারণেই অর্জুন বৃহন্নলা রূপে বিরাট নগরীতে বিরাট-কন্যা উত্তরাকে নৃত্যশিল্প শিখিয়েছিলেন।

এত নীতিবান, ধৈর্যশীল এবং পরাক্রমী হওয়া সত্ত্বেও, আচার্য দ্রোণ এবং ভীষ্ম অর্জুনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমি কিভাবে আমার গুরুর দিকে তীর নিক্ষেপ করব? পিতামহ ভীষ্ম যিনি আমাকে অপরিসীম স্নেহ করেন, তার সাথে আমি কীভাবে যুদ্ধ করব? এই ভেবে অর্জুন বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলেন। অর্জুন ভগবানকে এই সময়ে তার জন্য কী শ্রেয় সে বিষয়ে উপদেশ প্রদান করার জন্য অনুরোধ করেন। আমি শিষ্য রূপে আপনার সামনে উপস্থিত। ভগবান তখন অর্জুনকে ভগবদ্গীতার দিব্য শিক্ষা দেন। এই অধ্যায়টি শুরু হয় অর্জুনের প্রশ্ন দিয়ে।

12.1

এবং(ম্) সততয়ুক্তা য়ে, ভক্তাস্ত্বাং(ম্) পর্য়ুপাসতে য়ে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং(ন্), তেষাং(ঙ্) কে য়োগবিত্তমাঃ।।1।।

যে সকল ভক্ত নিবিষ্ট চিত্তে নিরন্তর আপনার (সগুণ ভগবানের) উপাসনা করেন, এবং যাঁরা অবিনাশী নিরাকারের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোগী কে?

অর্জুন ভগবানকে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রেমময় ভক্তদের মধ্যে যারা নিরন্তর আপনার সগুন রূপের পূজা করে এবং যারা আপনার নিরাকার রূপের পূজা করে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? অর্জুন সরাসরি প্রশ্ন করলেন যে আপনি ভক্তিযোগ এবং জ্ঞানযোগের বিষয়ে যা বলছেন, এদের মধ্যে কোনটি সেরা? ভগবান রাম, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা প্রভৃতির পূজা হল সগুণ ভক্তি। অন্যদিকে একটি ঐশ্বরিক শক্তি আছে যার কোনো রূপ নেই, এটাই নির্গুণ ভক্তি। অর্জুনও বুঝতে পেরেছিলেন যে ঈশ্বরের প্রতি নিরন্তর ভক্তিই আসল ভক্তি। এজন্য উনি একে সততযুক্ত ভক্তি বলেছেন।

একটা গল্প আছে। দুই বন্ধু ছিল। তার মধ্যে একজনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের কার্ড বিতরণ করতে যেতে হবে, এই সময়ে তার বাড়িতে আরেক বন্ধু এলো। সে বললো তুমি ঠিক সময়ে এসেছ। বিয়ের কার্ড বিতরণ করতে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম একা কিভাবে যাব? তুমি যখন এসে পড়েছো, তখন আমার সাথে চলো। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি এবং তাও একদম সাদামাটা পোশাকে। তোমার সাথে যেতে পারবো না।প্রথমজন বলল, যাও, আমি যে যে পোশাক বিয়ের জন্য তৈরী করেছি, তুমি তা থেকে নিজের জন্য একটা পছন্দ করে পরে এস। তখন দ্বিতীয় বন্ধুটি বিয়ের জন্য বানানো সবচেয়ে যে ভালো পোশাক ছিল, তাই পরে নিলো। তাই দেখে প্রথম বন্ধু মনক্ষুণ্ণ হলেও অন্যজনকে কিছু বলতেও পারলো না। তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। সে প্রথমে কার্ড বিতরণের জন্য যার বাড়িতে গেল সেখানে বাড়ির লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো আপনার সঙ্গে কে? সে পরিচয় দিলো যে এ আমার বন্ধু এবং সঙ্গে এটাও জানালো যে ইনি যে পোশাক পরেছেন সেটা আমার বিয়ের পোশাক। তাই শুনে দ্বিতীয় বন্ধুর খুব খারাপ লাগলো। বাইরে এসে সে নিজের বন্ধুকে ধমক দিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না। তোমার পোশাক রাখো, আমি বাড়ি যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম জন তার বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, এমনটা আর হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মন পড়ে ছিল শুধুমাত্র নিজের বিয়ের পোশাকের ওপর। তারা যখন দ্বিতীয় বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে পৌঁছাল, তখন সেখানকার লোকজনও জিজ্ঞেস করল যে আপনার সাথে ইনি কে ? প্রথমজন আবার উত্তর দিল যে সে আমার বন্ধু এবং সে যে পোশাকটি পরেছে, সেটা বন্ধুর। তাই শুনে বন্ধুটির খুব খারাপ লাগলো এবং সে বললো, এসব বলার কি দরকার। এরপর দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয় এবং শেষে প্রথমজন ক্ষমা চায়। তারপর তারা যখন তৃতীয় বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে গেলো তখন সেখানে সে আবার বন্ধুর পরিচয় দিয়ে বলল, এ আমার বন্ধু, কিন্তু আমি এর পোশাক সম্পর্কে কিছুই জানি না।

সততযুক্ত অর্থাৎ যে কথা বা বিষয় মন থেকে বের হয় না, সর্বদা মনের সাথে যুক্ত থাকে। আমি একজন সংসারী ব্যক্তি, সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকি কিন্তু আমি প্রতিনিয়ত ভগবানকে স্মরণ করি। উপরোক্ত প্রসঙ্গে প্রথম বন্ধু নিজের বিয়ের কার্ড বিতরণ করছে কিন্তু তার মন নিজের বিয়ের পোশাকে স্থির রয়েছে। সেটা কখনই তার মন থেকে বের হয় না, কারণ সেই পোশাকটির চিন্তাই সারাক্ষণ তার মনের মধ্যে চলছে। ভগবানের ভক্তি যখন এমন হয়ে যায়, তখন তা সততযুক্ত হয়ে যায়।

যখন অর্জুন প্রশ্ন করেন, তখন ভগবান অর্জুনকে সম্পূর্ণ জ্ঞান প্রদান করেন। যেমন যখন ছেলে  বাবাকে জিজ্ঞেস করে বাড়িকে HOME বলে না HOUSE বলে ? তখন বাবা বলেন শুধুমাত্র home বা house ই নয়, ভিলা, বাংলো, অ্যাপার্টমেন্ট, কটেজ, পেন্টহাউস, ম্যানশন, অনেক রকমের বাড়ি হয়। বাবা যখন ছেলেকে শেখাতে বসেন, তখন তিনি ছেলেকে সম্পূর্ণ  শিক্ষা দেন।
আমরা যখন কাউকে কিছু উপহার দিই, তখন নিজের সামর্থ অনুযায়ী দেওয়া উচিত। অনেক সময় আমরা অনেক বড় ভুল করি। বড় লোকের বিয়েতে গেলে পাঁচ হাজার টাকার খাম দিই, আর বাড়ির কাজের মেয়ে হলে দুশো টাকার খাম দিই। আসলে, আমাদের উল্টোটা করা উচিত। যিনি বড় লোক, তার কাছে কিন্তু পাঁচ হাজার টাকার কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু অন্যদিকে কাজের মেয়েটির কাছে পাঁচ হাজার টাকার মূল্য অনেক। অতএব, যখনই আমাদের কাউকে দিতে হয়, আমাদের উচিত তাকে নিজের স্তর অনুযায়ী উপহার দেওয়া। অর্থাৎ, যদি কাজের মেয়েকে শাড়ী উপহার দিই, তাহলে সেই শাড়িটা যেন আমার নিজের স্তরের দাম অনুযায়ী হয়। ভগবানও ঠিক তাই করেন। যেমন একজন ভালো বক্তা প্রথমে তার বক্তব্য সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন এবং পরে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন, ঠিক একইভাবে দ্বিতীয় শ্লোকে ভগবান অর্জুনের প্রশ্নের উত্তর দেন এবং তৃতীয় থেকে বিংশ শ্লোকে তা বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন।

12.2

শ্রী ভগবানুবাচ

ময়‍্যাবেশ্য মনো য়ে মাং(ন্), নিত্যয়ুক্তা উপাসতে
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাঃ(স্), তে মে য়ুক্ততমা মতাঃ।।2।।

শ্রীভগবান বললেন—আমাতে মন নিবিষ্ট করে নিত্য-নিরন্তর আমাতে যুক্ত হয়ে যেসব ভক্ত পরম শ্রদ্ধা সহকারে আমার (সগুণ-সাকারের) উপাসনা করেন আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী ।

ভগবান বলেন হে অর্জুন! যাঁরা আমার প্রতি মন নিবদ্ধ করেন এবং বিশ্বাস সহকারে নিরন্তর আমার আরাধনা করেন, তাঁরা দুজন যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ভগবান অর্জুনকে সরাসরি বললেন, যারা আমার সগুণ রূপের পূজা করে তারাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।

শ্রদ্ধাই মূল উপাদান। যার মনে বিশ্বাস আছে, তার ব্যবহারে তা প্রকাশ পায়। ভক্তিযুক্ত কর্ম অধিকতর মূল্যবান হয়। ভগবদ্গীতার অনেক জায়গায় ভগবান শ্রদ্ধা শব্দটি ব্যবহার করেছেন যেমন “শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং” যার শ্রদ্ধা আছে কেবল সেই জ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারে এবং গীতায় এটাও বলা হয়েছে যে যার শ্রদ্ধা নেই তার বিনাশ হয়। ভগবান বলেন, যে ভক্ত আমাকে শ্রদ্ধার সাথে নিরন্তর আরাধনা করে সে আমার খুব প্রিয়।

ভগবান বলেছেন তুমি আমায় ভক্তিযোগ এবং জ্ঞানযোগ উভয় বিষয়েই জিজ্ঞাসা করেছ, তাই আমি তোমাকে জ্ঞানযোগ সম্পর্কেও বিস্তারিত বলব।

12.3

য়ে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যম্, অব্যক্তং(ম্) পর্য়ুপাসতে
সর্বত্রগমচিন্ত্যং(ঞ্) চ, কূটস্থমচলং(ন্) ধ্রুবম্।।3।।

যাঁরা সম্পূর্ণরূপে নিজ ইন্দ্রিয় বশীভূত করে অচিন্ত্য, সর্বত্র পূর্ণভাবে অবস্থিত, অনির্দেশ্য, কূটস্থ, অচল, ধ্রুব,।

 

12.4

সন্নিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং(ম্), সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ
তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব, সর্বভূতহিতে রতাঃ।।4।।

অক্ষর এবং অব্যক্তের একাগ্রের সঙ্গে উপাসনা করেন, সেই প্রাণীমাত্রেরই হিতপরায়ণ এবং সর্বত্র সমবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমাকেই প্রাপ্ত হন।

আমরা আটটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা নিরাকার বুঝতে পারি। ভগবান বলছেন-

প্রথম : অচিন্ত্য - যার চিন্তন করা সম্ভব না, অর্থাৎ নিরাকার।

দ্বিতীয় : অক্ষর - যার বৃদ্ধি বা হ্রাস নেই, পরিবর্তন নেই বা ক্ষরণ নেই। 

তৃতীয় : অব্যক্ত - যাকে ব্যক্ত করা যায় না। 

नाम रूप गति अकथ कहानी,
समुझत सुखद न परति बखानी।

চতুর্থ : সর্বত্র - যা সব জায়গায় ব্যাপ্ত। 

পঞ্চম : অনির্দেশ্য -  নির্দিষ্ট করা যায় না এমন; স্পষ্ট বা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না

ষষ্ঠ : কূটস্থ -
 যার পরিবর্তন নেই, অনেক প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। 

সপ্তম : অচল - যা স্থির। 

অষ্টম : ধ্রুব - যা নিশ্চল, অটল, সর্বক্ষণ বিদ্যমান।  

ভগবান নিরাকারের এই আটটি লক্ষণ বলেছেন। আর বলেছেন এই আটটি লক্ষণের যিনি উপাসনা করেন, প্রত্যেক প্রাণীমাত্রের হিতার্থে যিনি কর্ম করেন, সেই সমভাবাপন্ন  ভক্ত আমাকেই প্রাপ্ত করেন। অর্থাৎ জ্ঞানযোগের মাধ্যমেও আমাকে প্রাপ্ত করা যায়।

12.5

ক্লেশোধিকতরস্তেষাম্, অব্যক্তাসক্তচেতসাম্
অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং(ন্), দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।।5।।

অব্যক্তে (নির্গুণ ব্রহ্মে) আসক্তচিত্ত সেই সাধকদের (নিজ নিজ সাধনে) অধিক ক্লেশ হয়ে থাকে, কারণ দেহধারী ব্যক্তিদের অব্যক্তের প্রাপ্তি কষ্টে লাভ হয়।

হে অর্জুন, সেই নিরাকার ব্রহ্মার উপাসনা করার অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য কারণ দেহধারী প্রাণীর(যারা মনে করে এই দেহই আমি) পক্ষে অব্যক্তের উপাসনা করা খুবই কঠিন। যিনি নিজেকে দেহ থেকে পৃথক বলে মনে করেন তিনিই অব্যক্ত অর্থাৎ নিরাকারের পুজো সহজেই করতে পারেন। শরীরের খিদে লাগে, ব্যথা হয়, তেষ্টা পায়, কিন্তু আমার খিদে লাগে না, তেষ্টাও লাগে না, ব্যথাও লাগে না, এ দেহ আমার নয়, এই দেহের সাথে সম্পর্কগুলোও আমার নয়। যার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় একমাত্র তিনিই নির্গুণের উপাসনা করতে পারেন। তাই এটি একটি কঠিন বিষয়।

সগুণ ভক্তির জন্য কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। শ্রীরাম জয় রাম, জয় জয় রাম জপতে কোনও অসুবিধা নেই, কিন্তু যে ভক্তের শরীর নিয়ে কোনো অহংকার থাকে না, শরীরের প্রতি কোন আসক্তি থাকে না, যে নিজেকে দেহ সর্বস্য বিবেচনা করে না, সেই ভক্তই নির্গুণের উপাসনা করতে পারেন ।

অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন - এটা খুব কঠিন, এটা কিভাবে সম্ভব? ভগবান বলেছেন সবই সম্ভব। নবধা ভক্তির পন্থা অবলম্বন করো। নবধা ভক্তি মানে-

শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পদসেবনম্।
অৰ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্।।

শ্রবণ (পরীক্ষিত শ্রবণ দ্বারা করেছিলেন), কীর্তন (শুকদেব কীর্তন দিয়ে করেছিলেন), স্মরণ (প্রহ্লাদ স্মরণ দ্বারা করেছিলেন), পদসেবন (লক্ষ্মী চরণসেবার মাধ্যমে করেছিলেন), অর্চনা (পৃথুরাজা পূজা দিয়ে করেছিলেন), বন্দনা (অক্রূর বন্দনা দ্বারা করেছিলেন), দাস্য (হনুমান দাস হয়ে করেছিলেন), সখ্য (অর্জুন সখা ভাব দিয়ে কিরেছিলেন, সেই উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে) এবং আত্মনিবেদনম্ (রাজা বলী আত্মনিবেদন দ্বারা করেছিলেন) করে নবধা ভক্তি করা সম্ভব। তুমি এর মধ্যে যে কোনও একটি উপায় অবলম্বন করতে পারেন।

12.6

য়ে তু সর্বাণি কর্মাণি, ময়ি সন্ন্যস্য মত্পরাঃ
অনন্যেনৈব য়োগেন, মাং(ন্) ধ্যায়ন্ত উপাসতে।।6।।

কিন্তু যাঁরা সমস্ত কর্ম আমাতে অর্পণ করে, মৎ-পরায়ণ হয়ে অনন্যভাবে আমারই ধ্যান বা উপাসনা করেন।

যে ভক্তগণ অনন্য যোগের মাধ্যমে আমার ধ্যান করে, আমার উপাসনা করে। এখানে অনন্য মানে এই নয় যে আমি কেবল রামের বা শিবের বা দেবীর পুজো করবো বা কেবল নিজের আরাধ্য দেবতার মন্দিরেই যাবো। আদি শঙ্করাচার্য গৃহস্থের জন্য পঞ্চ দেবতার আরাধনার উপদেশ দিয়েছেন। এই পঞ্চদেব হলেন  -

ভগবান বিষ্ণু - তাঁকে আপনি রাম, কৃষ্ণ বা নারায়ণ রূপে পুজো করতে পারেন। ঠাকুর ঘরে বিষ্ণুর কোন একটি মূর্তি থাকা উচিত। 

দেবী - মা দুর্গা, মা লক্ষ্মী, মা সরস্বতী, যে কোন একটি দেবী মূর্তি থাকা উচিত। 

শিব - ঠাকুরঘরে শিবলিঙ্গ বা শিবের মূর্তি বা ফটো থাকা উচিত। 

গণেশ  - গণেশের একটি মূর্তিও থাকা উচিত। 

এবং সর্বশেষ সূর্য - সূর্যের ফটো রাখা উচিত বা সূর্যদেবকে অর্ঘ্য দান করা উচিত। এই ভাবে পঞ্চদেবতার পুজো হয়। 

এর মধ্যে যিনি আপনার ইষ্ট, তাঁকে মধ্যে রাখবেন। ঠাকুর ঘরে অনেক বেশি মূর্তি রাখা উচিত না। আমরা যে কোনো মন্দিরে যেতে পারি, কিন্তু নিজের ইষ্টদেবতা, নিজের জপের মন্ত্র যেন একটিই হয়। 

এই প্রসঙ্গে একটি গল্প আছে। দুই জা ছিল। তাদের মধ্যে সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। বড় জা নিজের গুরুর কাছে গিয়ে কিছু সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন। গুরুদেব বললেন এক বছর ধরে প্রতিদিন শিবমন্দিরে প্রদীপ জ্বালাবে। বড় জা বললেন জ্বালাবো। ছোট জা বড় জাকে ঈর্ষা করতো। বড় জা মন্দিরে প্রদীপ জ্বেলে এলে ছোট জা একটু পরে গিয়ে প্রদীপ নিভিয়ে আসত। একদিন খুব বৃষ্টি হওয়ার ফলে জল জমে গিয়েছিলো। বড় জা সেদিন প্রদীপ জ্বালাতে যেতে পারেননি। ছোট জা ভাবলো আজও নিশ্চয়ই প্রতিদিনের মতো প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। তাই সে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রদীপ নেভাতে গেলো। সেখানে গিয়ে সে দেখলো প্রদীপ তো নেভানো রয়েছে। তাই সে আবার প্রদীপ জ্বালালো। তারপর যেই সে প্রদীপ নেভাতে গেলো, শিব ঠাকুর তার সামনে আবির্ভূত হলেন আর বললেন নিয়ম দুজনের জন্যই সমান। বৃষ্টির কারণে তোমার বড় জা আসতে পারেনি, কিন্তু তুমি নিজের নিয়মভঙ্গ করনি। ভক্তি তখনই. সফল হয় যখন তা সতত হয়। নিজের সুবিধামতো ভক্তি করলে, তার কোনো পরিণাম পাওয়া যায় না।

12.7

তেষামহং(ম্) সমুদ্ধর্তা, মৃত্যুসংসারসাগরাত্
ভবামি নচিরাত্পার্থ, ময়‍্যাবেশিতচেতসাম্।।7।।

হে পার্থ ! আমাতে সমর্পিত চিত্ত সেই ভক্তদের আমি মৃত্যুরূপ সংসার-সমুদ্র থেকে শীঘ্রই উদ্ধার করে থাকি।

ভগবান বলেন, যারা আমার প্রতি মন আবিষ্ট করেন, আমি তাদের মৃত্যুরূপী সংসার-সাগর থেকে দ্রুত উদ্ধার করি। অর্জুন বলেন এটাই কি একমাত্র পথ? যে আমি পূর্ণ নিষ্ঠা ও  একাগ্রচিত্তে আপনার আরাধনা করে যাই, আর অন্য কোন বিকল্প আছে? ভগবান বলেছেন আমি সেটাও তোমাকে বলব।

12.8

ময়‍্যেব মন আধত্স্ব, ময়ি বুদ্ধিং(ন্) নিবেশয়
নিবসিষ্যসি ময়‍্যেব, অত ঊর্ধ্বং(ন্) ন সংশয়ঃ।।8।।

তুমি আমাতে মন নিবিষ্ট কর এবং আমাতেই বুদ্ধি নিয়োগ কর ; তাহলে তুমি আমাতেই বাস করবে (স্থিতিলাভ করবে) এতে কোনো সন্দেহ নেই ।

অর্জুন,তুমি আমাতেই মন আবিষ্ট কর এবং আমাতেই নিজের বুদ্ধি অর্পণ কর। এর পর তুমি যে শুধু আমার মধ্যেই স্থিত থাকবে, তাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।  

অচ্যুতম্ কেশবং কৃষ্ণ দামোদরং,
রাম নারায়ণং জানকী বল্লভম্।।

নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আমার কাছে সমর্পণ কর। অর্জুন অনুভব করলেন যে এটি প্রথমটির চেয়ে আরও কঠিন। ভগবান তখন আরও ব্যাখ্যা করেন।

12.9

অথ চিত্তং(ম্) সমাধাতুং(ন্), ন শক্নোষি ময়ি স্থিরম্
অভ্যাসয়োগেন ততো, মামিচ্ছাপ্তুং(ন্) ধনঞ্জয়।।9।।

যদি তুমি আমাতে চিত্ত অচলভাবে স্থির (অর্পণ) করতে সক্ষম না হও, তাহলে হে ধনঞ্জয় ! অভ্যাসযোগের সাহায্যে তুমি আমাকে পাবার চেষ্টা কর।

ভগবান বলেন হে অর্জুন! তুমি যদি আমার উপর নিজের মনকে স্থির করতে না পারো, তবে যোগ সাধনার মাধ্যমে তুমি আমাকে প্রাপ্ত করে নাও। আমাকে প্রাপ্ত করার জন্য যা করতে পারো, তাই করো। তুমি যদি আর কিছুই করতে না পারো তবে শুধু এইটুকু প্রার্থনা করো যে হে নাথ! আমি যেন আপনাকে বিস্মৃত না হই।

12.10

অভ্যাসেপ্যসমর্থোসি, মত্কর্মপরমো ভব
মদর্থমপি কর্মাণি, কুর্বন্ সিদ্ধিমবাপ্স্যসি।।10।।

যদি তুমি অভ্যাসযোগেও অসমর্থ হও তবে আমার জন্য কর্মপরায়ণ হও। আমার জন্য কর্ম করতে থাকলেও তুমি সিদ্ধিলাভ করবে।

ভগবান হলেন দীনানাথ অর্থাৎ ত্রাণকর্তা। তিঁনি বলেন, তুমি যদি অনুশীলনেও সক্ষম না হও তবে আমার জন্য কাজ করে যাও। ভগবান আমাকে বাবার ভূমিকা দিয়েছেন, তাই আমি আমার বাবার ভূমিকা পালন করছি। ভগবান আমাকে মায়ের ভূমিকা দিয়েছেন, তাই আমি মায়ের কাজ পালন করছি। আমি একজন ছেলে, আমি একজন সৈনিক, আমি একজন খেলোয়াড়, আমি একজন নিয়োগকর্তা, আমি একজন কর্মচারী, আমি সেই ভূমিকাটিই পালন করছি যেটি পালন করার জন্য ভগবান আমাকে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ আমি যে কাজই করছি, সেটা ঈশ্বরের জন্য, ঈশ্বরের  নিমিত্ত হয়ে করছি।

राम राम रटते रहो जब लगि घट में प्राण,
कभी तो दीनदयाल के भनक पड़ेगी कान।।

तुलसी अपने राम को रीझ भजो चाहे खीझ,
भौम पड़ा जामें सभी उलटे सीधे बीज।।

আপনি যদি মাটিতে বীজ বপন করেন, বীজগুলি উল্টো হয়ে পড়ুক বা সোজা হয়ে থাকুক,  তা থেকে একটি গাছ অবশ্যই বেরোবে। ভাবপূর্ণ ভাবে ভগবানের উপাসনা কর বা বিদ্বেষ সহকারে পূজা কর। ভগবান বলেন তুমি যাই কর না কেন, "শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু" অর্থাৎ আমাকে নিবেদন কর। অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, আরও কোন উপায় আছে কি?

12.11

অথৈতদপ্যশক্তোসি, কর্তুং(ম্) মদ্যোগমাশ্রিতঃ
সর্বকর্মফলত্যাগং(ন্), ততঃ(খ) কুরু য়তাত্মবান্।।11।।

যদি তুমি আমার যোগের (সমত্বের) আশ্রিত থেকে এইগুলিও (পূর্বশ্লোকে কথিত সাধনগুলি) করতে অসমর্থ হও তাহলে মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করে সমস্ত কর্মফলের ইচ্ছা ত্যাগ কর।

ভগবান বলেন, যদি পূর্বে আমার দ্বারা বর্ণিত উপায়গুলিও করতে না পার, তবে মন, বুদ্ধি প্রভৃতি জয় করে সমস্ত কর্মের ফল ত্যাগ কর। তাহলে আর কিছু করতে হবে না। আমি নিজের কর্তব্য  পালন করি এবং ফলাফল নিয়ে চিন্তা করি না। এই সূত্রে একটি সুন্দর ভজন আছে -

                                         

"ডোর সৌঁপকে তো দেখ একবার" এই ডোর অর্থাৎ দড়ি তুমি একবার ভগবানের হাতে তুলে দাও। মহাভারতে বস্ত্রহরণের ঘটনার সময় দ্রৌপদী ভগবানকে স্মরণ করলেন এবং দেরীতে আসার জন্য তিনি পরে ভগবানকে তিরস্কারও করেছিলেন। আর একটু দেরি হলে কী হতো কে জানে? ভগবান বললেন আমি তো দেরি করিনি। যখনই তুমি ডেকেছো, আমি তোমার ডাকে এসেছি। কিন্তু তুমিই আমাকে ডাক দাও নি।  মনে কর দ্রৌপদী, সবার আগে তুমি যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়েছিলে কিনা? তারপর তুমি ভীমের দিকে তাকালে? তারপর অর্জুনের দিকে? তারপর নকুল সহদেবের দিকে? তারপর একে একে ভীষ্ম পিতামহ, বিদুর এবং ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকালে কিনা ? সকলের দিকে তাকানোর পর যখন তারা সাহায্য করল না, তখন তুমি তোমার সকল শক্তি দিয়ে আমায় ডাকলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে গেলাম। ভগবানের হাতে নিজের দড়ি তুলে দিন। আগামী সত্রে একজন ভক্তের ঊনচল্লিশটি লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এরপর হরি শরণম সংকীর্তনের মাধ্যমে আজকের বিবেচন সত্র শেষ হয় এবং এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হয়।

:: প্রশ্নোত্তর ::

প্রশ্নকর্তা:-
বালচন্দ্র দাদা 
প্রশ্ন:- গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন কর্মের ফলের আশা রাখবে না। এভাবে জীবন কি করে চলবে?
উত্তর:-

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ।।2.47।।
ভগবান বলেছেন কর্মে তোমার অধিকার আছে, তার কর্মফলে তোমার কোন অধিকার নেই। মাটিতে বীজ পুঁতে ফলের কথা না ভেবে গাছের যত্ন নিন। বীজ মাটিতে পোতা আপনার কাজ ছিল। তেমনই জীবনে কাজ আপনার হাতে, তার ফল না। আপনাকে আপনার কাজ করে যেতে হবে। 

প্রশ্নকর্ত্রী:- বিদ্বতা দিদি 
প্রশ্ন:- যদি কর্মতেই ভক্তি হয় তাহলে আমরা পুজো আদি কেন করবো?
উত্তর:- ফল কামনা না করে কর্ম করাই কর্মযোগ, কিন্তু দেবতাকে অর্পণ না করে খেয়ে নেওয়া হলো চুরির সমতুল্য,

ভগবান তৃতীয় অধ্যায়ে

বলেছেন। পৃথিবী, জল, আকাশ, বায়ু এবং দেবতাদের শক্তি থেকে খাদ্য উৎপন্ন হয়। তাই নৈবেদ্য না দিয়ে খাবার খাওয়া বা দেবতাদের পূজা করা অনুচিত।

প্রশ্নকর্তা:- নীরজ দাদা 
প্রশ্ন:- আমি যদি নিজের কুলদেবতা/কুলদেবীকে না জানি, তাহলে আমার কি করণীয়?
উত্তর:- বিশেষ শুভ অনুষ্ঠানে পারিবারিক দেবতার পূজা করা উচিত। আপনি যদি আপনার পারিবারিক দেবতাকে না জানেন, তবে আপনি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন সেখানের গিয়ে সমাজের লোকদের জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবেন। তাহলে আপনি আপনার কুলদেবতার পূজা করতে পারেন।

প্রশ্নকর্ত্রী:- দুর্গা দিদি
প্রশ্ন:- মালা জপ না ধ্যান করা, কোনটা শ্রেষ্ঠ? আমাদের কি করা উচিত?
উত্তর:- দিনে ২-৩ বার ঠাকুরের সামনে বসে মালা জপ করা উচিত। এতে মন নিয়ন্ত্রণে থাকে। সবার ক্ষেত্রে এক নিয়ম প্রযোজ্য হয় না। আপনার যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করতে ভালো লাগে সেটা আপনি করতে পারেন। আপনি যদি সর্বদা ঈশ্বরের ধ্যান করে যান তবে তাও ভাল।

প্রশ্নকর্তা:- রাজেশ দাদা 
প্রশ্ন:- গীতার শ্লোক মুখস্থ করা আর জীবনে প্রয়োগ করলে কি লাভ হয়?
উত্তর:- গীতার শ্লোক যদি আমরা অর্থ না বুঝেও শুদ্ধ উচ্চারণ করি, তাহলে মন্ত্রাত্মক লাভ হয়। সেগুলোর অর্থ জেনে জীবনে প্রয়োগ করারও অনেক গুরুত্ত্ব আছে। তাই স্বামী গোবিন্দদেব গিরি জী মহারাজ বলেছেন -
গীতা পড়ুন, পড়ান, জীবনে আনুন। 

প্রশ্নকর্ত্রী : 
সংগীতা দিদি 
প্রশ্ন: পুজো বা জপ করার সময় মনে যদি খারাপ চিন্তা আসে তাহলে কিভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত ?
উত্তর : এর জন্য একটি সুন্দর ভজন আছে -

                                                         

প্রশ্নকর্ত্রী  : নর্বদা দিদি

প্রশ্ন : য়দক্ষর পদভ্রষ্টং মাত্রা হীনন্তু য়দ্ভবেৎ | তৎসর্বং ক্ষম্যতাং দেব নারায়ণ নমোऽস্তুতে || - এর অর্থ বলে দিন। 

উত্তর : কোনো পূজা বা শ্লোকের উচ্চারণে কোনো ভুল থাকলে তা দেখার জন্য ভগবানকে অনুরোধ করার জন্য এই মন্ত্রটি বলা হয়। হে নারায়ণ, আমি আপনাকে প্রণাম জানাই এবং আপনাকে অনুরোধ করছি যে কোন বর্ণ, বাক্যাংশ এবং যে কোনো শব্দাংশের উচ্চারণে আমি যে ভুল করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। এটি মূলত একটি ক্ষমা মন্ত্র।