विवेचन सारांश
যে ভক্ত সর্বতোভাবে শ্রীভগবানের কাছে আত্ম সমর্পণ করেন তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র
দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তিযোগের কথা বলা হয়েছে। সন্ধ্যার বিবেচন সত্রটি প্রথাগত প্রদীপ প্রজ্বলন, প্রার্থনা এবং গুরুদের প্রণাম জ্ঞাপন করে শুরু হল।
আমরা সত্যই অত্যন্ত ভাগ্যবান যে আমরা গীতার সাথে যুক্ত হতে পেরেছি। অষ্টাদশ অধ্যায়ে শ্রীভগবান স্বয়ং বলেছেন, যিনি গীতা পড়েন, পড়ান এবং জীবনে অনুসরণ করেন তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য বলে গণ্য হন।
প্রথম দশটি অধ্যায়ে ভগবান নারায়ণ নির্গুণ ব্রহ্মের (অব্যক্ত চৈতন্য) মধ্য দিয়ে “সৎ চিত আনন্দ“ অবস্থায় উত্তরণের কথা ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু একাদশ অধ্যায় থেকে আমরা সগুণ ব্রহ্মের (ব্যক্ত গুণময় চৈতন্য) কথা শিখি। এতে অর্জুনের মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় যে তিনি কোন পথ অনুসরণ করবেন এবং পরম সত্যে পৌঁছানর জন্য কোন পথটি শ্রেষ্ঠ ।
দ্বাদশ অধ্যায়ে পরমেশ্বরের বিভিন্ন রূপের পার্থক্য এবং ভক্তের ভক্তিযোগের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্লোকে শ্রীভগবান ভক্তিযোগকে উপাসনার সর্বোত্তম উপায় বলেছেন। অর্জুন জানতে চেয়েছিলেন উপাসনার কোন পথটি শ্রেষ্ঠ, যে ভক্ত নিরন্তর অব্যক্ত ব্রহ্মের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর উপাসনা করেন না যিনি তাঁর ব্যক্ত রূপের উপাসনা করেন।
এর উত্তর ভক্তের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। এখানে অর্জুন আমাদের মত সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর তাই শ্রীভগবান আমাদের সহজতর নানান বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছেন।
পরবর্তী শ্লোকগুলিতে আমরা উপাসনার বিভিন্ন পদ্ধতির অন্তর্নিহিত অর্থ এবং ভক্তের বিভিন্ন প্রকৃতি সম্বন্ধে জানতে পারি।
12.9
অথ চিত্তং(ম্) সমাধাতুং(ন্), ন শক্নোষি ময়ি স্থিরম্
অভ্যাসয়োগেন ততো, মামিচ্ছাপ্তুং(ন্) ধনঞ্জয়।।9।।
অভ্যাসযোগ হল অনুশীলন করার যোগ কিন্তু অনুশীলন করা আর যোগ অভ্যাস করা এক নয়। মনকে নিয়ত লক্ষ্যে অবিচল রাখা হল অনুশীলন করা আর মনের সমতা বজায় রাখা হল যোগ। যখন অনুশীলিত মন সমতার সাথে যুক্ত হয়ে যায় তার ফল হয় অভ্যাস যোগ।
যদি কেউ এটা না করতে পারেন তাহলেও তার বিকল্প আছে।
অভ্যাসেপ্যসমর্থোসি, মত্কর্মপরমো ভব
মদর্থমপি কর্মাণি, কুর্বন্ সিদ্ধিমবাপ্স্যসি।।10।।
শ্রীভগবান অর্জুনকে বললেন যদি সে তার মন পূর্ণরূপে ঈশ্বরে সমর্পণ না করতে পারেন তখন তিনি তার সব কৃতকর্ম পরমেশ্বরকে উৎসর্গ করুন এবং ভক্তিভরে সমস্ত কার্য্য করুন, তাহলেও তিনি পরমেশ্বরকে প্রাপ্ত হবেন।
অথৈতদপ্যশক্তোসি, কর্তুং(ম্) মদ্যোগমাশ্রিতঃ
সর্বকর্মফলত্যাগং(ন্), ততঃ(খ) কুরু য়তাত্মবান্।।11।।
গীতা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা স্বামীজী যুব সম্প্রদায়কে পরামর্শ দিয়েছেন - তোমরা জীবনকে যে পথে চালিত করতে চাও তার স্বপ্ন দেখ, লক্ষ্য স্থির কর, তা অর্জন কর এবং তারপর সেই লক্ষ্য অর্জন করার যে কর্মফল তা পরিত্যাগ কর।
লক্ষ্যে পৌঁছানর জন্য কর্ম করতে হবে কিন্তু সেই কর্মে অনাসক্ত হতে হবে এবং সেই কর্মের ফলেও আসক্তিহীন হতে হবে।
মনকে সংযত করতে হবে এবং বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হতে হবে কারণ মনের কামনাই আসক্তিতে পরিণত হয়।
শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাসাজ্, জ্ঞানাদ্ধ্যানং(ব্ঁ) বিশিষ্যতে।
ধ্যানাত্কর্মফলত্যাগঃ(স্),ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্।।12.12।।
আমাদের প্রশ্নের যদি অনেক সমাধান দেওয়া হয়, স্বভাবতই আমরা চিন্তা করি যে প্রথম সমাধানটিই উত্তম এবং পরের গুলোর মান ক্রমশঃ কমতে থাকে ও সর্বশেষ সমাধানটি একেবারেই নিম্নমানের হয়। অর্জুনের এবং আমাদের এই ধারনা মুক্ত করতে শ্রীভগবান তাঁকে পাওয়ার বিভিন্ন উপায়গুলিকে উপস্থাপনা করে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।
সাধারণ অভ্যাসের থেকে জ্ঞানার্জন শ্রেয়, ধ্যান জ্ঞানের থেকে শ্রেয় কিন্তু পরম শান্তি একমাত্র কর্মফলত্যাগ দ্বারাই প্রাপ্ত হয়।
একটা সুন্দর উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন ভক্তকে “রাম” নাম জপতে বলা হল। তখন তাকে শ্রী রামের মহিমা ও গুরুত্বও বোঝানো হল। এরপর রাম নাম নিলে তার ভক্তি সহজেই শ্রী রামের উদ্দেশ্যে প্রবাহিত হয়। নিরন্তর প্রচেষ্টা দ্বারা একসময় এমন অবস্থা আসতে পারে যে সে তাঁর মধ্যে নিমজ্জিত হতে থাকবে। যত তার ধ্যান করা যাবে তত তাঁর সন্নিকটে পৌঁছান যাবে।
ত্যাগের পথ অবিলম্বে শান্তি প্রদান করে কিন্তু আমাদের কামনা পূরণের জন্য যে কর্ম আমরা করি তা অবশেষে হতাশাই আনে।
উদাহরণস্বরূপ ভাইবোনদের সাথে যখন কিছু ভাগ করে নেওয়া হয় তখন আমাদের খুব ভাল লাগে এবং শান্তি পাই কিন্তু কারও অনুরোধ না রাখলে আমরা তা সব সময় চিন্তা করতে থাকি এবং নিজেদের অপরাধী মনে হয়।
যোগেশ্বরের কৃপায় অর্জুন একজন প্রকৃত ভক্ত তাই এই বিকল্পগুলি তার জন্য প্রযোজ্য নয় কিন্তু তিনি আমাদের উপকারের জন্য আমাদের মত সাধারণ মানুষদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং(ম্), মৈত্রঃ(খ্) করুণ এব চ
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ(স্) , সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।13।।
শ্রী ভগবান বর্ণিত প্রকৃত ভক্তের পরিচয়, যারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, নিম্নলিখিত গুণাবলীর দ্বারা বোঝা যায় ।
অদ্বেষ্টা = যিনি দ্বেষ করেন না ; অর্থাৎ কাউকে অপছন্দ বা ঘৃণা করেন না। এটা পঞ্চদশ অধ্যায়েও বলা হয়েছে যে যাকে দ্বেষ কর হচ্ছে তার মধ্যেও ঈশ্বর আছেন। একজন ব্যক্তির কর্ম খারাপ হতে পারে কিন্তু তার আত্মা খারাপ হয় না, আমরা কেউই তার বিচার করতে পারি না।
মৈত্রঃ = সমস্ত প্রাণীদের (সর্বভূতানাম্) প্রতি বন্ধুত্বের ভাব রাখা;
করুণঃ = সহমর্মিতা ; কারও কর্ম বিচার না করে প্রত্যেক প্রাণীর কষ্টে সমবেদনা অনুভব করা।
নির্মমঃ = অহংভাব পরিত্যাগ করা; একজন ভক্ত দুটি বিষয়ের ওপর নজর দেন। জগতে যা কিছু আছে টা ঈশ্বরের থেকে ভিন্ন নয় এবং তিনি নিজেও ঈশ্বরের থেকে পৃথক নন। যখন তার এমন দৃষ্টিভঙ্গী হয় তখন তার মধ্যে “আমি এবং আমার” এই ভাব লুপ্ত হয়।
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মীরাবাঈ এর ভক্তি নির্মমঃ ভাবের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যখন তিনি বলেন -
“মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরো না কোই“। অর্থাৎ “আমার” বলে আমার তো একমাত্র গিরিধারী গোপালই আছেন আর কিছু বা আর কেউ নেই।
নিরহঙ্কারঃ = অহঙ্কারহীন; ভক্তকে অহঙ্কারশূন্য হতে হবে। যেমন বন্ধুর সাথে ঝামেলা হলে নিজে থেকে এগিয়ে এসে কথা বলে সমাধান না করে অপেক্ষা করা কখন সেই বন্ধু নিজে থেকে এসে মিটমাট করবে – এটা হল অহঙ্কার ভাব। একজন ভক্তের কোন অহং বোধ থাকে না কারণ সে জানে “আমিত্ব” একমাত্র ঈশ্বরেই থাকে । কোন কিছু আমার বলে ভাবার কোন অর্থ হয় না কারণ সবকিছুই ঈশ্বরের।
শ্রীকৃষ্ণ বাঁশী বাজাতে ভালবাসতেন কারণ তার ভেতরটা ফাঁপা, খুঁতহীন। তেমনি ভক্তের অন্তর শূন্য হলে তবেই তা ভক্তি দ্বারা পূর্ণ হতে পারে।
সমদুঃখসুখঃ = সুখে এবং দুঃখে সমান ভাব; একজন ভক্তকে সুখে, দুঃখে, আনন্দ, কষ্টে সমান ভাব বজায় রাখতে হবে। যখন মন থেকে দ্বৈত ভাব চলে যায় তখন মন দুঃখে কাতর হয় না বা আনন্দে উৎফুল্লও হয় না, উভয় অবস্থাতেই সমতা বজায় থাকে। যখন মন ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না তখন হতাশা বা মানসিক অসুস্থতার মত অবস্থা আসতে থাকে।
ক্ষমী = ক্ষমা ভক্তের এক বিশেষ গুণ। অনেক ক্ষেত্রে কারও ব্যাবহার আমাদের দুঃখের কারণ হয়। সে দুঃখ দিয়ে চলে যায় কিন্তু আমরা সেই দুঃখ বা আঘাত নিয়ে বসে থাকি যা আমাদের উদ্বেগ বাড়ায় ও নেতিবাচক আবেগ আনে।
मनुज गलती का पुतला है, तो अक्सर हो ही जाती है॥
जो कर ले ठीक गलती को, उसे इन्सान कहते हैं॥
উপরের দোঁহাটির অর্থ হল ভুল করা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম কিন্ত তা শুধরে নেওয়াই হল মনুষ্যত্বের পরিচয়। যদিও মানুষ কেবল নিজের করা ভুলই সংশোধন করতে পারে অন্যের নয়। তাই আমরা তাদের ক্ষমা করতে পারি এবং তা ভুলে যেতে পারি।
পরের শ্লোকেও ভক্তের গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সন্তুষ্টঃ(স্) সততং(য়্ঁ) য়োগী, য়তাত্মা দৃঢনিশ্চয়ঃ।
ময়্যর্পিতমনোবুদ্ধি(র্), য়ো মদ্ভক্তঃ(স্) স মে প্রিয়ঃ।।12.14।।
সন্তুষ্টঃ = তৃপ্ত ; পার্থিব বস্তু, প্রানী এবং নানান পরিস্থিতি থেকেই একজন মানুষ সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি পায়। এ এমন এক অবস্থা যখন মন আর অন্য পার্থিব কিছু চায় না। এটা ভক্তির অষ্টম পর্যায় যাকে রামায়ণে শ্রীরাম নবধা ভক্তি বলেছেন শবরীকে। যখন আর কোন চাওয়া পাওয়া থাকে না যতটুকু আছে ভগবান প্রদত্ত তাতেই সে সন্তুষ্ট এবং যথাযথ শান্তি অনুভব করে, সেই অবস্থায় কেউ অন্যের দোষ দেখতে পায় না, এমন কি স্বপ্নেও নয়।
শ্রীরাম আরও বলেন শবরীর ভক্তি হল নিখুঁত এবং সম্পূর্ণ ভক্তি। যদি কেউ এই নয়বিধ ভক্তির একটিও পালন করতে পারে তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় হন।
সততং যোগী = সর্বদা সমতা বজায় রাখা ; সন্তুষ্টি বা তৃপ্ত অবস্থা যদি কোন সাময়িক ও সীমিত কারণে বা ঘটনায় ঘটে তাহলে তা সাময়িক হয়। একজন যোগী হলেন যিনি সমতা সতত বজায় রাখেন এবং তার অন্তঃস্থ ঈশ্বরের থেকেই তিনি তৃপ্তি লাভ করেন।
য়তাত্মা = আত্ম সংযমী ; একজন ভক্ত পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বা সংযম রাখেন।
দৃঢ়নিশ্চয়ঃ = দৃঢ় বিশ্বাস; একজন ভক্ত দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে একমাত্র পরমেশ্বরেরই অস্তিত্ব আছে, জগত সংসার তাঁকে ছাড়া অস্তিত্বহীন। আমরা মনকে স্থির করে আমাদের প্রচেষ্টাসমূহে অবিচল থাকতে পারি। যেমন অন লাইন ক্লাসে গীতা শেখার জন্য প্রত্যহ আমাদের প্রচেষ্টাতে অবিচল থাকি।
মৈয়র্পিত মনবুদ্ধিঃ = ঈশ্বরে মন ও বুদ্ধির সমর্পণ ; আমাদের মন ও বুদ্ধি থেকে যে চিন্তার উদ্রেক হয় তা আমাদের কামনার কারণ । তাই ঈশ্বর চান ভক্ত সর্বদা মন ও বুদ্ধি দিয়ে তাঁর চিন্তা করুন, যা স্বতঃই তাঁর প্রতি প্রেমে পরিবর্তিত হয়, কারণ তাঁর চিন্তাই ভক্তকে সর্বদা ঘিরে থাকে।
যে যোগী সর্বদা তৃপ্ত, আত্ম সংযমী, দৃঢ় ভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী, যে তার মন ও বুদ্ধিকে শ্রীভগবানে সমর্পণ করেছেন সেই রকম ভক্ত তাঁর সর্বাধিক প্রিয়।
য়স্মান্নোদ্বিজতে লোকো, লোকান্নোদ্বিজতে চ য়ঃ
হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈঃ(র্),মুক্তো য়ঃ(স্) স চ মে প্রিয়ঃ।।15।।
যস্মান্নদ্বিজতে লোকঃ = যিনি কাউকে উদ্বিগ্ন করেন না – অন্যদের সাথে আচার ব্যাবহার করা জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ, অনেক সময় অনেকের কথায় আমরা নানারকম আবেগের প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করি।
কখনও কারও দ্বারা বা কোন পরিস্থিতি দ্বারা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয় বা কাউকে উদ্বিগ্ন করা উচিত নয়। “এটাও কেটে যাবে” – এই মন্ত্র মেনে আমাদের চলতে হবে।
যে ভক্ত মনে করেন সবাই এবং সবকিছুই পরমেশ্বরের লীলা তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছুই গ্রহণ করেন না। লোকে “আমি” বলতে তার যে ক্ষুদ্র অহং ভাবকে মনে করে সে কিন্তু তা নয়। যিনি বহুগুন সমৃদ্ধ এই মহাবিশ্বকে পরিচালনা করেন তাঁর সাতঘে আমরা একাত্ম বোধ করলেই আমরা তার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি।
যেমন গীতা পরিবারের সেবকরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন এই ঐশ্বরিক কর্মে নির্বাচিত হওয়ার জন্য। তাদের কাছে ছোটখাটো বিষয়গুলি খুবই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। একই ভাবে কোন অপমান, উত্তেজনা বা ভয় মুহূর্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায় কারণ ভক্ত দেখেন যে অপমান, অপমানকারী আর অপমানগ্রহীতা সবই সেই এক পরমেশ্বর।
যিনি আনন্দ, ঈর্ষা, ভয়, উদ্বেগ এবং উত্তেজনা মুক্ত তিনি ঈশ্বরের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হন না।
অনপেক্ষঃ(শ্) শুচির্দক্ষ, উদাসীনো গতব্যথঃ
সর্বারম্ভপরিত্যাগী, য়ো মদ্ভক্তঃ(স্) স মে প্রিয়ঃ।।16।।
অনপেক্ষঃ = প্রত্যাশারহিত; আমাদের মন থেকে প্রত্যাশা দূর করতে হবে কারণ এটাই আমাদের সমস্ত দুর্দশার কারণ। সাধারনত অন্যের থেকে প্রত্যাশা পূরণ না হলে তা হতাশায় পরিণত হয়। এর পরিবর্তে গীতায় সাধকদের যে গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে তা আমাদের পালন করা উচিত এবং প্রত্যাশা নিজের ওপর রাখতে হবে। যিনি প্রত্যাশা মুক্ত তিনি সত্যিই স্বর্গসুখে আছেন যেহেতু প্রত্যাশা কামনায় আবদ্ধ হয় এবং ঘটনাক্রমে তা হতাশায় রুপান্তরিত হয়।
क्यों सामने की खुशी भी, मुट्ठी से रेत की तरह फिसल जाती है?
এই সুন্দর হিন্দি দোহাটি প্রত্যাশার প্রকৃতিকে বর্ণনা করে। বালি যেমন হাত থেকে পিছলে পড়ে যায় তেমনই একজনের যা কিছু আছে তা থেকে আনন্দ না অনুভব করলে সেই আনন্দও পিছলে চলে যায় আর ধরা যায় না।
সন্তুষ্টির সন্ধানে কৃতজ্ঞতা বোধ অত্যাবশ্যক যাতে ভবিষ্যতের অলীক সুখের পেছনে তাড়া না করে বর্তমান অবস্থায় থেকে তৃপ্ত হওয়া যায়। ভক্তের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হল অন্তর এবং বাইরে শুচি বা শুদ্ধ হওয়া, দক্ষ বা জাগরুক হয়ে প্রয়াস জারি রাখা, অন্যের মূর্খতায় উদাসীন থাকা, সমস্ত পীড়া থেকে মুক্ত হওয়া, নতুন করে কোন কামনার প্রয়াস না করা এবং প্রত্যেক কর্মের ফল ত্যাগ করা।
ভক্তের মন সবরকম স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত থাকা উচিত, যাতে করে সেখানে কেবলমাত্র তার কর্তব্য কর্মের বা স্বধর্মের প্রাসঙ্গিক বিষয়ই থাকে। যদি তার ক্রিয়াকর্ম স্বধর্মের অংশ না হয় তাহলে সে অনাবশ্যক মনে করে নূতন ভাবে কোন কিছুর উদ্যোগ নেয় না। কর্মের ফল পরমেশ্বরকে নিবেদন করতে হয়। এতে সে প্রত্যাশারহিত হতে পারে এবং তার অতীতের কর্ম নিয়েও তার কোন উদ্বেগ থাকে না।
ভক্তকে নির্লিপ্ত এবং অনাসক্ত হতে হয় তবে তা তার কর্মকে অযত্ন করার জন্য নয়, কর্মফলের প্রতি অসংশ্লিষ্ট থাকার জন্য।
যার এইসব গুণগুলি আছে তিনি ভগবানের কৃপা লাভ করেন।
য়ো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি, ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি
শুভাশুভপরিত্যাগী, ভক্তিমান্যঃ(স্) স মে প্রিয়ঃ।।17।।
যদি কেউ দীর্ঘ সময় ধরে অনুকূল বিষয় লাভ করেন বা অনুকূল পরিস্থিতিতে বাস করেন তাহলে তিনি আনন্দ লাভ করেন (হৃষ্যতি)। কিন্তু যখন এই বিষয়গুলি বা পরিস্থিতিগুলি হারাতে থাকেন, যা অবশ্যম্ভাবী, তাকে হতাশা ঘিরে ধরে এবং তিনি শোকগ্রস্থ হয়ে পড়েন (শোচতি)।
অপরপক্ষে একজন ভক্ত সব পরিস্থিতিতেই সমতুল থাকেন এবং তিনি কোন বিষয়, ব্যক্তি, পরিস্থিতি বা চিন্তাকে ভাল বা মন্দ এইভাবে চিহ্নিত করেন না যেহেতু সেটাই প্রাথমিকভাবে আকর্ষণ, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ ও দুঃখের কারণ। তিনি সমস্ত বস্তু ও পরিস্থিতিকে তাঁর আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। সঠিক কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করেন এবং লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেন।
যিনি আনন্দে উৎফুল্ল হন না, ঘৃণা করেন না, শোক করেন না বা প্রত্যাশা করেন না এবং যিনি অনুকূল ও প্রতিকূল সব পরিস্থিতিকেই ত্যাগ করেন এবং ঈশ্বরে যার পূর্ণ ভক্তি হয় তিনি শ্রীভগবানের অত্যন্ত প্রিয়।
সমঃ(শ্) শত্রৌ চ মিত্রে চ, তথা মানাপমানয়োঃ
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু, সমঃ(স্) সঙ্গবিবর্জিতঃ।।18।।
সমঃ অর্থাৎ সমান। শব্দটি দুবার ব্যাবহার করে ভক্তের সমতা এবং স্থিরতাকে জোর দেওয়া হয়েছে যা পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারাই সম্ভবপর হয়।
আমাদের অন্তরাত্মা ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে বহির্জগতের সংস্পর্শে আসে। যেমন ত্বক দ্বারা আমরা উষ্ণ এবং শীতের অভিজ্ঞতা লাভ করি। আসক্তির মাত্রা বা অহং সনাক্তকরনে মন ও বুদ্ধি ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয় যা আমাদের ত্বক, কান বা অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে পাঠানো সাধারণ বার্তা থেকে গ্রহণ করা হয়।
বন্ধু এবং শত্রু দুজনের সাথেই পক্ষপাতশূন্য ব্যাবহার করা উচিত ( সঙ্গ বিবরজিতঃ ), ভারসাম্য বজায় রাখা, প্রশংসা বা নিন্দায় উদ্বিগ্ন না হওয়া, শীত ও উষ্ণতায় বা সুখে ও দুঃখে সমান ভাব বজায় রাখা ইত্যাদি একমাত্র অনাসক্তি দ্বারা সম্ভবপর। যাদের মধ্যে এই গুণগুলি আছে তারা শ্রীভগবানের অত্যন্ত প্রিয়।
তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী, সন্তুষ্টো য়েনকেনচিত্
অনিকেতঃ(স্) স্থিরমতিঃ(র্), ভক্তিমান্মে প্রিয়ো নরঃ।।19।।
ঈশ্বর সেই সব ভক্তদের স্নেহ করেন যারা নিন্দা ও প্রশস্তিতে সম মনোভাবাপন্ন, নিরন্তর নীরব সাধনায় ব্রতী, সব পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট, বাসস্থান এবং অন্যবিধ বিষয়ে অনাসক্ত এবং তাঁর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসে মন স্থির রাখেন। যাদের এই গুণগুলি থাকে তারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ভক্ত।
য়ে তু ধর্ম্যামৃতমিদং(য়্ঁ), য়থোক্তং(ম্) পর্য়ুপাসতে।
শ্রদ্দধানা মত্পরমা, ভক্তাস্তেSতীব মে প্রিয়াঃ।।12.20।।
শ্রীভগবান ঘোষণা করেন সেইসব ভাগ্যবান ভক্ত যারা এই সনাতন ধর্মের জ্ঞানামৃত শ্রবণ করেছেন, এইখানে বর্ণিত গুণ সকল দ্বারা গুনান্বিত এবং ভক্তির সাথে তা অনুসরণ করেন, তাঁকে পরমেশ্বর বলে স্বীকার করেন তারা সবাই তার কৃপা লাভ করবেন।
এইভাবে পর পর ভক্তের বিভিন্ন গুণাবলী চিহ্নিত করে তিনি অধ্যায় শেষ করলেন।
ওঁ তৎ সৎ এর উচ্চারণ করে পরমেশ্বরের নাম নেওয়া হয় বা পঠন কালে ভুলভ্রান্তির জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়।
সত্রটি প্রার্থনা গীত এবং প্রশ্নোত্তর পর্বের পর সমাপ্ত হয়।
মুরালী দাদা
প্রশ্ন: কর্তব্য করতে গিয়ে কিভাবে আমাদের ধৰ্ম আর অধর্মের বিচার করা উচিত?
উত্তর: ধৰ্ম আর অধর্ম বিচার করার সময়ে আমাদের জনহিতের কথা ভাবতে হবে। নিজের স্বার্থে কাউকে হত্যা করা কোন ধর্মের কাজ না, আবার যুদ্ধে শত্রু পক্ষকে হত্যা করা অত্যন্ত ধর্মের কাজ। সহিষ্ণুতা ব্যক্তিগত পর্যায় ঠিক। আবার জাতির স্বার্থে শাস্তি অধর্ম নয়। এই ভাবেই আমাদের ভাবতে হবে, যা আমরা করছি তা সমাজ বা জাতির জন্য হিতকারক কিনা। তাহলেই আমরা জানতে পারবো তা ধর্ম না অধর্ম।
নিত্য জী
প্রশ্ন: শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ আমাদের জীবনে অবাস্তব বলে মনে হয়। আমাদের মতো জন কি ভাবে সুখ দুঃখ বা রাগের মতো আবেগ নিয়ন্ত্রণ করবে?
উত্তর: শুরুতে এমন প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। আমরা ভাবি আমরা সাধারণ, তাই কঠিন পন্থা অবলম্বন করতে সন্দেহ জাগে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত যে আমাদের এই সাধারণ দেহে পরমাত্মা নিবাস করেন। তাই এই কঠিন পন্থা অবলম্বন করা আমাদের পক্ষেও সম্ভব। তবে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের রাগতে ব্যারন করেননি, উনি বলেছেন মনকে সংযত করতে। আমাদের মধ্যে যে আবেগ উৎপন্ন হচ্ছে তা যেন আমাদের বিচার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন না করে। আমরা যদি সবার মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজি তাহলে কারও প্রতি বিদ্বেষ আসবে না।
সাধকদের মনের সন্দেহ দূর করে আজকের সত্র হনুমান চালিসা পাঠের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হলো।